মকরবাহনা চতুর্ভুজা দেবী গঙ্গা পতিত পাবনী। তিনি ছিলেন গিরিরাজসুতা। দেবকুলের ইচ্ছায় মহাদেবের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। অতঃপর দেবী মহাদেবের জটার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্ত পিতা গিরিরাজ তাঁকে অভিশাপ দেন, ‘মর্তে নদী হয়ে বয়ে যাবে।’ এই কারণে দেবীগঙ্গা মর্তে নদী হয়ে বহমান হলেন। তার মর্তে আগমনের কারণও বিচিত্র। পুরাণ মতে –
ব্রহ্মার মানসপুত্র মরীচী ও তার পুত্র কশ্যপের বংশে সাগর নামে এক রাজা জন্মগ্রহণ করেন। রাজা সাগরের দুই স্ত্রী– সুমতি ও কেশিনী। জ্যৈষ্ঠ ভার্যা সুমতি ঔর্ব ঋষির বরে ষাট হাজারটি পুত্র সন্তান ও এবং কেশিনী এক পুত্রের জন্ম দেন। কেশিনীর পুত্রের নাম ছিল অসমঞ্জ। সময়ের সাথে সাথে রাজা সাগর নিজ পুত্রদের পৃথিবী ধারনের সক্ষম জেনে দেবকুল ও ঋষিকুলকে আহবান করে বিরাট এক অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। নিয়মানুসারে অশ্বমেধ যজ্ঞের সেই অশ্বকে পৃথিবীর পরিভ্রমণ করার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো।
নাগগন ছিলেন সাগর রাজার শত্রু। সাগররাজ বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেছেন শুনে তারা ঈর্ষায় কাতর হলেন। সুযোগ বুঝে যজ্ঞের অশ্ব মুক্ত হতেই চুরি করে তাকে মহাতলে নিয়ে গেলেন। মহামুনি কপিল দীর্ঘদিন তপস্যা করার পর একস্থানে সমাধি মগ্ন হয়েছিলেন। নাগরা যজ্ঞিয় অশ্বটিকে কপিলমুনির পাশে বেঁধে রেখে গোপন স্থানে লুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
এদিকে যজ্ঞিয় অশ্বকে খুঁজতে খুঁজতে সাগর রাজার ষাট হাজার পুত্ররা অতন, বিতল, সুতল, তল ও রসাতল সর্বত্র খুঁজে অবশেষে মহাতলে গিয়ে অশ্বটিকে দেখতে পেলেন। সাগর রাজের পুত্ররা দেখলেন একজন মুনি ঘুমিয়ে আছেন আর তার পাশে বাধা আছে তাদের যজ্ঞিয় অশ্বটি। কপিল মুনিকে অশ্ব চোর মনে করে, তার কানের কাছে ঢাক ঢোল বাজাতে লাগলেন — এমনকি মুনিকে পদাঘাত করতেও পিছপা হলেন না। তাদের এহেন আচরণে বিরক্ত ও ক্রোধান্বিত কপিলমুনি চোখ খুললেন। দেখামাত্রই ঘটে গেল এক অঘটন। ঋষির ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ভস্মীভূত হলো সাগর রাজের ষাট হাজার পুত্র।
এদিকে সাগর রাজার যজ্ঞ অসমাপ্ত রয়ে গেল, উপরন্তু তার পুত্রদেরও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। অবশেষে দেবর্ষি নারদের কাছ থেকে পুত্রদের মৃত্যু সংবাদ পেলেন রাজা। নারদ বললেন, ‘মহাতলে আপনার যজ্ঞের ঘোড়া বাঁধা আছে।’ রাজা সাগর তখন পৌত্র অংশুমানকে সেই কাজে নিযুক্ত করলেন। অংশুমান মহাতলে গিয়ে মহর্ষি কপিলকে তুষ্ট করে যজ্ঞাশ্বটি গ্রহণ করলেন। মহর্ষি কপিল তাঁকে বললেন, ‘পুত্র, এই নাও যজ্ঞাশ্ব। তোমার পিতৃব্যগণ তমঃস্বভাবের। তাদের মুক্তির জন্য স্বর্গ থেকে মর্তে যদি শিব পত্নী গঙ্গা আগমন করেন, তবে মা গঙ্গার পুণ্যস্পর্শে স্বর্গলাভ করবেন তাঁরা।’
যজ্ঞাশ্ব নিয়ে ফিরে গেলেন অংশুমান। অংশুমানের মুখে সব কথা শুনে সাগর রাজা খুশি হলেন এবং তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ করে অংশুমানকে রাজত্ব দিয়ে বনবাসী হলেন। অংশুমানের দেহ রক্ষার পর তার পুত্র দিলীপ রাজা হন। তিনি বহুকাল তপস্যা করেও মা গঙ্গা-কে তুষ্ট করতে পারেননি। তারপরে রাজা হলেন তাঁর পুত্র ভগীরথ। কিন্তু তিনি রাজত্ব করলেন না। তিনি তার মন্ত্রীর হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে চলে গেলেন হিমালয়। সেখানে গিয়ে তিনি কঠোর তপস্যায় ব্রতি হলেন। হাজার হাজার বছর কেটে গেল — তার উগ্র তপস্যা দেখে দেবগণ ভীত হলেন এবং উপস্থিত হলেন দেবাদিদেব শঙ্করের সম্মুখে। দেবাদিদেব তাঁদের আশ্বস্ত করে ভগীরথের ইচ্ছা পুর্ন করবেন বললেন।
দেবগণ নিশ্চিন্ত হলেও মা গঙ্গা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তিনি গিরিনন্দিনী। গিরিরাজের কাছ থেকে শিবসন্নিধানে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু সেই শম্ভু তাকে মর্তে প্রেরণ করতে চান? কলিকালের মানবগণ গঙ্গার মর্যাদা কি বুঝবে! তারা নানাভাবে অবমাননা করবে। তাছাড়া কলি যুগ পাপে পরিপূর্ণ, ধরায় গমন করলে সেই পাপরাশি গ্রহণ করতে হবে এ কখনো সম্ভব!
দেবীর চিন্তা শুনে মহাদেব বললেন, ‘হে দেবী, স্বর্গে যেমন তুমি আমার মস্তকের উপরে আছো, মর্তেও তুমি আমার মস্তকে অবস্থান করবে। ধরা তলে তোমার বেগ কেউ ধারণ করতে পারবে না বলেই আমি আমার মস্তকটি তোমাকে ধারনের জন্য পেতে দেব। কলিকালের পাপরাশি তোমার জলে ধুয়ে যাবে। যে স্থান দিয়ে তুমি বয়ে যাবে সেই স্থানটি আমার মস্তক স্বরূপ হবে যেন। ধরাতলে তোমাকে যেতেই হবে — কারণ তুমি যখন হিমালয়ের গৃহ থেকে সুরলোকে এসেছিলে তখন মাতা মেনকা ও পিতা হিমালয় তোমায় অভিশাপ দিয়েছিলেন। সেই অভিশাপ ফলবতী হবেই।’
মহাদেবের কথা শুনে দেবী গঙ্গা মর্তে অবতারণের জন্য প্রস্তুত হলেন। শিবের গহন জটাজালে পরিভ্রমণ করতে করতে গঙ্গা ক্লান্ত হয়ে দেবাদিবকে বললেন, ‘হে দেব রাজা ভগীরথের শঙ্খ ধ্বনি আমাকে ব্যাকুল করে তুলেছে। আপনি আমাকে এবার ধরাধামে গমনের পথ করে দিন।’ দেবীর কথা শুনে মহাদেব তার দক্ষিণ দিকের জটাভারের একটি জটা উপড়ে ফেলে দিলেন, গঙ্গা নদীর উপর সেই স্থান দিয়ে প্রবল বেগে ধাবমান হলেন। পথে জহ্নু মুনিকে আশ্রয় করেছিলেন বলে দেবী জাহ্নবী নামে খ্যাত হলেন।
মা গঙ্গা ভগীরথকে বললেন — তোমার জন্যই আমি মর্তে এসেছি। তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে তোমার পিতৃপুরুষের কাছে নিয়ে চলো। ভগীরথ তখন পথের সকল বাঁধা কে অতিক্রম করে পতিতপাবনী গঙ্গাকে নিয়ে এলেন কপিল সদনে। গঙ্গার পবিত্র বারির স্পর্শে মুক্তি লাভ করলেন সাগর পুত্রেরা।
যথায় আছিল ভস্ম সাগরসন্তান। পরশে পরম জল বৈকুন্ঠ প্রস্থান।।
পৌষ সংক্রান্তির পূর্ণ তিথিতে পতিতপাবনী সাগর সন্তানদের উদ্ধার করেছিলেন। কথিত আছে, এই তিথিতে গঙ্গা স্নান করলে সাত জন্মের পাপ ধুয়ে যায়। তাই আজও পুণ্যার্থীরা এই তিথিতেই গঙ্গা স্নান ও পূজা করেন। পঞ্জিকা অনুসারে, ১৪ জানুয়ারি আজ মকর সংক্রান্তি স্নানের পুণ্য তিথি সকাল ৭টা ১৫ মিনিট থেকে শুরু হয়ে থাকছে বিকেল ৫টা ৪৬ পর্যন্ত।
আর মকর সংক্রান্তি মহাপুণ্য তিথি কাল ১৫ জানুয়ারি সকাল ৬টা বেজে ৪৭ মিনিটে থেকে শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: হিন্দুদের দেবদেবী, পূর্বা সেনগুপ্ত এবং অন্যান্য।।
ভীষণ ভালো লাগলো 🙏
থ্যাংক ইউ ❤️