একপাশে আনারসটা রাখার পর বাস্কেটটা ভরে গেল। সে বাস্কেটের ভেতরের এক দিকে কমলা, অন্যদিকে আপেল আর উপরে একগুচ্ছ হালকা সবুজ রঙের আঙুর আগেই ভরা হয়েছিল। তার হাত ব্যাগে দুটো সুরার বোতল ভরতে সে ভোলেনি। ওভারডোজে ঘুমের বড়ি খেলে দোষ নেই, অ্যালকোহলে কী দোষ থাকতে পারে, সে ভেবে পায় না। হাসপাতালে কবি, শিশু কিংবা অপরিচিত যেই হোক না কেন সবাই সমান।
“তোমার ত্বক যেন চাঁদের ত্বক,প্রিয়তম,
হায়!আমি চাঁদের এক অনাথ শিশু,
চাঁদের শ্বেতশুভ্র দুগ্ধ পান করে
আমি তাকে নি:শেষ করেছি—’
ইকবালের কবিতার লাইনগুলো আবৃত্তি করতে করতে মেয়েটি তার লম্বা চুলগুলো আঁচড়িয়ে বিনুনী করে খোঁপা বাঁধল। সে ভাবল, তার স্বামী ওই লাইনগুলোয় কী অর্থ্ বোঝে? সে কখনোই বুঝতে পারে না তার স্বামী তরুণটির কবিতায় এমন কী দেখতে পায় যাতে সে ওইগুলো নিয়ে পাগলের মতো কান্ডকারখানা করে। খোঁপায় ক্লিপ গুঁজতে গুঁজতে সে মনে মনে বলে যত সব আদিখ্যেতা। এখন যাওয়া যেতে পারে ভেবে সে আবার আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল তার স্ফিত পেট সিল্কের কাপড়ের আড়ালে ঢাকা। তার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। এক হাতে ব্যাগ আর এক হাতে বাস্কেটটা নিয়ে সে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হল।
হাসপাতালের ছোট্ট একটা রুমে ইকবাল চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে । ওখানকার নার্সটা তাকে বলল, — ওর বিপদ কেটে গেছে, দু’একদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হবে। মেঝেয় বাস্কেটটা নামিয়ে রেখে সে ওখানে রাখা চেয়ারটাতে বসল। ইকবালের ফরসা মুখ, কোঁকড়ানো চুল, লালচে নাক ও ঠোঁটদুটো সে ওখান থেকেই দেখতে পাচ্ছিল। সে ভাবল, ইকবাল মেয়ে হলে ছেলেদের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারত।
তার স্বামীর আতঙ্কিত মুখটা এখনো তার মানসপটে ভাসছে। সে তার স্বামীর মুখ থেকে প্রথম শুনেছিল যে ইকবাল বিষ খেয়েছে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেই মুহূর্তেই সে বুঝতে পেরেছিল ঘটনাটা সত্যি।
হানিমুনের দিনগুলোতে তার স্বামী তাকে ইকবাল সম্বন্ধে অনেক গল্প বলেছিল। ওয়াইএমসি হোস্টেলের তরুণ রুমমেটের গল্প, বন্ধুর লেখা প্রেমের কবিতা নিজের কন্ঠে আবৃত্তির কথাসহ কত কাহিনি যে তার স্বামী তাকে শুনিয়েছিল। তার ইয়ত্তা নেই। সে সময় ইকবাল সম্পর্কে ওই সব গল্প শুনে সে তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেছিল ইকবাল কোন মেয়েকে ভালোবাসতো কিনা। তার স্বামী জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। তখন থেকেই তার মনে একটা সন্দেহ দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে। সে কেন যেন এক ধরনের ঈর্ষায় জ্বলে যেতে থাকে। স্বামী তার হাত দুটো দিয়ে তাকে জাপটে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে। মেয়েটি উত্তেজিত ভাবে চেঁচিয়ে বলে ওঠে — ওহ তোমার হাত দুটো কী ফ্যাকাশে! সেদিনই সে প্রথম তার বউয়ের সামনে জামাকাপড় খুলে আলগা হয়। তারা চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।
ওরা যেদিন বোম্বে এল সেদিন ইকবাল দাদার স্টেশনে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তার পরনে ছিল নেভি ব্লু শার্ট্। সে লেম্পপোস্টের আলোর নিচে দাঁড়িয়েছিল। মুখটাতে লেগে ছিল বিষণ্নতার আভাস। মেয়েটি তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করল — তোমার বন্ধূ ইকবালের মুখে হাসি নেই কেন? সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তার বউকে ইকবালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ইকবাল কিন্তু সে সময় একবারের জন্যও তার বউয়ের মুখের দিকে চোখ তুলে চাইল না। লোকজনের সামনে দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যওয়ার সময় মেয়েটি তার স্বামীকে ফিস ফিস করে কী যেন বলল। প্লাটফরমের যাত্রীদের আনাগোনা আর কোলাহলে কান ঝালাপালা হওয়ার মতো অবস্থা। এ পরিবেশের মাঝেও মেয়েটি তার স্বামী ও তার তরুণ বন্ধূটির দিকে একবার তাকাল।
সপ্তাহখানেক পরে ওরা স্বামী স্ত্রী স্থায়ীভাবে ওখানে বসবাস করতে শুরু করল। এক রবিবারে ওদের সাথে সারাদিন কাটানোর জন্য তারা ইকবালকে আমন্ত্রণ জানাল। আমন্ত্রণ পেয়ে ইকবাল তাদের বাসায় এল। কিন্তু সে মাত্র ঘন্টা খানেক তাদের বাসায় থেকে তার অসুস্থ চাচাকে দেখতে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে ওদের বাসা থেকে চলে গেল। মেয়েটির স্বামী ওকে বাসার একলা রেখে ইকবালকে রেল স্টেশনে এগিয়ে দিতে গেল। মেয়েটি এটা ভেবে দুঃখ পেল কেন তার স্বামী তাকে সঙ্গে নিয়ে ইকবালকে স্টেশনে এগিয়ে দিতে গেল না! দু-দিন পরে মেয়েটি বিছানার তোষকের নিচে একটা কবিতা দেখতে পেল। ‘তোমার ত্বক যেন চাঁদের ত্বক, প্রিয়তম, হায়, আমি চাঁদের এক অনাথ শিশু, চাঁদের শ্বেতশুভ্র দুগ্ধ পান করে আমি তাকে নিঃশেষ করেছি—
ইকবাল পরের রবিবারে লাঞ্চ খেতে না আসতে চাওয়ায় তার স্বামী বেচারার মন খারাপ। একদিন কোন কারণ ছাড়াই তার স্বামী তাকে বলল — তুমি সন্ধিগ্ধ মহিলা। স্বামীর কথা শুনে সে বলল — তোমার কী হয়েছে? তোমার অফিসে কি কোন কিছু ঘটেছে? কেন তুমি আমাকে এ সব কথা বলছ? স্বামী বেচারা তার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে একটু উচ্চ কন্ঠে বলে উঠল — না, তোমার কোন দোষ নেই, সব দোষ আমার — তুমি কী বলছো!
তার গর্ভের সন্তান দিনে দিনে বড় হচ্ছে। নাইয়ের নিচে পেটটা ক্রমশ বেড়ে উঠছে। তার স্বামী বেচারা সত্যিকারের সাচ্চা প্রেমিক। গর্ভের সন্তানের হৃদপিন্ডের স্পন্দন শোনার জন্য সে তার স্ত্রীর পেটে উপর কান রাখলে বউটি বলল — আমাদের সন্তানের নাম রাখব ইকবাল। এভাবেই আমরা তোমার বন্ধুকে খুশি করার চেষ্টা করব। বউয়ের কথা শুনে সামী বেচারা খুশির আমেজে নিজের মাথাটা বউয়ের কোলে রাখল। মিনিট খানেক পরে মেয়েটি বুঝতে পার তার স্বামী কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ইকবালকে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, এ খবরটা এক চাচার কাছ থেকে পেয়ে তার স্বামী হাসপাতালে ছুটে যায়। সে ইকবালের বিছানার পাশে বসে থাকে। ইকবাল শংকা মুক্ত হওয়ার পর তার স্বামী বাড়ি ফিরে এসে স্বস্তিতে বউয়ের গলা জড়িয়ে ধরে একটা ঘুম দেয়। তার স্বামী অফিসে রওনা হলে স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ না করেই বউটি ইকবালকে দেখার জন্য হাসপাতালে ছুটে যায়।
ইকবাল চোখ খুললে মেয়েটি তার চোখে ভয়ের চিহ্ন দেখতে পেল। ছেলেটি আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে দেখে মেয়েটি উচ্ছ্বসিত হয়ে ভাবল — আমি জানি তুমি কেন এমন করছো। সে প্রকাশ্যে বলল — ইকবাল, আমি জানি তুমি কেন এমন করছো! ইকবাল কোন কথা বলল না। মেয়েটি বলে চলল — তুমি আমাকে ঈর্ষা কর। ইকবাল এবার বিষণ্ন কন্ঠে জবাব দিল — কেন আমি তোকে ঈর্ষা করব? — তুমি ঈর্ষান্বিত কারণ তোমার পক্ষে গর্ভবতী হওয়া সম্ভব নয়, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের পেটটার দিকে দৃষ্টি হেনে মেয়েটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল। তারপর সে পেছন ফিরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সে সময় ইকবাল ঘৃণাসূচক শব্দ করে বলল, — এখান থেকে বের হয়ে যাও, শয়তানী। ইকবালের কথায় রাগের পরিবর্তে মেয়েটির মনটা হালকা হল, খিল খিল হাসি যেন তার গলা দিয় বুদবুদের মতো বের হয়ে আসতে চাইল। দরজা বন্ধ করে সে করিডোর দিয়ে হেঁটে গেল। তার অট্টহাসির শব্দে করিডোরটি মুখর হয়ে উঠল।
মনোজিৎকুমার দাস, অনুবাদক : লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।