বহমান সময়ের করালঘাতে জমিদারির জৌলুস প্রায় অস্তাচলের পথে, নিভে গেছে জলসাঘরের ঝাড়বাতি। শতজীর্ণ রাজবাড়ীর কৌলীন্য উন্মুখ তার পুনরুদ্ধারে।
আজ নিমতিতায় গঙ্গা পাড়ের জমিদারবাড়ি জুড়ে রয়েছে আগাছার জঙ্গল, সাপখোপ আর বাদুড়ের নিরুপদ্রব আস্তানা — অনেকটা জলসাঘর সিনেমায় অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের মতো বড়ো অসহায় তার চেহারা। অথচ কোন এক সময়ে শমসেরগঞ্জের নিমতিতার শেরপুর মৌজায় ১৯২ কাঠা জমির উপর বিশাল আয়তনের এই রাজবাড়ি ছিলো উৎসব ও সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু।
কেতাবি নাম নিমতিতা ভবন। তবে ‘জলসাঘর’ নামটিতেই বেশি পরিচিতি। এলাকার মানুষজন “বাবুবাড়ি” নামেও ডাকে….সেই ডাকে কোথাও যেন মিশে আছে জমিদার বাড়ির ইতিহাস।
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরীর উদ্যোগে ইতালিয়ান ধাঁচে তৈরি হয় এই জমিদার বাড়ি। পদ্মাপাড় থেকে এসে দ্বারকানাথ চৌধুরী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের আওতায় নিমতিতা এস্টেট নামে জমিদারির পত্তন করেন।
সেই সময় এলাকায় দুর্গাপূজার প্রচলন না থাকলেও গ্রামবাসীদের মঙ্গলকামনায় এই জমিদার বাড়িতেই প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। মহাসমারোহে দুর্গা পুজোর চারদিন আয়োজনে মেতে উঠতেন গ্রামবাসীরা।
ষষ্ঠীর দিন হতো মায়ের আবাহন। নববধূর সাজে সেজে উঠতো গোটা রাজবাড়ি। বাজতো ১০০টি ঢাক, গঙ্গা থেকে ঘট ভরে আনা হতো চাঁদির ছাতা নিয়ে। গ্রামবাসীদের পাত পেরে খাওয়া দাওয়া ছাড়াও চলতো নাচ, গান, নাটক নানা ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং তাতে অংশ গ্রহন করতো দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষজনও। পুজোর শেষে উড়িয়ে দেওয়া হতো নীলকন্ঠ পাখি।
বর্তমানে গৌরসুন্দর চৌধুরীর চতুর্থ প্রজন্ম কলকাতা থেকে এসে এই পুজো করেন। সেই জৌলুস না থাকলেও এখনো জমিদার বাড়ীর ঠাকুর দালানে একচালা দেবী প্রতিমা। দর্শন না করলে পুজো অসম্পূর্ণ থেকে যায় অনেক এলাকাবাসীর কাছেই। প্রতিমা শিল্পীরাও এখানে বংশানুক্রমিক ভাবে মূর্তি গড়ে আসছেন।
এক সময় জলসাঘরের ঠাকুর দালান ছিলো নাটকের আঁতুড়ঘর। দ্বারকানাথের বড় ছেলে মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী নাট্য জগতে এক পরিচিত নাম। কলকাতার স্টার থিয়েটারের সমতুল্য হিন্দু থিয়েটার রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করলেন এই জমিদার বাড়িতে। নবনির্মিত এই থিয়েটারে নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ীর উপস্থিতিতে মঞ্চস্থ হলো ‘আলমগীর’ নাটকটি। ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন স্বয়ং মহেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরি এবং পরের দিন একই চরিত্রে অভিনয় করলেন শিশির ভাদুড়ি মহাশয়। এছাড়াও শঙ্করাচার্য, মেবার পতন, শাহজাহান, রামানুজ, রঘুবীর, প্রতাপাদিত্য প্রভৃতি নাটক মঞ্চস্থ হয় এইখানেই। কিন্ত এক ভয়াল বন্যার কবলে নদীগর্ভে তলিয়ে যায় রাজবাড়ির ঠাকুরদালান, অতিথিশালা, ফুলবাগান… যা আজো চলছে সমানে।
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামও এসেছিলেন এই বাড়িতে। এই রাজবাড়ীতেই ১৯৬৯ সালে ইন্দো-পাক চুক্তির কমিশন বৈঠক বসেছিল।
১৯৫৮ সালের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় এখানেই তৈরি করেন কালজয়ী ছবি জলসাঘর। ছবির সংগীত পরিচালনায় ছিলেন ওস্তাদ বিলায়েৎ খান সাহেব। সত্যজিৎ রায়ের অনুরোধে প্রখ্যাত সানাই বাদক বিসমিল্লাহ খান ও ‘মালিকা-ই-গজল’ বেগম আখতার অভিনয় করলেন জলসাঘর সিনেমায়।
এক উৎসব মুখর সন্ধ্যায় জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের ছেলের উপনয়নের গানের আসরে দুর্গাবাঈ ধরলেন পিলু ঠুমরি — ‘ভরি ভরি আয়ি মোরি আঁখিয়া’। গানের মাদকতায় আচ্ছন্ন হলো জলসাঘরে গানের আসর। এই দুর্গাবাঈ-এর চরিত্রে অভিনয় করেন বেগম আখতার।
রাজবাড়ীর ইতিহাসে যোগ হলো এক নব অধ্যায়।
সত্যজিৎ রায় তাঁর পরবর্তী ছবি দেবী (১৯৫৯), তিন কন্যা, সমাপ্তি (১৯৬০) শুটিংও করেন এখানেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, শর্মিলা ঠাকুর, তুলসী লাহিড়ী, কালি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত স্বনামধন্যরা এসেছিলেন ছবির শুট করতে এই রাজবাড়িতে।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তার স্ত্রী বিজয়া রায় ও পুত্র সন্দীপ রায়ও এসেছিলেন এই রাজ বাড়িতে শুটিংয়ের সময়। জমিদার বাড়ির সঙ্গে রায় পরিবারের সখ্যতা এতটাই অন্তরঙ্গ হয়েছিল মাঝেমধ্যেই সপরিবারে আসতেন এখানে সত্যজিৎ রায়। দোতলার ঘরে বসে গঙ্গার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতেন রায়বাবু।
তবে খুশির খবর, দীর্ঘদিনের দাবির পর অবশেষে গত জুন মাসে ইতিহাসের সাক্ষী এই নিমতিতা রাজবাড়ি হেরিটেজের তকমা পেলো। গত ১৭ মার্চ রাজবাড়ী পরিদর্শনে যান পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের ওএসডি বাসুদেব মালিকের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল। পরিদর্শনের পরই এই ঘোষণা।
স্বাভাবিক ভাবেই এলাকাবাসীদের কাছে এটি আনন্দ ও আশার খবর। সরকারিভাবে এই রাজবাড়ির রক্ষনা বেক্ষণ করা হবে। হেরিটেজ হওয়ায় পর্যটকদের সমাগম হবে। বিড়ি শিল্প অধ্যুষিত এই এলাকায় নতুন কর্মসংস্থানের আশা দেখছেন বাসিন্দারাও। বিড়ি বেঁধে, দিনমজুরের কাজ করে কোনরকমে পেট চালান এলাকার বেশিরভাগ মানুষ।
কলকাতা থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কৃষ্ণনগর বহরমপুর হয়ে অথবা দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পানাগড়, সেখান থেকে পানাগর, মোরগ্রাম জাতীয় সড়ক ধরে নিমতিতা। ফারাক্কাগামী প্রায় সব ট্রেনই নিমতিতা পৌঁছে দেয়। প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্ব ঐতিহ্য সপ্তাহ পালিত হয়। সেই আবহে ঘুরে আসতে পারেন নিমতিতা রাজবাড়ি ।।
Source : Various sources have been referred to for information.
ভারী সুন্দর লাগলো
থ্যাঙ্ক ইউ ❤️
Khub sundar likhechhen…onek kichhu jante parllam…onek onek subhechha janai…aro natun kichhu likhun…
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে ❤️
বাহ! চমৎকার তথ্যবহুল লেখা।