রাম তো বিজয়া দশমীতে রাবণ বধ করলেন সোনার লঙ্কায়। আমরা আনন্দে কোলাকুলি করলাম। বড়দের আশির্বাদ নিলাম। মিষ্টি খেলাম। দেশের অন্যদিকের মানুষ মস্ত বড় রাবণ পুতুলকে জ্বালিয়ে দশেরা করলেন।
লঙ্কায় রামের আরো কিছু কাজ বাকি ছিল। রাবণের অন্ত্যেষ্টি হল। সোনার লঙ্কার বিলিব্যবস্থা করতেও সময় লাগল। বিভীষণকে সিংহাসনে বসিয়ে অযোধ্যায় ফিরতে তাঁর কুড়িদিন সময় লেগে গেল।
ফিরে আসার সময় তিনি রাবণের পুষ্পক রথটি হাতছাড়া করলেন না। সেটি রামের তো বটেই, সীতারও বড় পছন্দ। সেই সীতাহরনের সময় থেকেই! এমন রথ অযোধ্যাতে নেই। তাই উড়ন্ত রথে তাঁদের যাত্রা শুরু হল।
ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে এতদিন পরে। তাই সাজো সাজো রব। মাটির কুটীর থেকে চকমেলানো অট্টালিকা…. সর্বত্র রঙের পোঁচ পড়ছে। তিনমাসের বর্ষার জলে ধুয়ে এমনিতেই ঘরবাড়ি শ্রীহীন হয়ে গেছে। একটু চুনকাম না করলে ভালো দেখায় না।
বাড়ির খুকিরা ইঁটকাদামাটি দিয়ে বাগানে পুতুলের ঘর বানায়। তাকে হিন্দি বলয়ে ঘরোন্দা বলে। সেখানেও রং করা হবে। আলো দেওয়া হবে। কোথাও যেন কোনো অন্ধকারের, মালিন্যের স্পর্শ না থাকে।
গোটা ভারত জুড়েই উৎসবের রঙ লাগে দীপাবলিতে। ধানের ক্ষেতেও সে সময় সোনালী রঙ। সেই সোনারঙের দোলা কৃষকের মনেও। তাই ধান্যলক্ষ্মীরও পুজো হবে ষোড়শ উপাচারে।
এই মালিন্যহীন খুশির আবহে লক্ষ্মীদেবীর আবাহন ঘরে ঘরে। তাই সেদিন দুয়ার খুলে ঘর আগলানোর রাত। দরিদ্রের কুঁড়েঘর বা ধনীর অট্টালিকা যাই হোক না কেন,
“আমার আপন ঘরের কাছে সকল কিছু পর,/থাকতে যেন পারি সেথায় সারা জীবন ভর।”
কালিপুজোর আগে আমাদের বাড়িতেও ঠাকুমার মা (আমাদের দিদিমণি) রান্নাঘরের দেওয়াল জুড়ে পিটুলিগোলা দিয়ে আঁকতেন সম্পদের নানা চিহ্ন। ধানের মরাই, গোয়ালে গোরু, সিন্দুকে টাকা, গয়নাগাঁটি, বাসনকোসন, মায় নথ পরা লক্ষ্মীর পেঁচাটি অবধি। ঠাকুরবাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হত কালীপুজোর দিন।
বাংলায় দীপান্বিতা শ্যামার আবাহন হয় অশুভ শক্তির পরাজয়ের প্রতীকরূপে। আর পরের দিন কারোর কারোর ঘরের দোরগোড়ায় দেখা যায় গোবরের অলক্ষ্মীরা রাস্তায় পড়ে আছেন। সুন্দরের আরাধনায় অসুন্দরের যে কোনো ঠাঁই নেই!
ছত্তীশগঢ়ে অনেকদিন থাকার ফলে জেনেছিলাম, দিওয়ালির ঠিক পরে পরেই দেও-উঠনী (দেবতা জাগরণের) একাদশী। স্বয়ং বিষ্ণু নাকি অনন্তনাগের শয্যা থেকে সেদিন যোগনিদ্রা ভঙ্গ করেন। তার আগে তিনমাস তাঁর নিদ্রাকাল। গ্রামের মানুষ মাঠেঘাটে কাজ করবে। সময় কোথায় তাঁকে পুজো করার? তাই নারায়ণের নিশ্চিন্ত নিদ্রা ।
এই অনন্তশয়ান থেকে স্বয়ং ভগবানকে কি আর “এই উঠে পড়” বলে তোলা যায়! ছত্তীশগড়ের রাউত বা গোপ সম্প্রদায়ের মানুষ মাথায় ঝলমলে মুকুট পরে নেচে গেয়ে তাঁর জাগরণের উৎসব পালন করেন। তাকে বলে রাউতনাচা। ভগবানের সঙ্গে সঙ্গে আপামর জনসাধারণেরও মনোরঞ্জন হয়। তারা পথেঘাটে নেচে বেড়ান। কিঞ্চিৎ অর্থাগমও হয়।
ঐদিন তুলসীও গাঁটছড়া বাঁধেন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে। শীতের শুরুতে সর্দিকাশী উপশমকারী অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই ভেষজ উদ্ভিদটিও পূজিত হন সেদিন সমাদরে। খেত থেকে আনা নতুন আখের ছাউনি বানানো হয় তুলসীমঞ্চ ঘিরে। আখের বুকে তখন পুরোপুরি রসের সঞ্চার হয়ে গেছে। এর পরেই আখের গুড়ের সুগন্ধে ভরে যায় গোটা গাঁ-ঘর।
এদিকে গোটা কার্তিকমাস ধরে আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হয়েছে পূর্বপুরুষদের জন্যে। তাঁরাও এ আলোর পথ ধরে লক্ষ্মী নারায়ণের সঙ্গে এসে আশীর্বাদ করেন তাঁদের উত্তরসূরীদের। কিসের আশীর্বাদ?
হেমন্তের বিষাদ, শীতের জড়তা যেন না গ্রাস করতে পারে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে। এখনো অনেক কাজ বাকি। কৃষকের পরিশ্রমের ফসল মাঠে ঘাটে বিছিয়ে আছে। তাকে ঘরে তুলতে হবে। আছে ঝাড়াইবাছাইয়ের মত পরিশ্রমের কাজ। সম্বতসরের জন্যে গোলায় সঞ্চয় করতে হবে অমূল্য রতন!
সারা বছরের পরিশ্রম যেন বৃথা না যায়। লক্ষ্মীদেবীর কৃপা থেকে যেন বঞ্চিত না হয় সাধারণ মানুষ। ধনধান্যের আলোয় দূর হবে অন্ধকার, দারিদ্র্য।
পৃথিবীর চাকাটি ঘুরতে থাকবে তার নিজের নিয়মে। ধরিত্রীর সন্তানরা কর্তব্যরত হয়ে রক্ষা করবে এ প্রকৃতিকে, প্রকৃতির সমস্ত সম্পদ কে।
“যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো — / জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে॥/দেবতারা আজ আছে চেয়ে — জাগো ধরার ছেলে মেয়ে,/আলোয় জাগাও যামিনীরে।
খুব খুব ভাল লাগল।
যথারীতি ভারী সুন্দর মন কাড়া লেখা ❤️
আমার লেখা যাঁরা পড়লেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ