সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের কালজয়ী উপন্যাসের অসহায় বালিকা, যে কয়েকটি বনফুলের মালা বিক্রি করতে মেলায় গিয়েছিলো সেই রাধারানীর কথা মনে পড়লেই তার অনুষঙ্গে মাহেশের রথের কথা এসে যাবে। কিংবা মাহেশের রথের কথা উঠলেই বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানী অনুল্লেখিত থাকবে না এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। অতিমারির কারণে বাঙালির আবেগের সঙ্গে ভীষণভাবে যুক্ত রথযাত্রা ও বন্ধ হয়ে ছিল দুই বছর। সুখের কথা বর্তমান বছরে মাহেশের ৬২৬ তম রথযাত্রা উপলক্ষে পুনরায় রথের রশিতে টান পড়তে চলেছে। মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে জগন্নাথের রথ বিভিন্ন দিক থেকে তার আঁটোসাটো প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের ট্রাস্টের সম্পাদক পিয়াল অধিকারী জানিয়েছেন, ‘যেহেতু দু-বছর বন্ধ ছিল আমরা আশা করছি এই বছরে রেকর্ড পরিমাণ ভিড় হবে। যাতে কারো কোনো অসুবিধে না হয়, যাতে সুশৃংখলভাবে সবকিছু চলে সেই জন্য পুলিশ বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, ফায়ার ব্রিগেড সবাই সতর্ক আছে এবং তারা বিভিন্ন রকম কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। বর্তমান বছরে রীতি নিয়ম মেনে সমস্ত কিছু উৎসব অনুষ্ঠান পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করা হবে।’
মাহেশের রথের একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। যতদূর জানা যায় প্রথমত বৈদ্যবাটি এক ভক্ত মন্দিরের রথ দান করেছিলেন সেটা ১৪৯৭ সাল। শুরুতে মহেশ থেকে দোলতলা পর্যন্ত রথযাত্রা হত বলে জানা যায়। বর্তমানে স্নানপিঁড়ি মাঠ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে মাসির বাড়ি পর্যন্ত রথ টানা হয়।
১৭৯৭ সালে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের এক বিখ্যাত শিষ্য বলরাম বসুর দাদা কৃষ্ণ রাম বসু একটি রথ দান করেছিলেন। সেই রথ অনেক অংশে ভেঙেচুরে গেলে কৃষ্ণ রামের পুত্র গুরুপ্রসাদ পরবর্তী বছরে আরো সুন্দর করে নয় চুড়া বিশিষ্ট নতুন রথ বানিয়ে দেন। ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। এদিন বল্লভপুর গুন্ডিচা বাড়িতে আগুন লেগে যাওয়ায় রথটি নষ্ট হয়ে যায়। তখন শ্যাম বাজারের বসু পরিবারের সদস্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু রথ নির্মাণ করিয়ে দেন। ১৮৮৫ সাল থেকেই সেই রথ টানা শুরু হয়। বর্তমানেও সেই রথটি আমরা দেখতে পাই। চার তলা বিশিষ্ট এই রথটি সম্পূর্ণ লোহার কাঠামোর উপর কাঠ দিয়ে তৈরি। উচ্চতা ৫০ ফুট, ওজন ১২৫ টন। এক ফুট বেড়-এর বারোটি লোহার চাকা আছে, রথের সামনে তামার তৈরি দুটি ঘোড়া জুড়ে দেওয়া হয়। রথের চার তলায় দেবতাদের বিগ্রহ বসানো হয়।
এ তো গেল রথের কথা। জগন্নাথ দেবের এখানে আবির্ভাব নিয়েও কিছু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে এই এলাকায়। চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ নামে এক ভক্ত জগন্নাথ দর্শনে পুরী গিয়েছিলেন। তার বাসনা হয়েছিল প্রাণের দেবতা জগন্নাথ কে তিনি নিজে হাতে রান্না করা ভোগ নিবেদন করবেন। কিন্তু পুরীর ব্রাহ্মণ ও পাণ্ডাদের আপত্তিতে তা হয়ে উঠলো না। তখন মনের দুঃখে তিনি অনশন শুরু করলেন। এক মনে জগন্নাথ দেব কে ডাকেন আর দুই চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু বয়ে যায়। তিনদিন পর জগন্নাথ দেব স্বপ্নে তাকে দেখা দিলেন। তিনি বললেন, ‘ধ্রুবানন্দ তুমি বঙ্গদেশে ফিরে যাও সেখানে ভাগীরথীর তীরে মাহেশ নামে একটি গ্রাম আছে সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমি দারুব্রম্ভ (নিম কাঠ) পাঠিয়ে দেবো ভাগীরথীর জলে। তাই দিয়ে মূর্তি বানিয়ে আমার পুজো করো। তোমার ভোগ গ্রহণের জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি।’
সত্যিই এক বর্ষার দিনে কাঠের গুঁড়ি ভেসে এলো নদীতে। তার থেকেই জগন্নাথ,বলরাম, সুভদ্রার বিগ্রহ নির্মাণ করে পূজা শুরু হল। বেশ কিছুদিন কাটলো ধ্রুবানন্দেরও তখন বয়স হয়েছে। এই সময় শ্রীচৈতন্যদেব পুরী যাওয়ার পথে মাহেশে এসে উপস্থিত হলেন। এখানকার মাহাত্ম্য অনুভব করে তার ভাবসমাধি হলো। তিনি মাহেশকে নব নীলাচল আখ্যা দিলেন। ধ্রুবানন্দ তাঁকে এখানকার সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন।
শ্রীচৈতন্যদেবের সঙ্গে ছিলেন কমলাকর পিপলাই। তাঁকে দ্বাদশ গোপালের পঞ্চম গোপাল বলা হত। তিনি সুন্দরবনের এক জমিদারের সন্তান নদীয়ায় অধ্যায়নের জন্য এসেছিলেন। তাকেই উপযুক্ত মনে করে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব তার হাতে এই মন্দিরের ভার তুলে দেন। এর অল্প কিছুকাল পরই ধ্রুবানন্দের জীবনাবসান হয়। তখন থেকেই কমলাকর পিপলাই এর পরিবার বংশানুক্রমে শ্রীচৈতন্যদেবের আদেশ মাথায় নিয়ে মন্দিরের দায় দায়িত্ব পালন করে আসছে। এই পরিবারের ১৩ তম পুরুষ সৌমেন অধিকারী বর্তমানে এই মন্দিরের প্রধান সেবাইত এবং তাঁর পুত্র পিয়াল অধিকারী মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের সম্পাদক।