ফেরদৌসী রহমান বাংলাদেশের একজন সুকণ্ঠী গায়িকা। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তার সঙ্গীত জগতে পদচারণা চলছে। বাংলা গানের প্রায় সব শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন। পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিকসহ সব ধরনের গানই তিনি গেয়েছেন সুরেলা কণ্ঠে। বাংলা গানকে তিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। শিল্পী পরিবারে জন্ম তার। বাবা কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আব্বাস উদ্দিন। বাবার মুখ উজ্জ্বল করে তিনি নিজেই জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। কেবল গায়িকা নন, গানের শিক্ষকও ফেরদৌসী রহমান। গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে গানের সঙ্গে তার পথচলা। ফেরদৌসী রহমান ১৯৪১ সালের ২৮ জুন ব্রিটিশ ভারতের কোচবিহারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় গানে হাতে খড়ি হয় তার পিতার কাছে। পরবর্তীতে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ইউসুফ খান কোরেইশী, কাদের জামেরী, গুল মোহাম্মদ খান প্রমূখ সঙ্গীতজ্ঞের কাছে তালিম নেন। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি মঞ্চে পারফরম্যান্স শুরু করেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে রেডিওতে খেলাঘর নামের অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ নামের চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম নেপথ্য কণ্ঠদান করেন। ৬০ ও ৭০-এর দশকের বহু চলচ্চিত্রে তিনি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তার প্লে ব্যাক করা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৫০-এর কাছাকাছি। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম রেডিওতে গান করেন। তখন তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম বড়দের অনুষ্ঠানে গান করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি প্রথম গান রেকর্ড করেন এইচ এম ভি থেকে।
ফেরদৌসী রহমান ১৯৬০ সালে ফেলোশীপ পেয়ে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে ৬ মাসের সঙ্গীতের ওপর স্টাফ নোটেশন কোর্স সম্পন্ন করেন। ৩টি লং প্লে-সহ প্রায় ৫০০টি ডিস্ক রেকর্ড এবং দেড় ডজনের বেশি গানের ক্যাসেট বের হয়েছে তার। তার মাত্র ১টি সিডি বের হয়েছে ‘এসো আমার দরদী’। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার গানের রেকর্ড হয়েছে তার। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা সংগীত পরিচালক। ১৯৬০ সালে রবীন ঘোষের সাথে ‘রাজধানীর বুকে’ নামক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে এসো গান শিখি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।
ফেরদৌসী রহমান নজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। সঙ্গীত ভুবনে অবদান রাখার জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে নানাভাবে সন্মানিত হয়েছেন। তার অর্জিত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩), প্রেসিডেন্ট প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৬৫), টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৫), জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক (১৯৭৭), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৬), একুশে পদক (১৯৭৭)। এছাড়াও তিনি নাসিরউদ্দিন গোল্ড মেডেল পুরস্কার, মাহবুবুল্লাহ গোল্ড মেডেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডস আয়োজন হতে পরম্পরা পরিবার পদক লাভ করেন।
প্রখ্যাত পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা উপমহাদেশের বরেণ্য সংগীত শিল্পী ফেরদৌসী রহমান সংগীত জগতে ছড়িয়ে আছেন নিজের আলোয়। তাকে চিরসবুজ গানের পাখিও বলা হয়ে থাকে। সত্যি তিনি গানের পাখি। জানা যায় তার জীবন ও কর্মের উপর ভিত্তি করে ‘গানের পাখি’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে।।
বাংলা-উর্দু মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের পাশাপাশি তার গাওয়া গানের সংখ্যা প্রায় ৫০০০। যার মধ্যে রয়েছে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, গজল এবং উচ্চাঙ্গ সংগীত। এ ছাড়া তিনি জার্মান, রুশ, চীন-সহ একাধিক ভাষায় গান করেছেন।
তার গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে — “যে জন প্রেমের ভাব জানে না”, “ওকি বন্ধু কাজল ভ্রমরা”, “যার ছায়া পড়েছে মনের আয়নাতে”, প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্ব তলায় বংশি বাজায় কে”, “পদ্মার ঢেউ রে” ইত্যাদি। তাঁর গাওয়া “অচিন গাঁয়ের অচিন বন্ধুরে”, “অকূলে ভাসাইও নাগো মোরে”, “সোনাবন্ধুরে কোন দোষেতে যাইবা ছাড়িয়া”, “ভ্রমর কইও গিয়া”, “অইনা মাধবী বনেতে বন্ধু ছিল”, “বাবুই চ্যাঙড়ারে”, “ও মোর বানিয়া বন্ধুরে”, “ও মুই না শুনো না শুনো তোর বৈদেশিয়ার কথারে”, “ও কি গাড়িয়াল ভাই”, “সে যেন কি করলো রে আমার কি যেন কি দিয়া”, “গানগুলি মোর আহত পাখির সম”, “সে চলে গেছে বলে কি গো স্মৃতিও হায় যায় ভোলা”, “চোখ মুছিলে জল মোছে না”, “নিশি ভোর হলো জাগিয়া”, “গান হয়ে এলে মন কেন বলে”, “কথা বলো না বলো ওগো বন্ধু”, “যার ছায়া পড়েছে মনের আয়নাতে”, “আমি রূপনগরের রাজকন্যা”, “কি করে তোমাকে ভুলবো, তোমার স্মৃতি আমার জীবন”, “আমি সাগরের নীল নয়নে পরেছি”, “বলাকামন হারাতে চায়”, “লোকে বলে প্রেম আমি বলি জ্বালা” এবং এমন আরো অনেক জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানের শিল্পী তিনি।
ফেরদৌসী রহমান চলচ্চিত্রে প্লে ব্যাক শিল্পী হিসাবে অসংখ গান গেয়েছেন। তার গাওয়া চলচ্চিত্রের গান দু’একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। ‘যার ছায়া পড়েছে মনের আায়নাতে’, ‘গান হয়ে এলে,’ ‘এই নীল নীল নিঃসীম’, ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি অসংখ্যক আধুনিক গান গেয়েছেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনিই গান করেন। ‘ওই যে আকাশ নীল হলো আজ সে শুধু তোমার প্রেম’ গানটি ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম গান।
বিটিভির জনপ্রিয় শিশুতোষ অনুষ্ঠান ‘এসো গান শিখি’ দিয়ে সবার কাছে ‘খালামণি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন ফেরদৌসী রহমান। সেই চিরচেনা মিষ্টি হাসি! এ দেশের কয়েকটি প্রজন্মের শৈশবস্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শিক্ষামূলক শিশুতোষ অনুষ্ঠানটির সঙ্গে। পাপেট মিঠু-মন্টি, গানের খালামণি, কত কিই না এই একটি অনুষ্ঠান থেকে পেয়েছে দর্শকরা! বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৫৫ বছর পূর্তি হয়েছে। সেই সঙ্গে জনপ্রিয় এই শিশুতোষ অনুষ্ঠানও পেরিয়েছে ৫৫ বছর। দীর্ঘ সময় ধরে পাক্ষিকভাবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়ে আসছে ‘এসো গান শিখি’। পুরনো সে চরিত্রগুলোই নতুন সময়ে নতুনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। মাঝে কিছু সময় প্রচার বিরতিতে ছিল। ‘গানের খালামণি’ হয়ে সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানকে দেখা যায় এই অনুষ্ঠানটিতে।
আগেই বলা হয়েছে, ‘৬০ ও ৭০-এর দশকের বহু চলচ্চিত্রে তিনি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ৩টি লং প্লে-সহ প্রায় ৫০০টি ডিস্ক রেকর্ড এবং দেড় ডজনের বেশি গানের ক্যাসেট বের হয়েছে তার। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যেসব গান করেছেন তার সব আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। তার সময়ের গানগুলোর আবেদন কোনোদিনও ফুরিয়ে যাওয়ার না।
ফেরদৌসী রহমান যেসব গান মন টানে সেগুলো হচ্ছে— ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, ‘মনে যে লাগে এত রঙ’, ‘নিশি জাগা চাঁদ’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’, ‘ঝরা বকুলের সাথী আমি’, ‘হার কালা করলাম রে’, ‘গহিন গাঙের নাইয়া’ ও ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝে সই’, ‘কথা বলো না বলো ওগো বন্ধু’, ‘ও কি বন্ধু কাজল ভ্রমরা’, ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে’। এছাড়াও তার অসংখ্য রয়েছে।
পরিশেষে, গানের ঝর্ণা ও গানের পাখি ফেরদৌসী রহমানের আজ ২৮ জুন জন্মদিন। জন্মদিনে তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।
মনোজিৎকুমার দাস,প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক ও কবি। লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।