আমি কারিগর সংগঠন করি। পলাশীর আগে বাংলাকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করেছি আমরা – চাষী হকার আর কারিগরেরা। সেই সম্পদ পলাশীর পর থেকে লুঠ হয়ে ইওরোপে গেছে। আমরা শুধু সেই সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধেই গলা তুলছি না, যে প্রাকৃতিক সম্পদ দখল হয়েছে, যে বৌদ্ধিক জ্ঞান দখল হয়েছে, যে প্রযুক্তিগত জ্ঞান দখল হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আমরা গলা তুলছি। পশ্চিম সেই বৌদ্ধিক জ্ঞান দখল করে, দখলদারির চিহ্ন মুছে, আজ জ্ঞানে স্বয়ম্ভু হবার দাবিদার। এখানে সেই রকম বৌদ্ধিক জ্ঞানচুরি আর দখলদারির কথা আলোচনা করব দুটি খেলা আলোনার মাধ্যমে — যার একটি পচিসি বা চৌপর আজকের লুডো, অন্যটি স্নেক-ল্যাডার বা সাপ সিঁড়ি, যাকে একদা গ্রাম ভারতবর্ষ চিনত মোক্ষপাত বা মোক্ষ পাতম হিসেবে।
চৌপর বা পঁচিশি, আজকে যাকে ইওরোপিয় লুডো খেলা নামে চিনি, দক্ষিণ এশিয়ার তিন সহস্রাব্দের খেলা এবং জ্ঞান। খেলাটা আমেরিকায় কপিরাইট নেন হাডসন রিভার ভ্যালির জনৈক জন হ্যামিলটন ১৮৬০এ। তিনি Patcheesi নামে বিক্রি করতেন। এইভাবে এশিয় নানান জ্ঞান চুরি হয়েছে, বুক বাজিয়ে দখল হয়েছে এবং পশ্চিম সেই সব জ্ঞান আত্মীকৃত করেছে।
পেন্সিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির খপ্পরে কাপড়ে তৈরি পঁচিশি, চৌপর চৌসর নামে বেশ কিছু প্রাচ্যদেশিয় খেলা আছে। যার একটার ছবি এখানে দিলাম। খেলাগুলির আমেরিকা এবং পশ্চিমি শিশুতোষ সংস্করণ পাচিসি, প্রাচিসী, চেস-ইন্ডিয়া ইত্যাদি নামে তৈরি হয় এবং প্রখ্যাতও হয়। এক শতাব্দের বেশি সময় ধরে সে সব দেশে শিশু বিনোদনের দৈনন্দিনের সামগ্রী হয়ে ওঠে খেলাগুলো এবং লগে লগে উপনিবেশিক দক্ষিণ এশিয়ায় চলে আসে। পশ্চিম খেলাটা জানছে পারে আইনি আকবরি থেকে। আকবর আর তার সভাসদেরা আগরা এবং ফতেপুর সিক্রিতে হররোজ চৌপর খেলতেন দাসেদের ঘুটি বানিয়ে। উজির আবুল ফজল লিখছেন, From times of old, the people of Hindustan have been fond of this game। অনেকেই বলেছেন এই খেলাটি তিন হাজার বছর পুরোনো।
পশ্চিমের নৃতাত্ত্বিকেরা বিশেষ করে স্টুয়ার্ট কুলিন পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে খেলাটির উদ্ভব বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি মিউজিয়াম অব সায়েন্স এন্ড আর্টস, বর্তমানে যেটি পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটিতে, তার কিউরেটর ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে ডিরেক্টর হন। খেলাটি নিয়ে প্রথম আলোচনা হয় রিচার্ড করনাক টেম্পলের দ্য লেজেন্ডস অফ দ্য পাঞ্জাব গ্রন্থে। তিনি চৌপর এবং পচিশির খেলার পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে বইতে আলোচনা করেন। খেলাটার প্রকারভেদ নিয়েও আলোচনা করেছেন, বিশেষ করে ঘুটির বৈচিত্র নিয়ে বিস্তৃত বর্ণনা দেন। ইওরোপে যেমন চৌকো ঘণাকৃতি ঘুঁটি নিয়ে খেলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় খেলা হয় লম্বা ঘণাকৃতি মূলত হাতর দাঁতের তৈরি ঘুঁটি নিয়ে।
চৌপর অর্থে চারটি বাহু বিশিষ্ট কাপড়ে তৈরি খেলা। চৌ অর্থে চার পর অর্থে কাপড় যেখান থেকে পর্দা শব্দটা এসেছে। আবার চৌসর অর্থে চার পথের সমাহার। এগুলি খেলা হয় দুটি হাতির দাঁতের ঘুটিতে। কিন্তু পঁচিশি খেলা হয় কড়ি দিয়ে। কড়ি লাগে ৫ বা ৬ বা ৭টা। প্রত্যেকটা চিত হয়ে পড়া কড়ির ৫ অঙ্ক জোরা হত। পাঁচটা কড়ির চিত হয়ে পড়লে পঁচিশ ধরা হত, যেখান থেকে পঁচিশি শব্দটা এসেছে। সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতায় ঘনাকৃতি ঘুটি [ছক্কা] পাওয়া গিয়েছে। এটি ২৩০০ খ্রিপূর। লম্বাটে ঘণ ঘুটি বা ছক্কা কিন্তু ভারতের বাইরে বিশেষ করে মেসোপটেমিয়ায় জনপ্রিয় ছিল। ঋগ্বেদে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। অথর্ববেদেও ছক্কা নিয়ে জুয়ার উল্লেখ আছে। মহাভারতে অক্ষ খেলাতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে। তখন ঘুঁটি ফেলাটা শুধু ভাগ্যের ওপরে ছিল না, জুয়াড়িরা এটা নিয়ে তুমুল গবেষণাও করেছেন। জাতকেও পাশার উল্লেখ পাচ্ছি। সেটাও খ্রিষ্ট জন্মাবার বহু পূর্বে। পঁচিশির কড়িও আমরা হরপ্পায় পাচ্ছি। দুটি লুঠকর্ম আজ আমরা এই প্রবন্ধে চিহ্নিত করলাম।
স্নেক-ল্যাডার অথবা মোক্ষ পাতম
এবারে আমরা সাপ সিঁড়ি, মোক্ষপাত বা মোক্ষ পাতমের ধারণা লুঠ নিয়ে আলোচনা করব। খেলাটা ছিল শিশুদের মনে পাপপুণ্য ইত্যাদি ধারণা তৈরি করাবার প্রাথমিক ধাপ। প্রায় ৭০০ বছর আগে কবি জ্ঞানদেব মোক্ষ পাতম বা চৌখুপি খেলা আবিষ্কার করেন, যাকে আজ পশ্চিম সংস্কৃত করে সাপ সিঁড়ি বা স্নেক-ল্যাডার নাম দিয়েছে। এর ১২তম চৌখুপিতে আছে বিশ্বাস, ৫১ নম্বরে আছে নির্ভরযোগ্যতা, ৫৭ নম্বরে আছে উদারতা, ৭৬ নম্বরে আছে জ্ঞান এবং ৭৮ নম্বরে সন্ন্যাস। এই চৌখুপিগুলিতে সিঁড়ির মাথা ছিল, সেখানে ঘুঁটি পড়লে তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যায়। অন্যদিকে ৪১ নম্বরে আছে অবাধ্যতা, ৪৪ নম্বরে আছে রাগ, ৪৯ নম্বরে আছে অবাধ্যতা, ৫২তমতে চৌর্য, ৫৮ নম্বরে মিথ্যা, ৬২ নম্বরে অন্ধকার, ৬৯ নম্বরে ধারকরা, ৮৪ রাগ, ৯২তে লোভ, ৯৫তে গর্ব, ৭৩এ হত্যা ৯৯তে রিরংসা। এই চৌখুপিগুলোয় থাকে সাপের মুখ, যেখানে পড়লে নেমে আসতে হত। সব শেষ ১০০ নম্বরে ছিল মোক্ষ। প্রত্যেক সিঁড়ির মাথায় থাকতেন বিভিন্ন লোক – কৈলাস, বৈকুণ্ঠ, ব্রহ্মলোকএর অধীশ্বর ভগবান ইত্যাদি। মৌলিক ধারণা একই রেখে বিভিন্ন সময়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এই খেলাকে নানান রূপ দেওয়া হয়।