“জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”
আমি একবার, একটিবারই মাত্র, ঈশ্বরের সেবায় লেগেছিলাম। কালীপুজোর তখনও দিন পাঁচ-ছয় দেরি, একদিন রাত্তিরে খেয়েদেয়ে মেয়েদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে শুনতে পেলুম ঠিক কানের কাছেই বেড়াল কাঁদছে। বেড়াল! আমাদের বাড়ি তো ইঁদুরের স্বপ্নপুরী-এখানে বেড়াল কাঁদবে কোত্থেকে! ভূতটুত নয় তো! ভূতেরা যে মাঝে মাঝেই বেড়াল সেজে দেয়ালের ভেতর থেকে কাঁদে—একথা পো-সাহেব লিখে রেখে গেছেন। কান্না ক্রমেই বাড়ছে। নাঃ, এ ভূত নয়, সাক্ষাৎ কোনো জলজ্যান্ত হুলো। ঘরে ঢুকলো কখন! আলো জ্বাল-আলো জ্বাল খোঁজ খোঁজ ধর ধর তোলপাড় তন্নতন্ন।
নাঃ, বেড়াল বেরুলো না, উলটে দুই মেয়ে উঠে পড়ে মহা হুটোপাটি জুড়ে দিলে। বড় বললে—“জানলার বাইরে,” ছোট বললে—“ঘুলঘুলির ভেতরে, আমার তো মনে হচ্ছে তোশকের তলায়। এদিকে ঘরখানা দোতলায়, জানলার বাইরে ফাঁকা আকাশ ধুধু অন্ধকার হু-হু বাতাস। বাইরে বেড়াল কোথায় থাকবে! আর ঘুলঘুলিতে যদিও চড়াইপাখির সংসার, তাতে বেড়াল ঢোকবার ফাঁক নেই। তবু কান পেতে শুনি—সত্যিই তো। জানলার বাইরে, ঘুলঘুলির দিক থেকেই কান্নাটা আসছে। ঘুলঘুলির ওপরে একটা কার্নিশ আছে বটে।
কিন্তু ওখানে বেড়াল আসবে কোত্থেকে। ছুট ছুট ওপরে। তিনতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখি, তাই তো কার্নিশে একডেলা অন্ধকার জট পাকিয়ে আছে, আর তারই মধ্যে দুটো বিশ ক্যারেটের পান্না জ্বলছে। “কে ওখানে!” বলতেই কান্না বন্ধ হয়ে গেল। উলটে এক প্রবল ধমক এলো—“এ্যায়াও।” কী সর্বনাশ! মেসোমশাই যে। মেসোমশাই সিমলিপালের সেই পোষা বাঘিনী খৈরীর ঠিক উলটো। সাইজে বলো, সেকসে বলো, স্বভাবে বলো। রং মিশমিশে কালো। আসুরিক বলশালী। সম্পূর্ণ বন্য উদ্দাম, স্বেচ্ছাচারী। সাইজে লেজসমেত পৌনে তিন ফুট মতো হবেন। ইয়া কেঁদো! চলাফেরা করেন, ওহ যেন আলেকজাণ্ডার! সে কী স্টাইল। দেখলেই মনে হয় পিছনে একগাদা সৈন্যসামন্ত আসছে, দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন। আমরা তার সামনে লোক তো নই, পোক। প্রত্যেকদিন ফিক্সড টাইমে এসে সামনের বাড়ির অ্যালসেশ্যান সীজারকে ‘এ্যায়াও’ বলে দাঁত খিঁচিয়ে তার দৈনিক বরাদ্দ মাংসটুকু খেয়ে যান।
সীজারের দিনকে দিন হাড় বেরিয়ে পড়ছে। সেদিন কলতলায় হুমমম “ফৌওসস” বলে টিনের চাল থেকে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের রাঁধুনীকে বেদম ভয় পাইয়ে দিয়ে তার চোখের সামনেই জ্যান্ত মাগুর মাছটাকে মেরে তুলে নিয়ে গেছেন।
আমাদের কারুর মনেই সন্দেহ নেই, যে উনি রয়্যাল বেঙ্গল কুলীন কুটুম্ব। তা, মেসোমশাই এই অজায়গায় এলেন কী করে! কখন থেকে! রাঁধুনী তখন কাচুমাচু মুখে জানালে-পরশুদিন যখন মেসোমশাই আবার মাগুর মাছ ধরতে ছাদে এসেছিলেন, তখন বিনু ঝি আর রাঁধুনী দুজনে মিলে তাকে এমনি এক রামতাড়া মেরেছে—যে তিনি সত্যিই “পালাতে পথ পাননি”, যেদিকে দু চোখ যায় ঝাঁপ দিয়েছেন। নেহাত কপাল গুণে পড়েছেন কার্নিশে। রাধুনী তাকে উদ্ধার করতে পারেনি, ভয়ে কাউকে কিছু বলেওনি। কিন্তু কেষ্টর জীব, তাই তাকে দুবেলা দুধে ভেজানো রুটি আর মাছের কাটা উৎসর্গ করেছে। সেই খেয়ে তিনি গত দুদিন ধরেই ওই কার্নিশে নিঃশব্দে কালাতিপাত করেছেন। এখন অরুচি ধরেছে। এবং বন্দীদশার ভয়ে সারাদিন বাদে ‘সোচ্চার’ হয়েছেন।
ওকে তো নামাতেই হয়। শিবু বললে, “কুছ পরোয়া নেই, মাসিমার ডবলবেডর মশারিটা আমরা উঠোনে চারজনে চারকোণা ধরে দাঁড়াই, আর দিদি, আপনি ওকে ঝলঝাড়টা দিয়ে ঠেলতে থাকুন। সার্কাসের কায়দায় আমরা ওকে মশারির চালে লুফে নেবো।”
মা বললেন, “না বাপু, ও সেই পঞ্চাশ সালের মশারি, অত উঁচু থেকে পড়লে অমন দশ সেরি বেড়ালের ভার সইবে না। বেড়ালও যাবে মশারিও যাবে। তার চেয়ে নতুন বেডকভারটা ধর।” আমি ভয় পেলুম, ঠেলাঠেলিতে বেড়াল যদি বেডকভারের বাইরে পড়ে যায়! তার চেয়ে মইটা নামিয়ে দিই, বেড়াল তো গরু নয়, দিব্যি গাছে উঠতে পারে। উঠে আসুক নিজে নিজে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মই নামিয়ে দিয়ে আমরা ঘরে এসে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি। “বলিছে দেওয়াল ঘড়ি টিক টিক টিক।” কিন্তু বেড়াল আর ওঠে না। বেড়াল কেবলই কাঁদে। ইনিয়ে বিনিয়ে সে কি মরাকান্না। বিনু কি শাস্ত্র আওড়ালে—এ কান্না নাকি বাড়ির পক্ষে ভয়ানক অমঙ্গলের—এক্ষুনি বন্ধ করা দরকার। মা বললেন, ভয়ে ওর বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে। ওর এখন ওপরে ওঠার টেকনিকই মনে নেই। ওকে কোলে করে তুলতে হবে। এখন এ কি আমাদের পোষা বাঘ-সিংহ? যে কোলে করে তোলা যাবে? এ হলো আদ্যিকালের হিংস্র পশু, বুনো হুলো। এর জন্যে চাই বাঘা উদ্ধারকর্তা -কোনো হিংস্রতর জীব। শিবু বললে—“ও বাবা। তেতলার কার্নিশে? আমি? মাথা ঘুরে পড়েই যাব।” বিনু ঝি হুকুম করলে রাঁধুনীকে নামতে। রাধুনী বলে—“বিনুদিদি, তার চেয়ে তুমিই যাও।” শুনেই বিনুদিদির ফোকলা মুখে ভয়ানক চালভাজা ছোলাভাজা ফুটতে লাগলো দেখে আমি বললুম-“থাক থাক, আমিই নামছি।” এ আর এমন কি? আমি হলুম একদার ম্যাটারহর্নের অভিযাত্রী, আমি কি ডরাই কভু সামান্য কার্নিশে? কোমরে আঁচল জড়িয়ে এলোচুলে শক্ত করে ঝুঁটি বেঁধে আমি তো একসেকেণ্ডে রেডি। এবং স্টেডি। ‘গো’ বললেই নেমে পড়ব। কেবল যদি মেসোমশাই আঁচড়ে কামড়ে দেন তাই একটা কম্বল দেওয়া হোক, তাই সুদ্ধ ওকে জাপটে ধরব। বলবামাত্র দুপাশ থেকে গোঁ-গোঁ শব্দে আমাকেই সবেগে জাপটে ধরলো আমার দুই সাহসী কন্যা।–“না। মা নামবে না।” গালগলা ফুলিয়ে যত বোঝাই—“আরে মা কি যে সে? আমি হলুম গিয়ে…” তত তারা বলে—“না, মা যাবে না। মা পড়ে যাবে”। যত বলি—“সেই যে মনে নেই, সেবার যে রেইনওয়াটার পাইপ বেয়ে তিনতলায়”—মেয়ে বললে—“এ তো পাইপ নয়, এ কেলোহুলো। তোমাকে ঠেলে ফেলে দেবেই।’ কী করি? জ্যান্ত কাঁঠাল গাছের মতো নিরুপায় দাঁড়িয়ে রইলুম। দুহাত ধরে দুই মেয়ে ঝুলতে লাগলো। মেসোমশাই এখন খুব করুণ সুরে কান্নাকাটি করছেন। মাছের কাঁটা শুঁকেও দেখছেন না। মেসোমশায়ের লক্ষণ সত্যি ভালো নয়। কী করি? বসতবাড়ির ভেতর, এই বছরকার সময়ে, একটা জ্যান্ত জীবকে তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরতে দিতে পারি না। বাড়িতে পুঙ্গব বলতে তো কেবল শিবু আর রাঁধুনী। রাত দশটা বেজে গেছে। কোথায় যাই? কাকে পাই? হঠাৎ মনে হলো— আরে, পাড়াতেই তো রয়েছে—দমকল আপিস! সেদিনই কাগজে পড়েছি বেড়ালদের নাকি ভার্টিগো হয়, বম্বেতে একটা ফ্যাকটরীর ছাদ থেকে দমকল ডেকে বেড়াল নামাতে হয়েছে। শিবু দৌড়ালো দমকল আপিসে। ফিরলো মুখ হাঁড়ি করে।—“আপনি বলে দেখুন দিদি, আমি বললে আসবে না।”—“ওদের ফোন নম্বর?”
—“দিলো না”।
গভীর রাতে দমকল মেন অপিসের ফোন বেজে উঠলো। কাতর স্ত্রীকণ্ঠে অনুনয় এলো আপনাদের অমুক রাস্তার দমকল অফিসের ফোন নম্বরটা একটু দিতে পারেন দয়া করে?—“কোথায় আগুন লেগেছে”—“আগুন না, অন্য একটা বিশেষ জরুরী কাজে”-
—“কাজটা কী?”
—“মানে আমাদের কার্নিশে না, ইয়ে পড়ে গেছে”—
—“কে পড়ে গেছে। কোথায় পড়ে গেছে? দেখুন, জলে ডোবার কেস আমরা আর করি না ।”
(নেপথ্যে শিবুর আকুল উপদেশ–দিদি, বলুন পোষা, পোষা না বললে আসবে না)—জলে ডোবেনি, কার্নিশে পড়ে গেছে।”
—“কতবড় বাচ্চা?”
নেপথ্যে শিবু আকুল উপদেশ—“দিদি, বলুন, পোষা) “মানে,—ভীষণ পোষা কি না”।
—“কি বললেন ? পোষা বাচ্চা?”
— “বাচ্চা কে বললে? বেড়াল।”
—“দেখুন, এটা দমকলের অফিস। এটা বেড়াল ধরবার অফিস নয়”।
—“না না, সে তো বটেই, সে তো বটেই, আপনারা যে কত ব্যস্ত থাকেন তা কি জানি না? কিন্তু ধরুন, দুদিন ধরে এই বেড়ালটা, মানে বেজায় পোষা কিনা, একটা আন-অ্যাপ্রোচেবল কার্নিশে পড়ে আছে, আমরা উদ্ধার করতে পারছি না। এখন মরণদশায় এসেছে”—
—“খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু বেড়ালের জন্য দমকলকে ব্যস্ত করা উচিত নয়। মানুষ যদি পড়ে যেত, তা এক্ষুনি ছুটে যেতাম।”
—“কিন্তু অনা দেশে তো যায়। দমকলই তো যে—কোনো দুরবস্থায় একমাত্র উপায়।’
—“সে বিলেতের কথা ছাড়ুন মশাই। এটা বিলেত নয়।”
—”বিলেত কেন?—বম্বেতেই তো হয়। সেদিন কাগজ পড়েননি? একটা ছাদে উঠে একটা বেড়াল —শেষে পাড়ার লোকেরা দয়া করে দমকল ডেকে”—
—সে হয়তো চিমনি-টিমনি ব্লক করেছিল। দয়া-মায়া ছাড়াও কোনো জরুরী প্র্যাকটিক্যাল কারণ ছিল নিশ্চয়।”
—“দাদা, আপনারা একটু দয়াই করুন, হিন্দুবাড়িতে বেড়াল মারতে নেই, জানেন তো এতে খুব অলক্ষণ হয়, নিজেই নামতুম, মই নামিয়েছি, কিন্তু মেয়েরা কেঁদে খুন হচ্ছে, আমাকে নামতে দিচ্ছে না।’
—“দেখুন দিদি, এটা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এই কালীপুজোর মুখে, ধরুন কোথাও বিরাট একটা আগুন লাগলো, আর তখন আমাদের ছেলেরা আপনার কার্নিশে বেড়াল নামাচ্ছে—সেটা কি উচিত? কত কি এমার্জেন্সি হতে পারে এত বড় শহরে।’
—“মশাই, বম্বে কি মফঃস্বল শহর? লণ্ডন, নিউইয়র্ক কি পাড়াগাঁ ? তাদের দমকলরা যখন পারে…তাছাড়া আমাদের রাস্তার আপিসে তিন চারটে গাড়ি বসে থাকে, একসঙ্গে কখনোই সবকটাকে বেরুতে দেখিনি ইহজীবনে”
—“দমকল আপিসের রাস্তায় আপনার বাড়ি?”
—“একেবারে পাশেই”—
—তবে চলেই যান না? কিংবা ভাইটাই কাউকে পাঠিয়ে দিন।
—ভাই তো গিয়েছিল, ওরা বলেছে বড় অফিসের হুকুম চাই।
—দেখুন—আমার পক্ষে এমন একটা অর্ডার অফিশিয়ালি দেওয়া সম্বব নয়। আপনি জিজ্ঞেস করে দেখুন যদি পার্সোনালি একটা ফেভার করেন কেউ— ওঁদের ফোন নম্বরটা হচ্ছে—
—অজস্র ধন্যবাদ। অজস্র ধন্যবাদ।
—হ্যালো, এটা কি অমুক রাস্তার দমকল অফিস?
—হ্যাঁ। বলুন? আবার উপরের আলোচনার পুনরাবৃত্তি। এই অফিসারের কর্তব্যনিষ্ঠা আরো প্রগাঢ়।
—দেখুন, বেড়ালের জন্য আমি আমার ছেলেদের প্রাণসংকট করতে পারব না।
—ছি ছি, প্রাণ-সংকটের কথা ওঠে কেন? আগুন তো নয়—বিড়ালই তো। তায়…পোষা।
—দিদি, ধরুন, একটা ছেলে যদি পা ফসকে পড়ে যায়? মানুষ বাঁচাতে গিয়ে মরলে সেটার মানে হয়। তা বলে একটা তুচ্ছ বেড়ালের জন্যে।
—বালাই ষাট। মরবে কেন? কানিশটা বেশ চওড়া, তাছাড়া এতে শ্যাওলা ও নেই। কিন্তু বেড়ালকে তুচ্ছ বলা… (মেসোমশাই কা বস্তু তা তো আপনি জানেন না।)
—জানি জানি, পোষাপ্রাণী সন্তানতুল্য হয়ে যায়, কিন্তু একটা ছেলের যদি পাও মচকায়, আমি তো তারও রিস্ক নিতে পারি না? আপনিই বলুন, একটা বেড়ালের জনো…
এই শুনুন ! শুনতে পাচ্ছেন? মরণ কান্না? ইতিমধ্যে রিসিভারটা হেঁচড়ে জানলার ধারে নিয়ে গিয়েছি—ওই আর্তনাদ আর কতক্ষণ শুনবো বলুন দেখি? পাগল হয়ে যাচ্ছি তো।
—কী? শুনতে পাচ্ছেন?
—হা হা, শোনা যাচ্ছে বৈকি? আপনার অবস্থা আমি খুবই বুঝতে পারছি। কিন্তু…
—মশাই, ঝট করে কেউ দমকল ডাকে? মেয়ে হয়ে? এতো রাত্তিরে? শেষ পন্থা হিসেবেই না আপনাদের বিরক্ত করা? চোখের সামনে, ভিটের ওপর, ষষ্ঠীর জীবটা…
—দিদি, আমি, মানে, আপনি ঠিক বুঝছেন না। এর জন্যে অফিশিয়াল অর্ডার দেওয়া সব নয়—
—তবে আনঅফিশিয়ালিই দিন না? হিউম্যানিটারিয়ান গ্রাউণ্ডসে? আমিই তো নামছিলুম, নেহাত আমার মেয়েদুটো ভারি ভীতু, আর মা বেজায় নার্ভাস প্রকৃতির…নইলে আমি কখন তুলে ফেলতুম—ইতিমধ্যে আমার চোখে সত্যি জল এসেছে।
—খবরদার শাড়ি পড়ে নামতে যাবেন না, ভয়ানক রিস্কি।
—না নেমেই বা করব কি, আপনাদের ওখানে তো কোনো মহৎ প্রাণ, উদার হৃদয়, জীবৎসল তরুণ নেই, যিনি জীবে দয়া করে/
—সত্যি বলতে কি দিদি তেমন মহৎপ্রাণ, উদার হৃদয়, কি জীববৎসল কেউই হয় না আজকাল, তবু আমি বলে দেখছি, একবার, অবিশ্যি মনে হয় না, জীবে দয়ার দিনকাল কি আর আছে দিদি?
ইতিমধ্যে টেলিফোনে সজোরে কেলোহুলোর মরণ ক্রন্দন এবং আমার চাপা ফোঁসফোঁস স—অধীর হয়ে ও পক্ষ বললেন, ঠিক আছে, দিন তবু ঠিকানাটা একবার। কোন বাড়িটা? ওঃ, ও তো দু মিনিটের পথ।
মিনিট কুড়ি কেটে গেছে। রাত গভীর। ক্ষুধায় মরণাপন্ন মার্জার এখন প্রায় মানুষের গলায় একরকম শব্দ করে উঠছে। দমকল আসবে না বোঝা গেছে। আপত্তিরত মেয়েদের ঠেলে ফেলে দিয়ে কার্নিশে নামতে উদ্যত হয়েছি। মা বললেন, শাড়িটা নয়, বরং একটা পেন্টুলুন পরে নাম—
সেই পরম দৃশ্য দেখবার ভয়ে, এতক্ষণ জীবে দয়ায় যা হয়নি, তাই হলো। রাঁধুনী বামুন কাতরভাবে বলে উঠল—থাক থাক দিদি, আমিই নামছি।
কে বলে শিভালরির দিন গেছে? যেই না নামা, অমনি নাটকীয় টাইমিং-এ একটা দমকলের গাড়ি এসে থামলো৷ নিচে, সমবেত কণ্ঠের কলরব উঠলো -“লোক নেমেছে! লোক নেমেছে!”
—কম্বল জড়িয়ে জড়ভরত মেসোমশাইকে সদ্য তুলে দেওয়া হয়েছিল আমার কোলে ঠং ঠং করে হঠাৎ দমকলের ঘণ্টাটা বেজে গেল কেমন করে, আর দুদিন ধরে স্নায়ুতাড়িত হতবুদ্ধি মরণাপন্ন বেড়ালের তাতে কী যে হলো, সে তড়াক করে লম্বা দিয়ে উঠে কম্বল ভেদ করে বেরিয়ে ঝপাং করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়লো তিনতলার জানলা গলে অন্য এক সুদুরতর কার্নিশে। এবারে ঘরোয়া মইয়ের নাগাল ছড়িয়ে। ঘরে এবং রাস্তায় সমস্বরে হা হা রব উঠল— হায় হায়! গেল গেল! আবার গেল!
তারপর?
অবিলম্বে ঝুপঝাপ নেমে পড়লেন, একজন-দুজন নন, পাঁচ সাতজন স্মিতানন, মহৎপ্রাণ, উদারহৃদয়, জীববৎসল তরুণ কর্মী, ত্রিতল মই উঠে গেল উর্ধ্বপানে চক্ষের নিমেষে, রেডি, স্টেডি, তারপর সেই মৌল প্রশ্ন! কে উঠবে? এ তো আগুন নয়, এ যে…
ইতস্তত ভাব দেখে আমি বললুম—আমিই উঠে পড়ি বরং।
মুখ থেকে কথাটা পড়েছে কি না—পড়েছে অমনি ধড়ফড় করে উঠে গেছেন যে কেউ একজন। দোতলা পর্যন্ত। তারপর মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করলেন—আঁচড়ে-কামড়ে দেয় না তো?
বললুম—কি জানি, ভয়ানক নার্ভাস হয়ে আছে তো? বরং একটা মোটা তোয়ালে জড়িয়ে ধরাটাই সেফ হবে…
বলতে না বলতে ঝুল বারান্দাগুলো থেকে ঝপাঝপ দুচারটে টার্কিশ তোয়ালে পড়লো। ভদ্রলোক মই থেকেই কায়দা করে একটা লুফে নিয়ে ওপরে উঠলেন। এদিকে তেতলার কার্নিশের মতো বেড়ালোচিত স্থানে হঠাৎ মানুষ দেখে হুলোমশাই সন্দিগ্ধচিত্তে ছুটোছুটি শুরু করে দিলেন এ-মাথা থেকে ও- মাথা। সে কি উত্তেজনা। একেবারে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলার মতো। ক্রমাগত চিয়ার্স উঠছে রাস্তা থেকে। চললো বেড়ালে-মানুষে চোর পুলিশ খেলা। তারপরে —পড় পড় পড় পড়বি চাপা ধপ, ধর ধর ধর ধরবি হুলো খপ। পাড়া-ফাটানো হাততালির মধ্যে তখনি কপাস করে লোডশেডিং হয়ে গেল। অমনি চারিদিকে রব উঠলো সাবধান সাবধান! আর নিচে ঝলসে উঠলো পাঁচ-সাতটা জোরালো দমকলের টর্চলাইট।
অন্ধকারে দৈববাণীর মতো, শূন্য থেকে বিজয়গর্বে সমুজ্জ্বল কণ্ঠে উদ্ধারকর্তা ঘোষণা করলেন—ধরেছি দিদি, কিছু ভাববেন না, বাছাধনকে আপনার কোলে না দিয়ে আর ছাড়ছি না বাবা। হু হু।
ভীষণ ভয় পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি বললুম, থ্যাংক ইউ ভাই, ওকে বরং ওই গ্যারাজের ছাদটাতেই ছেড়ে দিন।
—মানে—তাই কখনো হয়? নামতে নামতে নায়ক বললেন—সে কাজটি আমি করছি না মশাই। রাস্তায় তখন মহতী জনসভা। রাত দেড়টা, তাতে কি হয়েছে? রিটায়ার্ড রিকশাওলা, বাড়িমুখো ভিখিরি, নিষ্কর্মা পাহারোলা, ব্যতিব্যস্ত কুকুর, ঝিমন্ত ষাঁড় ও রগুড়ে বাচ্চাবুড়োয় উঠোন ছাপিয়ে রাস্তা ভরপুর। প্রত্যেক বাড়ির বারান্দা ও জানালা থেকে মোমবাতির আলো উদ্বেগ এবং উপদেশ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সব বাচ্চারা ফ্রীডম পেয়ে গেছে জেগে ওঠার, পাখি ডাকার মতো কলরব হচ্ছে। এরই মধ্যে হঠাৎ এতক্ষণ পরে, চোখ কচলাতে কচলাতে আবির্ভূত হলেন আমাদের নতুন প্রতিবেশী ব্যোমকেশবাবু। ব্যাপারটা টের পেয়েই তিনি ঘুমভাঙা ভারী গলায় বলে উঠলেন, —ও বুঝেছি, এ সেই প্রকাণ্ড ভয়ংকর, কালো কুচকুচে..।
আর যায় কোথায়? আমি মরিয়া হয়ে তৎক্ষণাৎ ব্যোমকেশবাবুর আধাঘুমন্ত বাঁ-হাতখানা খামচে ধরেছি, আর সঙ্গে সঙ্গে বিষম জোরে কেটেছি এক রামচিমটি। আমি তো জানি কী সর্বনেশে বাক্য উনি উচ্চারণ করতে চলেছেন—সেই…কালো কুচকুচে অতি বদরাগী, হামলাবাজ, বেজায় পাজি হুলোটা? যেটা রোজ আমাদের মাছ দুধ খেয়ে যাচ্ছে? –
—না, সেই বাক্যটি এই মুহূর্তে, এই পবিত্র জীবে-দয়ার পটভূমিতে, ওঁকে বলতে দেওয়া অসম্ভব। সেই সর্বহারা নিঃসীম অন্ধকারে, চরাচরব্যাপী বেনিয়মের মধ্যে, দমকলের তিনতলা জোড়া স্বর্গের সিঁড়ির নীচে, এ হেন আশাতীত অত্যাকস্মিক আক্রমণে ব্যোমকেশবাবু দিশাহারা হয়ে পড়লেন। যে-কোনো কারণেই হোক, তার আর বাক্যস্ফুর্তি হলো না।
বেড়াল বগলে নেমে এসে হাস্যবদন হিরো বললেন— ধরুন দিদি। আপনার সাধের পুষি। ব্যাটাকে দুদিন ধরে বন্ধ করে রাখুন দিকি, আবার না পালায়।
চোরের মতে শেষ চেষ্টায় বললুম— একে উঠোনেই ছেড়ে দিন না।
—পাগল হয়েছেন? ফের কোন স্বর্গ রাজ্যে লাফ মারবে, ফের পাড়াসুদ্ধ তোলপাড়? নিন ধরুন আপনার দস্যি ছেলে।
টার্কিশ-তোয়ালে জড়ানো সদ্যোজাত সন্তানকে যেমন বাড়িয়ে দেন ওস্তাদ ডাক্তার, আর অনভ্যস্ত হাত বাড়িয়ে যেমন তাকে সন্তর্পণে গ্রহণ করেন অতি নার্ভাস নবীন পিতা–তেমনি সন্ত্রস্ত হৃদয়ে বাঘের মেসো হুলোমশাইকে যথাসাধ্য কৃতজ্ঞ মুখে আমি সভয়ে বুকে সাপটে ধরলুম। পারফেকট টাইমিং দিয়ে এই সময়েই ইলেকট্রিসিটি ফিরল। হৈ-হৈ করে উঠল উপস্থিত পাবলিক। আর আমি ছুট লাগালুম। ইচ্ছে, উঠোনের কোণটা ঘুরেই মেসোকে পথে ছেড়ে দেব, লোকচক্ষুর অন্তরালে।
ব্যোমকেশবাবুর দিকে চাইবার সাহস ছিল না, তার সঙ্গে আমার এখনও ফর্মাল পরিচয় হয়নি, সবেমাত্র এ-পাড়ায় এসেছেন ওঁরা। ছুট তো লাগিয়েছি, কিন্তু তোয়ালের ভেতরে মঁসিয়ো হুলো তখন টাইফুনের মতো উত্তাল ফুঁসছেন, কোণটা ঘুরতেই তোয়ালে ভেদ করে নখদসমেত নিষ্ক্রান্ত হলেন এবং সবলে আমার হাতে আঁচড়ে এবং কামড়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে নেমে মুহূর্তেই অদৃশ্য।
হাত থেকে বুজিয়ে রক্ত পড়ছে— সে লজ্জা মোটা তোয়ালেতে লুকিয়ে ফেলে কনুই পর্যন্ত জড়িয়ে বেড়ালের মতো করে ধরে একগাল কৃতার্থ হেসে অশ্রুছলছল চক্ষে আমি ভাগ্যক্রমে এ দৃশ্য দেখতে না পাওয়া সরলমতি দমকল বাহিনীকে কৃতজ্ঞ কান্নায় গদগদ গলায় তখন বলছি —“আপনারা এই অবেলা প্রাণীর জন্যে যা করলেন, এর জন্যে ঈশ্বর আপনাদের শত গুণ করে”…বলতে বলতে হাতের যন্ত্রণায়া ও চোখের জলে আমার বাক্যরোধ হয়ে গেল।
রীতিমতো টাচড হয়ে তরুণটি বললেন—“ছিছি, এজন্যে ধন্যবাদের কি আছে দিদি, গেরস্থঘরের পুষ্যি, সে তো ছেলেপুলেরই সমান।”
—ঠং ঠং করে ঘন্টা বেজে গেল, ঝটপট গাড়িতে লাফিয়ে উঠলেন উদারহৃদয়, মহাপ্রাণ, জীববৎসল তরুণের দল, লাল টুকটুকে পক্ষীরাজটি যেন উড়ে বেরিয়ে গেল একগাড়ি সত্যিকারের রাজপুত্র পিঠে নিয়ে।
হুলোমশাই তখন পাশের বাড়ির পাঁচিলে বসে কৃতজ্ঞচিত্তে গোঁফে তা দিচ্ছেন। আর ব্যোমকেশবাবু? তখনও হতবাক, মধ্যরাত্রের ফাঁকা উঠোনে, একা। বাঁ হাতের ফুলো জায়গায় ডানহাত বোলাতে বোলাতে অতি বিচিত্র দৃষ্টিতে একবার হুলোমশাইকে আর একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। তার সেই অভিব্যক্তির কাছে মার্সেল মার্সোর মুকাভিনয়ও নস্যি।
অনেকগুলো ইনজেকশন নিতে হয়েছিলো আমায়। পোষাপ্রাণীটির মায়ার চিহ্ন এখনও হাতের মাংসে বিদ্যমান। আর সেই থেকে কেন জানি না হুলোমশাইও যেমন, ব্যোমকেশবাবুও তেমন আমাদের বাড়িটাকে বিষবৎ পরিহার করে চলেন, অথচ ঈশ্বরের সেবায় সেই একবারই মাত্র লেগেছিলুম আমি।
[নীতিকথা : দমকলকে অকারণে বিরক্ত করবেন না। করলে হাতে-নাতে তার প্রতিফল পাবেন। ধর্মের কল’ ইত্যাদি মনে থাকে যেন]।