তুলাইপাঞ্জি চালের শহর রায়গঞ্জে ক্যারিটাস মিশন প্রাঙ্গণে হয়ে গেল জৈব কৃষি বিপণন হাট ২৩ এবং ২৪ শে মার্চ। এই হাটের আয়োজক ছিলেন রায়গঞ্জের ফোরাম ফর ইন্ডিজেনাস এগ্রিকালচারাল মুভমেন্ট, ক্লাইমেট থিংঙ্কার ও কে পি এম জি। যোগ দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্য রাজ্যের বেশ কিছু কৃষক সংগঠন। হরিয়ানার লালু সনপ্রীত নিয়ে এসেছিলেন বিভিন্ন সবজির বীজ। তিনি নিজে প্রায় ৮০ রকমের লাউয়ের জাত সংরক্ষণ করেন এবং এ পর্যন্ত তিনি ছয় বছরে এক লাখের বেশি কিলোমিটার ভ্রমণ করেছেন। একটি লাউ লম্বায় ৬ ফুট আবার ৩ ইঞ্চি লাউ আছে। কৃষকদের মধ্যে তিনি বীজ বিতরণ করেছেন এবং সংগ্রহ করেছেন। এসেছেন সুরেশ পূজারী কর্নাটকের উলিপি থেকে। তিনি প্রায় আড়াইশো রকমের দেশি ধানের জাত সংরক্ষণ করেন এবং কৃষকদের মধ্যে বীজ বিনিময় করেন, এখানেও বীজ বিনিময় করলেন। পশ্চিমবঙ্গের ফোরাম ফর ইন্ডিজেনাস এগ্রিকালচারাল মুভমেন্ট তাদের খামারে ও তাদের কৃষকদের কাছে ৫০০ দেশি ধান সংরক্ষণ করেন, ১০ রকমের আলু, লাল আলু, বাদাম আলু, ঠিকরে আলু, নীল আলু, কালো রঙের গম সহ পাঁচ রকমের গম, চার রকম বিভিন্ন মিলেট, বিভিন্ন ডাল ও বিভিন্ন দেশজ সবজি সংরক্ষণ করেন। রায়গঞ্জ শহরে তাদের নিজস্ব দোকান ঘর চাষীঘর থেকে প্রায় ৫ রকমের চাল — তুলাইপাঞ্জি, কাটারিভোগ, কালো নুনিয়া, রাধা তিলক, বাঁশফুল, হেতুমারি লাল চাল, শম্পামাশুরি, চমৎকার, বহুরুপী চাল, রাধাতিলকের সুগন্ধ খই, পারিজাত চালের মুড়ি, চিড়ে, গুড়, মধু, পনির, চকুই, জৈব উপায়ে উৎপাদিত বিভিন্ন সবজি — বিগোরের বেগুন বিক্রি করে থাকে। এই সংগঠনটি ২০১০ সালে শুরু হয়। সেখান থেকে আজকে রায়গঞ্জ শহরে খুবই জনপ্রিয় একটি জৈব বিপণী হয়ে উঠেছে। কর্ণধার ডক্টর চিন্ময় দাস এবং তাঁর সহযোগীরা উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছেন। মেলার কদিন খাওয়া দাওয়া ছিল সম্পূর্ণ জৈব। হেতুমারি লাল চাল ও সাদা কাটারিভোগ চালের ভাত, বাদাম আলুর দম, কালাভাত চালের পায়েশ ইত্যাদি সবাই উপভোগ করেছেন।
মেলার উদ্বোধন করেন উত্তর দিনাজপুর জেলার উপকৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) শ্রী প্রিয়নাথ দাস মহাশয় তিনি তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন যে এই ধরনের মেলা খুবই অভিনব এবং এর প্রয়োজন আছে। এই ধরনের মেলাকে তিনি উৎসাহিত করছেন। মানুষের মধ্যে এখন সচেতনতা বেড়েছে তাই জৈব উপায়ে উৎপাদিত ফসলের প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। বিশিষ্ট দেশী ধান বিশেষজ্ঞ, জৈব কৃষির প্রবক্তা ও প্রাক্তন অতিরিক্ত কৃষি অধিকর্তা ড. অনুপম পাল দেশজ ফসলের উৎপাদনশীলতার কথা বলেন যা রাসায়নিক কৃষির সমান অথচ কম খরচের এবং পরিবেশ বান্ধব। মেলায় জেলার অনান্য কৃষি আধিকারিকরা ছিলেন। ড. সৃজন হালদার হাতে কলমে দেখালেন জীবানু সার কত সহজে তৈরী করা যায়।
বাঁকুড়ার সিমলিপাল থেকে মহিলা গোষ্ঠির শ্যামলী ষন্নীগ্রাহী এসেছিলেন অভিনব গড়গড়ি পিঠে ও কাখরা পিঠের সম্ভার নিয়ে। ওখানেই তাঁরা পিঠে তৈরী করেছেন। চালের গুড়ো সিদ্ধ করে নিয়ে লেচি করে তার মধ্যে খিরের পুর দিয়ে আবার গরম জলে সিদ্ধ করা হয়। ভেসে উঠার পর নামিয়ে নেওয়া হয়। উল্লেখ্য ওই পিঠের জন্য জি আই রেজিস্টেরসন দাখিল করা হয়েছে।
বাঁকুড়ার পাঁচালের অন্নপুর্ণা ভান্ডার নিয়ে এসেছিলেন শ্রীমতি শ্যামলী সাইনি। ষাটিয়া লাল চালের চিড়ে ও চাল, মিলেটের আটা, মাল্টি গ্রেন আটা, তিল, মিলেটের লাড্ডু, গোবিন্দভোগ চাল, লাল সরু লাজনি সুপার চাল, কনকচূড় খই ইত্যাদি। মেদিনীপুরের হরিপদ দলুই নিয়ে এসেছিলেন পান থেকে পানীয়। শুকনো পান পাতার মুখসুদ্ধি, গরম জলে পাতা দিলেই চা। গুটখার বদলে পান।
শিলিগুড়ির বুরলোগ ভিসন চা, গরু বাথান আদা, স্কোয়াস, কালোনুনিয়া চাল ইত্যাদি বিক্রি করেছেন। সুন্দরবনের জোগেশগঞ্জের পশ্চিম শ্রীধরকাটি জনকল্যান সংঘের উমাপতি সরকার ও তার সহযোগীরা নিয়ে এসেছিলেন কালাভাত, কর্পুরক্রান্তি, লীলাবতি, চীনাকামিনী ও কনকচূড় চাল, ছিল সুন্দরবনের মধু।
কলকাতার পৌস্টিক লাইফ মিলেটের নানা সম্ভার নিয়ে এসেছিলেন। কেক, বিস্কুট, পাস্তা, নুডুলস ইত্যাদি। জৈব কৃষি ও সুস্থায়ী কৃষির বেশ কিছু বই ছিল।
ব্যারাকপুরের ফোরেজ ইনিসিয়েটিভের স্বর্নেন্দু সরকার ১০ রকমের প্রাকৃতিক মধু, মধুর নানা প্রসাধনী দ্রব্য নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া আরো বেশ কিছু স্টল ছিল — পুরুলিয়ার শবরদের তৈরী কাশের টুপি, ফল রাখার পাত্র। হাতের তৈরী সাবান, গায়ে মাখা সাবান, শ্যম্পু, বাঁশের টুথব্রাশ, ভেষজ প্রসাধনী দ্রব্য, ধূপ, মশা তাড়ানোর উপাদান যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিল। কলকাতার থেকে এসেছিলেন কয়েক জন জৈব কৃষির ক্রেতা। সন্ধ্যায় সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। রায়গঞ্জ শহরে এই ধরনের উদ্যোগ এই প্রথম। ভিড় ছিল বেশ ভালোই। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে।