২২২ নং কিস্তি
ভিকি একবার ওর মায়ের মুখের দিকে একবার আমার দিকে তাকাল।
দেখছিস তোর ছেলে আমার দিকে কেমন ভাবে তাকাচ্ছে।
তাকাক, নাক টিপলে দুধ পরে, ও কি করবে গো।
বিনোদ এসেছে।
বড়ো ভাল মানুষ গো।
ওঠো ওঠো আগে। খালি ফর ফর। অরিত্র কবিতার হাত চেপে ধরেছে।
কেনরে আমি কি ভুল বকলুম?
না তুমি ঠিক বকেছো।
অর্ক আমার দিকে টেরিয়ে টেরিয়ে হাসছে।
তোমাকে অনিমামা একটা থাপ্পর মেরেছিল, মেরে আধমরা করে দিলে ভাল করতো। ভিকি গরগর করে উঠলো।
দেখছো দেখছো কথার ছিরি দেখছো। কবিতা বলে উঠলো।
বাচ্চা ছেলে সবে বিয়ে করেছে। বাসন্তীও দেখতে শুনতে খারাপ নয়। এখন উড়ছে বুঝলি। তোর মতো বয়স হলে ঘরে ঢুকে পরবে।
আমার কথার থ্রোয়িং-এ সকলে হেসে উঠলো।
কবিতা তার মধ্যেই চেঁচিয়ে উঠলো। তবে।
তোর বুদ্ধির কাছে ওরা ঝামা।
মানতেই চায় না। বলে বড়ো দাদা হয়ে গেছি।
তুমি এখন ওঠো না। বিকেলের দিকে অনিদার মাথাটা টিপতে টিপতে পেট খোলসা করে গল্প করবে। অরিত্র জোর করে কবিতাকে টেনে তুললো।
কনিষ্করা হাসছে।
কিরে অরিত্র, ছিপ ফেলা হয়েগেছে? কনিষ্ক বললো।
ছিপ ফেলা হয়ে গেছে মানে, দু-একাট মাছও তুলে নিয়েছে।
মিত্রা, তনু, মিলি একযোগে সকলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
দাবাটা রিয়েলি ভাল খেলে। অরিত্র তাকিয়েছে কনিষ্কদের দিকে।
কনিষ্ক, বটা ফুলে ফুলে হাসছে।
ছকবাজির মাস্টার। অর্ক বললো।
কবিতা আমার পায়ের কাছ থেকে উঠে গিয়ে মাসির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মাসি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
সুমন্তকে দেখলাম ঘরের চারিদাকটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আমরা যে এই ঘরে বসে এতজন কথা বলছি, ওর যেন খেয়ালি নেই। যেন এই ঘরে ও একা।
কিরে সুমন্ত? আমি বললাম।
দেখছি।
অর্ক হাসছে। সুমন্ত গম্ভীর ভাবে অর্কর দিকে তাকাল।
কি দেখছিস? আমি বললাম।
তোমার বাড়ির থেকে আমার বাড়ির ভ্যালুয়েসন বেশি।
হাসলাম।
অর্কদাকে জিজ্ঞাসা করো, ঢুকতেই বলেছি, সব দিয়ে দিয়েছি, ভিটে টুকু শুধু রেখেছি, মাটির দেওয়াল ভেঙে ইঁট গেঁথেছি। আর টালি এ্যাসবেসটর লাগিয়েছি। দুটো তাঁতের মেসিন এখনো অক্ষত রেখেছি, বেঁচে থাকলে ছেলের বিয়ের সময় প্রেজেন্ট করবো।
আমি সুমন্তর দিকে তাকিয়ে আছি।
তোমারটা এখনো মাটির দেওয়াল, খরের চাল। টঙে দু-একটা খোলা (টালি) চাপান।
তাহলে তোমার থেকে আমি অবস্থাপন্ন নয়?
অরিত্র হাসছে।
একবারে ইন্ডিয়ান সিস্টেম, ওয়েস্টার্নের কোন নাম গন্ধ নেই। অর্ক বললো।
যতোই হোক ভারতীয় তায় আবার বাংলার এক অঝ্ঝর গাঁয়ের মানুষ, বিদেশী ব্যাপারটা ঠিক পোষায় না। সুমন্ত বললো।
আমি মুচকি মুচকি হাসছি।
তোদের কথা ও ঠিক বুঝছে তাই না? কনিষ্ক বললো।
বুঝছে মানে পুরো খুশবু নিচ্ছে। চোখ-মুখ দেখছো কুতকুত করছে। অর্ক বললো।
ম্যাডামকে কাদামাটির তাল পেয়েছিল, যতবার ইচ্ছে নিজের মতো করে পুতুল গড়ে নিয়েছে। অরিত্র বলছে আর হাসছে।
আমি অরিত্রর দিকে তাকালাম।
তাকিয়ে লাভ নেই। তুমিও জান, আমরাও জানি। সন্দীপদা তোমার তৃতীয় পক্ষ ওর ঘটে এসব আসবে না।
মিত্রা, তনু দুজনে হো হো করে হেসে উঠলো।
দাঁড়া কালকেই তোর সিএল খাব। সন্দীপ তাকাল অরিত্রর দিকে।
মাল পাবে না। কোনটা ফার্স্ট প্রেফারেন্স মাল না সিএল ?
মাল।
মিলিরা হাসছে।
সন্দীপদা তুমি না….। মিলি বললো।
জানো না মিলি দুটো একবারে অনির কার্বন কপি। ঘাঁটালে বিপদ আছে। দেখলে না, ঘরে ঢুকেই ম্যাডামকে সরিয়ে দিয়ে দুজনে দুপাশে কিরকম সেঁটে গেল।
অর্কদা খেতে বসবে চলো, না হলে ওপাশে যেতে দেরি হয়ে যাবে।
নীপা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই তরবর করে বলে গেল।
আমার দিকে তাকাল।
সব ঘরের এক কোনায় জরো করে রাখছি। আছাড় মেরে যখন কাচব বুঝতে পারবে।
নীপা খ্যাড় খ্যাড় করছে। সন্দীপ হাসছে। আমি সন্দীপের দিকে তাকালাম।
বৌ রেখে এসেছিস না সঙ্গে নিয়ে এসেছিস।
অরিত্র জোড়ে হেসে উঠলো।
সায়ন্তন, দ্বীপায়নদা ছাড়া সবাই ল্যংবোট নিয়ে এসেছি। অরিত্র বললো।
দিন, রাত্রি, বিকেল সব?
এই হ্যাজাতে শুরু করলে। বৃষ্টিকে ডাকি।
এখন থাক।
এখন থাক কেন?
সুমন্তর মতো অষ্টম আশ্চর্যের সন্ধান পেয়েছে। রসভঙ্গ করবি কেন। তার থেকে বরং নীপা ডাকতে এসেছে, আগে ডানহাতের কাজটা সেরে নে।
সুমন্ত তুই সমেত সকলকে ময়দা ঠেসে দিল।
ঠাসতে দে। এখনো হাতড়াচ্ছে। খুঁজে পাচ্ছে না।
কনিষ্ক, বটা মুখ টিপে হাসছে।
বুঝলি অরিত্রদা অপনেন্টের চাল যদি ঠিক ঠিক ধরতে পারা যায়, খেলে মজা। সুমন্ত বললো।
মিত্রা, তনু আবার হেসে উঠলো।
ম্যাডাম এবার কিছুটা গেইজ করেছেন। অর্ক বললো।
মিত্রা মাথা দোলাচ্ছে।
আমি হাসলাম। খুব গুরুতর একটা ঘোটালা মনে হচ্ছে।
অরিত্র জড়িয়ে ধরলো।
ভেতরে আয় একবার মুখটা দেখিয়ে যা। নেপলা বললো।
আবার কে? নেপলার মুখের দিকে তাকালাম।
সব আগে থেকে জেনে ফেলবে সেরকম কোনও কথা আছে নাকি। সুমন্ত বললো।
নেপলার দিকে তাকাল।
কিগো নেপলাদা ঠিক বললাম কিনা বলো।
ঘরে আর জায়গা নেই। আমি বললাম।
সবাই কম বেশি আমার কথায় হাসাহাসি করছে।
যদি হও সুজন তেঁতুল পাতায় নজন। সুমন্ত বললো।
আজ খুব ডায়লগ মারছিস। আমি বললাম।
সায়ন্তনদা ছবিগুলো জুম করে পোর্টেটে মারবে এক্সপ্রেসনটা যেন ক্লিয়ার হয়। কাজে লাগাব। সুমন্ত রিপিট করলো।
অর্ক-অরিত্র হাসছে।
আমি নেপলার মুখের দিকে তাকালাম।
কে?
দেখো চিনতে পার কিনা ?
শিমুল এসে ঘরে দাঁড়াল।
তুই!
ক্যান আমি নেপলাদা, সাগিরভাই, অবতারভাইরে কইসি। আমি দাদার বাসায় একবার যামু।
ঘরে একটা চাপা হাসির শব্দ।
শিমুল এসে কোমড় নুইয়েছে।
কবে এলি?
কাইল দুফুরের ফ্লাইটে আইসি।
বাংলাদেশ না দুবাই?
বাংলাদেশ।
ম্যাডাম নিশ্চই চিনতে পারছো না। নেপলা মিত্রার দিকে তাকাল।
মিত্রা চোখ দিয়ে বললো, না।
নেপলাদা এককেবারে গাঁজা মারবা না।
শিমুল হাসছে। শিমুলের কথায় সকলে হাসছে।
সেই যে সরবৎ কেশ, নুন নেই, পয়সা নেই।
এবার ঘরের সকলে হৈ হৈ করে হেসে উঠলো।
মিলি হাসতে হাসতে কনিষ্কর পাশে থপাস করে বসে পরলো।
তুমি সুগন্ধি সারসো। শিমুল তাকিয়েছে নেপলার দিকে।
নেপলা হাসছে।
তোমাগো গুলান কইতি পার নাই।
শিমুল আমার দিকে তাকাল। নিজেও হেসে চলেছে।
অনিদা এগুলান কেমনে হইল।
নেপলাদাকে ধরে মার।
শিমুল মিত্রার কাছে গিয়ে পা ছুঁতে চাইল।
মিত্রা হাসতে হাসতেই ওর হাতটা ধরলো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তুমি আমাকে চেন।
হ। ছবি দেখসি।
আর একজন।
উনি। শিমুল তাকিয়েছে তনুর দিকে।
তনু শিমুলকে দেখে মুচকি মুচকি হাসে।
অনিদা এনারে হাসে ক্যান।
তুই ঠিক করে বাংলাটা বল।
আমি কঠিন করে কইতাসি না।
ও বাবা তুমি আরও কঠিন করে বলতে পার। মিলি বললো।
হ পারি। চাটগাঁইয়া কইলে আপনাগো বোঝনের খ্যামতা নাই।
হাসাহাসি চলছেই।
ওনাদের চিনাও।
অদিতি, ইসি হেসে ঢলা ঢলি শুরু করে দিয়েছে।
নেপলাকে বল।
শিমুল নেপলার দিকে তাকাল।
আকাইটটা মজা নাও।
সাগিরকে ডাকি।
হ ডাকো।
শিমুল মিত্রার দিকে তাকাল।
সব আল্লাহর ইছছা। ওই ঘটনা ঘটন না হলি দাদাকে পাইতাম না। অখনো রাস্তায় দাঁড়াইয়া রস বেইচতুম।
শিমুল মাথা নীচু করে নিল।
দাদা ঘর দিসে, সংসার দিসে, দাদার জন্য আব্বা-আম্মিকে দু-বেলা দু-মুঠান ভাল খাওন দিতি পারি, পরতি দিতি পারি।
খেয়েছিস। শিমুলের দিকে তাকালাম।
অহন খামু।
অর্কদের সঙ্গে তোর পরিচয় হয়েছে।
হইছে।
ছ বললি না স বললি।
টিপবা না।
তাহলে ঠিক করে বাংলাটা বল।
বলসি তো। মাঝে মাঝে বাইরোয়ে যায়।
শিমুল আবার মিত্রার দিকে তাকাল।
আপনাগো কতো কথা শুনি। একবার দেখনের ইছছা ছিল আল্লাহ আইজ সে ইছছা পূরণ করছে। নেপলাদা, সাগিরদা….।
চল খেয়ে নিবি চল।
আমি দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।
তোর গিয়ে লাভ কি, ওরা বরং যাক। তুই বোস। কনিষ্ক বললো।
অর্ক হাসছে।
যা তোরা তাহলে খেয়ে আয়। নীপা।
বলো।
নীপার দিকে তাকালাম।
একটু চা খাওয়াবে।
তার মানে! কতক্ষণ আগে ভাত খেয়েছো।
ঘণ্টা খানেক।
হবে না।
ঠিক আছে তোমাকে করতে হবে না। মাসি দেবে।
চা খাবার একটা সময় আছে।
দামিনীমাসি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
দ্বীপায়ন, যাও খেয়ে নাও। এরপর অবেলা হয়ে যাবে। তারপর বসে সব শোনা যাবে।
ওরা একে একে সব উঠলো।
ম্যাডাম আপনি একটু শুনুন। অর্ক গেটের মুখে দাঁড়িয়ে ডাকল।
মিত্রা এগিয়ে গেল।
আমি আবার খাটে একাশি হয়ে শুলাম।
কনিষ্ক আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে।
ওমনি মাথাটা চক্কর কাটতে শুরু করলো।
না।
না বললে হবে, তোর চোখ বলছে।
মিলি, টিনা আমার দিকে তাকিয়ে।
মিত্রা ঘরে ঢুকে আমার পাশে এসে বসলো। তনু, নীরু আমার পায়ের কাছে।
কি হয়েছে! মিত্রা কনিষ্কর দিকে তাকাল।
যা হয়। এতো লোকজন একসঙ্গে দেখা অভ্যেস নেই, বদহজম।
অনি কোথায়গো দামিনী। নীচে বড়োমার গলা পেলাম।
ওপরে।
একবার ছোটোকে সুতপাকে ডেকে দাও।
খেয়েছে এবার আর একপ্রস্থ শুরু হবে। মিলি বললো।
আমি মিত্রার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
কিছুক্ষণ পরেই মিত্রার নাম ধরে বড়োমা নিচ থেকে চেঁচাল। মিত্রা।
বলো।
একবার নীচে এসে সোনাকে আর দিদিদের ধর।
মিলি, তনু, ইসি বেরিয়ে গেল। মিত্রা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
হাসির অর্থ, কেমন মজা দেখ।
বড়োমা, মাসিমনি, সোনাআন্টি, জ্যেঠিমনি ঘরে ঢুকলো।
ও বাবা তোরাও আছিস। বড়োমা কনিষ্কর দিকে তাকাল।
শোয়া আর হলো না।
যা বলতে বলেছিলাম বলেছিস। বড়োমা মিত্রার দিকে তাকাল।
এখনো সময় পাই নি।
মিত্রা এপাশে এসে বোস। দিদি তুমি ওর মুখের দোরগোড়ায় বসো।
বড়োমা মাসিমনির দিকে তাকাল। মাসিমনি হাসছে।
আমরা তিনজন খাটে বসি।
কনিষ্ক সরে বসে জায়গা করে দিল।
আমি বড়োমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
যুদ্ধ করবে নাকি।
না। তোর সঙ্গে দুটো কথা বলবো।
এখন ঘুম পাচ্ছে।
রাতে ঘুমস।
হবে না।
হবে না বললে চলবে না।
বড়োমা আমার মাথার কাছে বসলো। আমি বালিস থেকে মাথাটা তুলে বড়োমার কোলে গুঁজে দিলাম। সোনাআন্টি আমার পেটের কাছে জ্যেঠিমনি তার পাশে।
আমি নড়েচরে খাটের কোনাকুনি শুলাম।
তিনজেনের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।
প্রথমে গুলি চালাবে, না কামান দাগবে।
জ্যেঠিমনি হাসলো।
কোনোটাই করবো না। দিদি তুমি শুরু করো।
বড়োমা মাসীমনির দিকে তাকাল।
মাথার চুলগুলো একটু টানো তো, বড্ড টিপ টিপ করছে।
বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম। স্নেহ মাখা চোখে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আমার মুখমন্ডলে কুয়াশার মতো ঝড়ে পরছে।
আগে দিদির প্রশ্নের উত্তর দে। তারপর টিপে দিচ্ছি।
তুমি টিপতে শুরু করো আমি মাসিমনির প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।
তনু, ছোটো, সুতপা আর ডাক্তারকে আসতে বলতো।
বড়োমা তনুর দিকে তাকাল।
আর কেউ যেন না আসে।
তনু দরজার দিকে এগোল।
ফোন কর না যেতে হবে কেন। মিত্রা বললো।
তনু ফোন করার আগেই ছোটোমার গলা নিচে পেলাম।
তোমরা কি সব ওপরে আছো।
হ্যাঁ। কথাটা বলেই তনু বড়োমার মুখের দিকে তাকাল।
ডাক্তার এলো কিনা দেখ।
তনু বেরিয়ে গেল।
কোথায় যাচ্ছিস।
ছোটোমার গলা পেলাম, মনে হয় শিঁড়িতে ধাক্কা খেয়েছে।
ডাক্তারদাকে ডাকতে।
যেতে হবে না সবাই আসছে।
ছোটোমা ঘরে ঢুকেই আমাকে এই অবস্থায় দেখেই মিত্রার দিকে তাকাল।
তেল চালু।
সুবিধা হচ্ছে না।
ছোটোমা মুখ টিপে হাসল।
আমি একবার বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম। বড়োমা ছোটোমার দিকে তাকিয়ে ইসারা করছে।
আমি হেসেফেললাম।
কনিষ্ক তোরা থাকবি না বেরবি। ছোটোমা বললো।
কেন বলো।
তোরা যদি থাকিস নিচে মাদুর পেতে বোস। সোফায় ওরা সবাই বসুক।
সবাই আসছে নাকি! আমি বললাম।
হ্যাঁ।
দম বন্ধ হয়ে যাবে।
কিচ্ছু হবে না।
মিলি উঠে মাদুর পাততে শুরু করেছে।
বৌদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
বুঝলে বড়োমা। আমি বললাম।
বল।
তোমাদের অবস্থা দেখে আমার একটা গল্প মনে পরে যাচ্ছে।
আর গল্প বলতে হবে না।
আরে শোনই না।
না।
গল্পেও অরুচি।
তুই ফাঁক কাটার তাল করবি।
গল্পটা শুনলে তোমরা যা প্রশ্ন করতে চাইছো তার উত্তর পেয়ে যাবে।
মাসীমনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তনু, মিত্রা, ইসি খাটে এসে আমার পেছনে নিজেদের গুঁজে দিল।
তোরা এখানে এলি কেন? বড়োমা বললো।
নিচে জায়গা হবে না, তাই। মিত্রা বললো।
খোঁচা খুঁচি করবি না। আগেই বলে দিচ্ছি। আমি বললাম।
তোর গল্পগুলো ভাল করে শুনতে হবে। সকাল থেকে কনটিনিউ গল্প বলে যাচ্ছিস।
এই তোরা শুরু করলি। বড়োমা খিঁচিয়ে উঠলো।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর কথা বলবো না। মিত্রা বললো
মাসীমনি বলো কি বলছিলে। আমি বললাম।
মাসীমনির দিকে তাকালাম।
কলকাতায় আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। ভাবছি এখানে থাকবো।
তার জন্য এতো আয়োজন! আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মনে হয় তুমি ঠিক গুছিয়ে শুরু করতে পারলে না। ঝুনো নারকেলকে ডাকো। রসিয়ে বসিয়ে শুরুটা বেশ করে।
বৌদি সোফায় বসেছিল। তেরে এলো কানটা ধরতে।
কনিষ্করা হেসে ফেললো।
বড়োমা বৌদির হাতটা ধরলো।
থাক সুতপা আজ তোরা কেউ কান ধরিস না। আমি ধরবো।
আমি বড়োমার আঁচলটা টেনে নিয়ে কান ঢাকলাম।
তোমার জন্য।
আজ পালাতে পারবে না আমি বলছি।
বড়োমার কোলে মাথা গুঁজে হেসেই চলেছি।
অনিমেষদারা একে একে ঘরে এলো। আমায় ওই অবস্থায় দেখে মুচকি হাসলো।
সুতপা। শেল্টারটা ঠিক জায়গায় নিয়েছে বলো। অনিমেষদা বললো।
এখুনি রুমাদিকে বলেছে। তুমি শুরুটা ঠিক করতে পারলে না। ঝুনানারিকেলকে ডাকো।
অনিমেষদা হাসতে হাসতে সোফায় গা এলিয়ে দিল।
অনি প্রস্তাবনাটা ভালই করেছে কি বলুন সামন্তদা।
ডাক্তারদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
আফতাবভাই-এর দিকে তাকালাম।
মুচকি মুচকি হাসছে।
মেয়ের বাপের সঙ্গে পাকা কথা সারলে।
হ্যাঁরে শয়তান। দিদি চেঁচিয়ে উঠলো।
বাবাঃ কয়েক ঘণ্টায় তুমিও বেশ টুকটাক কথা বলতে শিখে গেছ।
সবাই যে যার মতো ফাঁকা জায়গায় বসলো।
অনিমেষদা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কেন তুই চাস না। মাসীমনি বললো।
ওদের আর একটু সময় দাও।
বিয়ে তো এখুনি হচ্ছে না। বসিরের ফাইন্যাল ইয়ার চলছে। কমপ্লিট হোক আগে।
আমি এই মুহূর্তে তোমাদের কিছু বলবো না। তবে তোমরা যে সব ফর্মালিটির কথা চিন্তা ভাবনা করে রেখেছো, করে ফেল। আমি ওদের সঙ্গে আলাদা করে একটু কথা বলবো।
কেন তুই কথা বলিস নি?
বলি নি বললে ভুল। আভাসে ইঙ্গিতে যেটুকু কথা হয়।
তাতে তোর কি মনে হয়েছে?
একটু সময় তোমাদের দিতে হবে। আফতাবভাই-এর কিছু কিছু ইমোসান আছে। দিদি মানতে চাইলেও ও মানতে চায় না। তোমরা যদি ভাব আমি অনিকাকে আটকে রাখতে চাইছি, তা নয়। আমি একটা প্রসেস মেইনটেন করতে চাইছি। এই প্রসেসের মধ্যে দু-জন দু-জনকে যদি মানিয়ে নেয় তাহলে আমাদের মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়?
তোর কথার যুক্তি আছে। ডাক্তারদা বললো।
তুমি বুঝতে পারবে। কেন আমি বলছি।
বুঝতে পারছি।
তুমি কি আফতাবভাইকে এই ব্যাপারগুলো বলেছো। ডাক্তারদার দিকে তাকালাম।
না বলি নি।
আমি আফতাবভাই-এর দিকে তাকালাম।
তুমি আমার কথাটা একবার বোঝার চেষ্টা করো।
বল।
তোমার সন্তানের স্ত্রীকে নিয়ে তোমার কিছু ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে।
তুই তো সব জানিস, তোর কাছে কিছু গোপন করি নি।
বসির যেভাবে বেড়ো হয়ে উঠেছে, অনিকা সেভাবে বড়ো হয়ে ওঠে নি।
জানি।
তোমার স্ফেয়ারে মানিয়ে নেওয়া ওর পক্ষে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।
তৈরি করে নেব।
পারবে না। ওকে নিজেকে তৈরি হতে দাও। বরং ওকে ভাবতে দাও তুমি ওই পরিবারের বৌ হবে। ব্যবসার খাতিরে ঘন ঘন তোমার কাছে যাওয়া আসা করতে দাও। তুমি কে, তোমাকে বুঝতে দাও, দিদি কে, তাকে বুঝতে দাও। আর বসিরের ব্যাপারটা ছেড়ে দাও, যোগাযোগ এখন হাতের মুঠোয়। ইচ্ছে করলেই ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করে নিতে পারবে।
একটু একটু করে দায়িত্ব দাও। দেখ সেটা বইতে পারছে কিনা।
সেটা পারছে। আফতাবভাই বললো।
না। এখনো ওদের স্থির বিশ্বাস, মামা ওদের মাথায় আছে। কিছু ভুল করলে মামা সামলাবে। একটু বকাবকি করবে, গালাগাল দেব। ব্যাশ। মাথায় রাখবে এটা সব নয়।
ও আমার হাতে মানুষ। ওকে আমি আমার হাতের তালুর মতো চিনি। ওর প্লাস, মাইনাস সব আমি জানি। সেরকম যদি হতো। তাহলে তোমাকে প্রথমেই না করে দিতাম। অনিসার সঙ্গে ওকে তোমার কাছে পাঠাতাম না।
দেখলাম দিদি মুখ নীচু করে মুচকি মুচকি হাসছে।
দিদি তোমাকে আকারে ইঙ্গিতে কিছু বলার চেষ্টা করে, সেগুলো একটু মাথায় ঢোকাও।
নাজমা আমাকে বলেছে।
তাহলে হরবর করছো কেন।
তুই তো জানিস।
তাহলে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও। ছেলের বৌ করতে হবে না।
আমার ইচ্ছে ছিল আজ পীরবাবাকে সাক্ষী রেখে ওকে গ্রহণ করবো।
আমি তোমার ইচ্ছেকে শ্রদ্ধা করি। কখনো না বলি নি। ফাদারও আমাকে বলেছেন।
ফাদার রওনা হয়েছেন। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে চলে আসবেন।
ও শুধু ফাদারের সম্পত্তি নয়, উসমানেরও সম্পত্তি।
উসমান আসবে।
আফতাবভাই-এর ইমোসন্যাল কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম।
কালকে দুজনের মাছধরা, আম চুরি করে খাওয়ার দৃশ্য তুমি দেখ নি। আমি দেখেছি। দেখলে তুমি এই কথা বলতে না।
অনিসা, নম্রতা মোবাইলে ছবি তুলেছিল দেখিয়েছে।
তুমি কি ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছ।
হ্যাঁ। কয়েকদিন আমার ওখানে গিয়ে থাকুক।
নাঃ শুয়ে থাকলে আর চলবে না।
উঠে বসলাম। বড়োমা আন্টির মাঝখানে খাটে পা ঝুলিয়ে বসলাম।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি মুচকি মুচকি হাসছি।
তোমার সঙ্গে আফতাবভাই-এর কোনও পার্থক্য নেই।
ডাক্তারদা জোড়ে হেসে উঠলো। তালে তাল দিল বিধানদা।
অনি তুই জব্বর কথা বলেছিস। দাদা বলে উঠলো।
ঘরের সবাই কম বেশি ফিক ফিক করে হাসছে।
তা হোক মেয়েটা ভাল থাকবে।
বড়োমার পরিতৃপ্ত চোখে মুখে স্নেহ ঝরে পরছে।
দুজনে মিলে ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর করে সব ঘোঁট পাকিয়ে আমার কাছে এসেছো।
তুই তো আর না বলবি না। তাই।
কে বললো আমি না বলবো না।
ছোটো বলেছে।
সাঁট গাঁট ভালই বেঁধেছ।
কেন রে। বড়োমা চেঁচাল।
ধমকাবে না।
একটু থেমে নরম গলায় বললো।
শুভর দাদু-ঠাকুমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। আসছে।
আমি হাসতে হাসতে মাথা দোলাচ্ছি। বড়োমার মুখের দিকে তাকালাম।
রাতে খেঁটনটা খুব জোর হবে বলে মনে হচ্ছে।
ঘরের কেউ গম্ভীর নেই।
কালকে সবাই শ্যামের ওখানে যাব। তুই নিয়ে যাবি। যেখানে চান করেছিলাম ওখানে সবাই চান করবো।
বড়োমা বেশ পরিতৃপ্ত মুখে কথা বলে চলেছে।
আর কি করবে।
মনসা মন্দিরে পূজো দেব।
শালপাতার ঠোঙায় চিঁড়ে-মধু-দুধ খাবে। আমি বললাম।
বড়োমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
এখান থেকে বস্তা বস্তা মিষ্টি কিনে নিয়ে যাবে।
তোকে ভাবতে হবে না। তুই ধার চাইলে আমি ছোটো দেব।
আমি হাসছি আমার সঙ্গে সবাই হাসছে।
ওখানে গিয়ে কি করবে।
অনিমেষ বললো ওর কি কাজ আছে। তা বললুম আমরাও যাব।
কোনদিন শুনেছো, ঘোড়া আত্মহত্যা করে।
মিত্রা, তনু, ইসি পেছন থেকে শব্দ করে হেসে উঠলো।
বড়োমা আপাত গম্ভীর হয়ে পেছন ফিরে তাকাল।
তোরা হাসছিস কেনরে ?
তিনজনেই ঠোঁট চেপে হাসতে শুরু করেছে। অদ্ভূত লাগছে ওদের মুখটা।
বড়োমা আমার মুখের দিকে তাকাল। তুই বল একটু শুনি।
অনিমেষদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হসছে।
সোনা আন্টি।
বল।
কিছু বুঝছ।
অজু জানে।
এবার দেখলাম ডাক্তারদা সোনা আন্টির দিকে তাকিয়ে হাসছে।
তোমার ভাগেরটা আর বাকি থাকে কেন।
আমি অজুকে বলতে বলেছি।
কেন তুমি বললে আমি না বলবো।
তোর মনটন বুঝে কথা বলতে হয়। আমি অতো বুঝি না। তাই অজুকে বলেছি।
তোমারও কি বড়োমা আফতাবভাই-এর মতো দশা।
বয়স হয়েছে ঝপ করে যদি মরে যাই।
সোনা আন্টির গলা জড়িয়ে ধরলাম।
তুমি মরতে চাইলেও এখন তোমাকে মরতে দেওয়া যাবে না।
হাঁটু নিয়ে বড্ড ভুগছি।
কেন ডাক্তারদা ওষুধ দেয় নি।
ওর থেকে আমি ভাল ডাক্তারি করি। জামাইটার কি ব্যবস্থা করলি।
ওটা অনিমেষদা বলতে পারবে।
অনিমেষ বললো, তুই জানিস।
সকালে অনুজবাবু ফোন করেছিল তুমি শুনেছ।
অতো প্যাঁচ পয়জার মাথায় ঢোকে না।
তারপরের আপডেট অনিমেষদা, বিধানদা নিশ্চই নিয়েছে, আমি নিই নি।
হ্যাঁরে তোর মাথাটা ভাঙবো। বৌদি দাঁতে দাঁত চিপে বললো।
দেখলে, আমি যে ঠিক কথা বলেছি সেটা প্রমাণ পেলে।
আমি ঠিক বুঝি না।
তোমাকে আমি বুঝিয় দেব।
তুই আর ঝামেলা ঝঞ্ঝাট করিস না। এবার সব ছেড়ে ছুড়ে দে।
তুমি এই কথা বলছো! অনিমেষদা, বিধানদা শুনবে না। ওরা দুজন যে অন্য স্বপ্ন দেখে।
অনিমেষকে আমি বলেছি ঢের হয়েছে এবার রিটায়ার হও।
তোমায় কি বললো।
কিছু বলে নি।
কোনওদিন বলবে না।
একটু থামলাম।
জানো আন্টি, স্কাই ইজ দ্যা লিমিট। বড়ো দামী কথা বুঝলে। এই রসে যে মজেছে তার কাছে অবসর কথাটা অর্থহীন।
আন্টি আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।
বড়োমাকে যদি বলি তুমি রান্নাঘরে ঢুকবে না। মেনে নেবে। এখুনি লাঠালাঠি শুরু হয়ে যাবে। আমরা কেউ বাড়িতে টিঁকতে পারবো না।
ছোটোমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বড়োমা, ছোটোমা একে অপরের লাঠি।
ওদের সাম্রাজ্যে ওরা ছড়ি ঘোরায় তুমি ডাক্তারদা তোমাদের নিজের সাম্রাজ্যে।
তোমাদের কাছ থেকে যদি পেসেন্ট কেরে নেই তোমরা মেনে নেবে? নেবে না।
আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু এক একজন এক একটা গন্ডীবদ্ধ জীবন নিয়ে বেঁচে আছি।
আমাদের সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না সব ওই গন্ডীটুকুর মধ্যে।
যারা এই গন্ডী ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, তাদের জীবনে বরো মজা।
সেই জগতের প্রাণীরা চোখ দিয়ে শোনে। কান দিয়ে দেখে।
কথা কম বলে, শোনে বেশি। লোকে তাদের নানা বিশেষণে অভিভূত করে, যেমন ধরো ইনট্রোভাট, ইনটেলেকচ্যুয়াল….।
আন্টি আমার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে।
আমার জীবনে প্রথম মদ খাওয়ার ঘটনা বলি।
আন্টি হেসে ফেললো।
তাহলে হয়তো তোমাদের ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করে বোঝাতে পারবো।
দেখলাম সকলে মুচকি মুচকি হাসছে। মিত্রা একবার খোঁচা মারলো পেছন থেকে। বড়োমা দেখতে পেয়েছে। বিরক্তি ভরা চোখে পেছনে তাকাল।
চোখে চোখে ইশারা হলো।
(আবার আগামীকাল)