লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বিপর্যয়ের জের এখনো পুরো কাটেনি, তার মধ্যে সে রাজ্যের ১০টি আসনে উপনির্বাচন আসন্ন। যদিও উপনির্বাচনের দিনক্ষণ এখনও ঘোষণা হয়নি তবে উত্তরপ্রদেশে লোকসভা নির্বাচন এবং তার পরবর্তী সময়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্বের মধ্যে যে মতবিরোধ দেখা দেয় তা মেটেনি বরং এখন অনেকটাই প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন ২০২৬ সালে, তার আগে মিকিপুর-সহ কাঠেহারি, কারহাল, মীরাপুর, গাজিয়াবাদ, মাঝাওয়ান, সিসামৌ, খাইর, ফুলপুর এবং কুন্ডারকি কেন্দ্রের উপনির্বাচনকে মিনি বিধানসভা নির্বাচন বলা যায়। লোকসভায় উত্তরপ্রদেশে খারাপ ফল এবং সদ্য দেশের ১০টি রাজ্যের ১৩টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ শিবির যেভাবে প্রায় সবকটিতেই পর্যুদস্ত হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে উত্তরপ্রদেশের ১০ আসন নিয়ে বিজেপি শিবির বেশ চিন্তায় আছে। যদিও এই উপনির্বাচনের ফলাফল উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকারের ওপর সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলবে না কিন্তু বিজেপি নিজেদের সবকটি আসন ধরে রাখতে পারবে কিনা যোগী আদিত্যনাথের কাছে সেটাই এখন চ্যালেঞ্জ।
কিছুদিনের মধ্যে যে দশটি আসনে উত্তরপ্রদেশে উপনির্বাচন তার মধ্যে পাঁচটি আসন আগে ছিল সমাজবাদী পার্টির দখলে। তিনটি আসন ছিল বিজেপির দখলে এবং একটি করে আসন ছিল আরএলডি এবং নিষাদ পার্টির। আরএলডি এবং নিষাদ পার্টি উভয় দলই এখন এনডিএ শিবিরে। সেই হিসাব অনুসারে ১০টি আসনের মধ্যে পাঁচটি আসন এনডিএ শিবিরের এবং পাঁচটি আসন বিরোধীদের দখলে ছিল। লোকসভায় এ রাজ্যে সমাজবাদী পার্টির ইন্ডিয়া মঞ্চ ৪৩ আসনে জয়ী হয়েছিল। যার মধ্যে সমাজবাদী পার্টি পেয়েছিল ৩৭ আসন, কংগ্রেস ৬ এবং আজাদ সমাজ পার্টি ১টি আসন পেয়েছিল। ইতিমধ্যেই বিরোধী ইন্ডিয়া মঞ্চ উপনির্বাচনের আসন ভাগাভাগি এবং সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির এক নেতা তো বলেই দিয়েছেন, আসন্ন উপনির্বাচনে ফলাফল খুব স্পষ্টভাবেই তাদের দিকে থাকবে। অন্যদিকে বিজেপি নেতৃত্ব খুব ভাল করেই জানে রাজ্যে বিজেপির অবস্থা এখন খুবই খারাপ।
এই আবহে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্যের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের তাপ ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আর উপমুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে সংঘাতের আঁচ প্রকাশ্যে আসে যখন ১০টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন নিয়ে যোগীর নেতৃত্বে বিজেপি পুরোদমে প্রস্তুতি শুরু করেছে, ঠিক তখনই বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্যকে দিল্লিতে ডেকে নিয়ে বৈঠক করেন। নড্ডার সঙ্গে আলাদা ভাবে বৈঠক হয় উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সভাপতি ভূপেন্দ্র চৌধুরিরও। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও তাঁর বৈঠক হয়। এমনকি কেশব প্রসাদ মৌর্য ও ভূপেন্দ্র চৌধুরির সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। দিল্লিতে পরপর বৈঠকের পর থেকেই যোগী রাজ্যের কোন্দল নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশের বাতাসে এই প্রশ্ন ভেসে বেড়াতে থাকে বিজেপি কী উত্তরপ্রদেশে দল ও প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তনের দিকে হাঁটছে না মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি সভাপতি, দুই পদেই নতুন মুখ আনতে চলেছে? অন্যদিকে, বিজেপি সূ্ত্রের খবর অনুযায়ী, আপাতত মুখ্যমন্ত্রী বদল নয় কয়েকজন মন্ত্রীকে সরানো হতে পারে। তবে মুখ্যমন্ত্রী বদলের সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি এও জানা যাচ্ছে, বিজেপি রাজ্য সভাপতির পদ থেরে ভূপেন্দ্র চৌধুরীকে সরিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্যকে সেই জায়গায় আনা হতে পারে।
প্রসঙ্গত, লখনউ এবং দিল্লির বিজেপি দফতরে উত্তর প্রদেশে লোকসভা নির্বাচনে খারাপ ফলের কারণ অনুসন্ধান নিয়ে যতগুলি বৈঠক হয়েছে, সেখানে কারণ অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণের পর দলের শীর্ষ মত দিয়েছেন, সংগঠনকে চাঙা করা দরকার, গুরুত্বপূর্ণ পদে মুখ বদলও দরকার। সেই বদলে যোগীর নামও আছে। অন্যদিকে, বিজেপির একাংশের অভিযোগ, যোগী প্রশাসন পরিচালনা করতে গিয়ে দলকে গুরুত্ব না দিয়ে আমলাদেরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিজেপির রাজ্য কমিটির বৈঠকে আরএসএসের ঘরের লোক উপমুখ্যমন্ত্রী মৌর্য এই বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, দলীয় সংগঠনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। দল আগে প্রশাসন পড়ে। সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন দলীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। তার পরেই তিনি মৌর্যকে দিল্লিতে তলব করেন। এই আবহে উত্তরপ্রদেশে ১০টি বিধানসভার উপনির্বাচন আসন্ন। লোকসভা ছাড়াও সদ্য অনুষ্ঠিত অন্য রাজ্যের উপনির্বাচনগুলিতে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। তারমধ্যে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের ভাঙনের খবর উড়তে শুরু করেছে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির অলিন্দে।
লোকসভা ভোট এবং ফল প্রকাশ হয়েছে মাত্র দু’মাস আগে, এর মধ্যেই উত্তরপ্রদেশ বিজেপি স্পষ্ট দুভাগে বিভক্ত।একদিকে গেরুয়াধারী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, অন্যদিকে মোদি–শাহ ঘনিষ্ঠ উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্য। আর সেই দুই শিবিরের কোন্দল এমন সময়ে তুঙ্গে উঠেছে, যখন রাজ্যের ১০ বিধানসভা আসনের উপনির্বাচন, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র দুই শরিক সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করে ইয়ত্তরপ্রদেশে খারাপ ফলের জন্য পুরোপুরি যোগী দায়ী। বিশেষঙ্গদের ধারনা, মোদী মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে যোগীকে সরিয়ে দিতে চান কারণ, যোগী আদিত্যনাথ ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হয়ে উঠুন এটা মোদি চান না। অমিত শাহও চান তাঁর পথের কাঁটা সরাতে, তাই এখন থেকেই তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন, যোগীকে হটিয়ে কী বিজেপি উত্তর প্রদেশে রাজত্ব করতে পারবে?