১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হল। সঙ্গে সঙ্গে দেশ দু-ভাগ হল। দেশ স্বাধীন হল এই সত্য অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। স্বয়ংসেবক সংঘ ও হিন্দু মহাসভার মত উগ্র দেশপ্রেমিক সংগঠন অনেকদিন পর্যন্ত মনে করত এটা প্রকৃত স্বাধীনতা নয়! অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টি স্বতন্ত্র এক দৃষ্টিতে প্রায় একই ধারণা পোষণ করতো। ব্রিটিশ সরকারের ভারতভাগের পরিকল্পনা সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টি ওই বছরের ৩ জুন এক প্রস্তাবে বলে মাউন্টব্যটেন পরিকল্পনা হল সাম্রাজ্যবাদের এক দ্বিমুখী চক্রান্ত— একদিকে স্বাধীনতার দাবিকে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে বিপথে চালিত করা, অপরদিকে প্রতিক্রিয়ায় শক্তিকে উৎসাহ দিয়ে চূড়ান্ত স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে বাধা দেওয়া। আদতে এই পরিকল্পনা does not give India real independence. এ সময় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পি সি যোশী। এই তিনিই ১৯৪৮-এর ৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে বলেন, ‘জাতির শত্রুরা আজ পন্ডিত নেহরু তথা তাঁহার গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে যে আক্রমণ আরম্ভ করিয়াছে দেশের সমস্ত মিলিত শক্তির দ্বারা তাহাকে রুখিতেই হইবে।’
পার্টি দোল খেতে লাগল নেহরুর অবস্থান নিয়ে। এদিকে গত শতকের চল্লিশের দশককে ‘প্রায় বিপ্লবের’ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার অন্ত ছিলনা। প্রেরণা ছিল সোভিয়েত আর নব জাগ্রত চীন। ননী ভৌমিকের ‘আগন্তুক’ গল্পের নায়ক মুরারি স্বপ্ন দেখছে— দুনিয়াটাকেই বদলে দিতে হবে। কলকাতার মিটিংয়ে মজুর হেঁকে বলছে, ‘হিল্লা দেঙ্গে, হিন্দুস্থানকো হিল্লা দেঙ্গে’। কৃষক নেতা কংসারি হালদারকে কৃষক উপেন বলছেন, ‘কমরেড জমি নিয়ে আমি কি করবো! আমার ছ-বিঘা আপনি নিয়ে নিন। আমার পরিবারের খরচা সোভিয়েত দেবে। ‘পূর্ব ভারতে তে-ভাগার দাবি আর দক্ষিনে নিজামের রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে গণসংগ্রাম। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি যেন স্বপ্নের সওদাগর!
বলা হতে লাগল ভারত ভাগ ভারতীয় বুর্জোয়া ও জমিদার শ্রেণির সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমঝোতার পরিনাম। কার আজাদি, কিসের আজাদি? পার্টি নেতৃত্ব ঘোষণা করেছিল কমিউনিস্টরাও ১৫ আগস্টের আনন্দ উৎসবে যোগ দেবে (পিপলস এজ, ৩.৮.৪৭)। কিন্তু এই ঘোষণা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল। কেউ কেউ বললেন, স্বাধীনতা আসছে, ইংরেজ যাচ্ছে। কিন্তু কারা ক্ষমতায় বসছে? এখানে কমিউনিস্টদের অংশ কী? শ্রমিকদেরই বা ভূমিকা কী?
এসব কথা পার্টির অন্দরে ঘুরপাক খেতে লাগল। স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে যুক্তি তর্কে কন্টকিত হল পার্টি। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব, মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদের তাৎপর্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বোঝাপড়া, ক্ষমতা হস্তান্তরের পটভূমি— এসব প্রশ্ন ও উত্তরের খোঁজে পার্টির অভ্যন্তরে শুরু হল নানা বিভ্রান্তির। উগ্র মতাদর্শগত সংলাপ ক্রমশ শক্তি পেল— নেহরু এখন ব্রিটেন ও আমেরিকা – এই দুই মনিবের ভৃত্যে পরিনত। আর ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি লোলুপতা ও শঠতার জন্য দেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত বিকিয়ে দিতে পারে। এই পর্যায়েই পার্টি ক্ষমতা থেকে যোশীর বিদায়, রনদিভের উত্থান।
পার্টির নতুন কার্যক্রমে বলা হল— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শক্তির ভারসাম্য সমাজতন্ত্রী শিবিরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই অবস্থায় প্রতিটি দেশের বুর্জোয়া শ্রেণি খোলাখুলিভাবে প্রতিক্রিয়া ও সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাই ভারতের বিপ্লবের পথ জণগনতন্ত্র।
এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৪৮-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ কলকাতার মহম্মদ আলি পার্কে দলের দ্বিতীয় কংগ্রেস-এর অধিবেশন বসল এবং বিপ্লবের দলিল গৃহীত হল। পার্টি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বার্মার ( মায়ানমার) কমিউনিস্ট নেতা থাকিন থানটুন আহ্বান জানান— আসুন ১৯৪৮ সালকে মুক্তির বছরে পরিনত করি। পার্টি কংগ্রেসে হিন্দি বলয়ের কর্মীরা শ্লোগান তুললেন, ‘লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’।
বিপ্লবের ডাকে কেঁপে উঠল গোটা সম্মেলন। ঘরে বাইরে সমর্থক, জনতাও লুফে নিল এই শ্লোগান। আট শব্দের মূল শ্লোগানটি লোকমুখে কেবল ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ তে লোকপ্রিয় হয়ে গেল।
কেউ কেউ বলেন শ্লোগানটির উৎপত্তি অন্ধ্রপ্রদেশে, এখনকার তেলেঙ্গানায়। হায়দ্রাবাদের শাসক নিজাম এবং সেখানকার সামন্তশ্রেনির বিরুদ্ধে ১৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে প্রায় তিন হাজার গ্রামের লক্ষ লক্ষ কৃষক যে গণসংগ্রামের সুচনা করেছিল (১৯৪৫-৫১) — সেই সংগ্রামকেই চিহ্নিত করা হল বিপ্লবের সূচনা কেন্দ্র হিসেবে। বলা হল তেলেঙ্গানার পথ আমাদের পথ।
পার্টির রণনীতি ও রণকৌশল গোটা পার্টিকে নিয়ে এল লড়াই-এর ময়দানে। ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী হয়ে গেল। ১৯৪৯-এর ৯ মার্চ সারা ভারত রেল ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি এল নেহেরু সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টি। কি হল? সাবিত্রী রায়-এর ‘স্বরলিপি’ উপন্যাস এর নায়ক পৃথ্বী ভোর হতে শিয়ালদা স্টেশনে এসে দেখে দার্জিলিং মেল ইন করেছে যথা সময়ে। ইঞ্জিনের সামনে বসা সেই কালিমাখা ড্রাইভার, সশস্ত্র সৈনিক না। বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া! খড়্গপুর থানা লক আপে আটক মনিকুন্তলা সেন লিখছেন, ‘অনবরত রেল চলার আওয়াজ পাই, আর মনে হয় আমার বুকের উপর দিয়েই যেন রেল চলছে’।
সময় গড়িয়ে চলল নিজের মত। পার্টিতে হাজারো প্রশ্ন। বি টি আর (রনদিভের) নেতৃত্ব নিয়ে সন্দেহের বাতাবরণ। ইতিমধ্যে কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কাস পার্টি সমূহের ইনফরমেশন ব্যুরো অর্থাৎ ‘কমিনফর্মে’-র মুখপত্র ‘ফর এ লাস্টিং পীস- ফর এ পিপলস ডেমোক্রেসি’ (১৯৫০) লেখা বেরোল, ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জাতীয় বুর্জোয়া, শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তদের নিয়ে সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এই পরামর্শে সব বদলে গেল। নতুন সমরনীতি, নতুন রণকৌশল। বলা হল, পার্টির আগেকার সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত বাম বিচ্যুতি। ৫২ সালে পার্টি বিপ্লব সিন্দুকে রেখে নির্বাচনী সংগ্রামে যোগ দিল।
মণিকুন্তলা সেন প্রশ্ন তোলেন, জাতীয় বুর্জোয়া কারা? টাটা, বিড়লারা? কেউ প্রশ্ন তুললেন না, এ আজাদি ঝুটা হ্যায় বলে জেলে এলাম কেন?
এভাবেই একটি শ্লোগানের জন্ম ও মৃত্যু গাথা রচিত হয়ে গেল।