মঙ্গলবার | ৮ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ভোর ৫:৫১
Logo
এই মুহূর্তে ::
ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (পঞ্চম পর্ব) : জমিল সৈয়দ যশোধরা — এক উপেক্ষিতা নারীর বিবর্তন আখ্যান : সসীমকুমার বাড়ৈ কলকাতার কাঁচাভেড়া-খেকো ফকির ও গড়ের মাঠ : অসিত দাস ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (চতুর্থ পর্ব) : জমিল সৈয়দ রামনবমী পালন এবং হুগলী চুঁচুড়ার শ্রীরামমন্দির : রিঙ্কি সামন্ত ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (তৃতীয় পর্ব) : জমিল সৈয়দ মিয়ানমারে ভূমিকম্প — প্রতিবেশী দেশের জনগণের পাশে বাংলাদেশ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (দ্বিতীয় পর্ব) : জমিল সৈয়দ হুমায়ুন-এক স্মৃতি-এক আলাপ : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সনজীদা যার সন্তান : শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ওড়িশার হীরক ত্রিভুজ : ললিতগিরি, উদয়গিরি ও রত্নগিরি (প্রথম পর্ব) : জমিল সৈয়দ অবসর ঠেকাতেই মোদী হেডগেওয়ার ভবনে নতজানু : তপন মল্লিক চৌধুরী লিটল ম্যাগাজিনের আসরে শশাঙ্কশেখর অধিকারী : দিলীপ মজুমদার রাঁধুনীর বিস্ময় উন্মোচন — উপকারীতার জগৎ-সহ বাঙালির সম্পূর্ণ মশলা : রিঙ্কি সামন্ত রামনবমীর দোল : অসিত দাস মহারাষ্ট্রে নববর্ষের সূচনা ‘গুড়ি পড়বা’ : রিঙ্কি সামন্ত আরামবাগে ঘরের মেয়ে দুর্গাকে আরাধনার মধ্য দিয়ে দিঘীর মেলায় সম্প্রীতির মেলবন্ধন : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকার ২২তম বর্ষ উদযাপন : ড. দীপাঞ্জন দে হিন্দিতে টালা মানে ‘অর্ধেক’, কলকাতার টালা ছিল আধাশহর : অসিত দাস আত্মশুদ্ধির একটি বিশেষ দিন চৈত্র অমাবস্যা : রিঙ্কি সামন্ত চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয় : ড. দীপাঞ্জন দে রায়গঞ্জে অনুষ্ঠিত হল জৈব কৃষি বিপণন হাট অশোকবৃক্ষ, কালিদাসের কুমারসম্ভব থেকে অমর মিত্রর ধ্রুবপুত্র : অসিত দাস কৌতুকে হাসতে না পারলে কামড় তো লাগবেই : তপন মল্লিক চৌধুরী জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর ও রোহিঙ্গা সংকটে অগ্রগতি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন এথেন্সের অ্যাগনোডাইস — ইতিহাসের প্রথম মহিলা চিকিৎসক : রিঙ্কি সামন্ত সন্‌জীদা খাতুন — আমার শিক্ষক : ড. মিল্টন বিশ্বাস হিমঘরগুলিতে রেকর্ড পরিমাণ আলু মজুত, সস্তা হতে পারে বাজার দর : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় শিশুশিক্ষা : তারাপদ রায় জঙ্গলমহল জৈন ধর্মের এক লুপ্তভুমি : সসীমকুমার বাড়ৈ
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ অন্নপূর্ণা পূজা ও বাসন্তী পূজার আন্তরিক শুভেচ্ছা শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

যশোধরা — এক উপেক্ষিতা নারীর বিবর্তন আখ্যান : সসীমকুমার বাড়ৈ

সসীমকুমার বাড়ৈ / ২০ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলা ছোটগল্পের উৎসে ‘জাতক’ ‘কথাসরিৎসাগর’ ‘পঞ্চতন্ত্র’ ‘হিতোপদেশ’ ‘রূপকথা-উপকথা’ এবং প্রথম দিকে লিখিত ক্ষুদ্রগল্প ‘চুর্ণক’-এর বিভিন্ন ধরনের আখ্যানমালার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আখ্যানগুলির কিছু বাঁকবদলই সূচনা পর্বে সাহায্য করেছিল আধুনিক ছোটগল্প হয়ে উঠতে। তেমন একটি বহুশ্রুত জাতকের গল্প শুধু আমদের হৃদয় স্পর্শই করেনি, পাশাপাশি অধুনিক ছোটগল্পের অধিকাংশ লক্ষণ নিয়ে হাজির হয়েছে। গল্পের লক্ষণ আলোচ্য বিষয় নয়, বরঞ্চ গল্পটিই আলোচ্য। গল্পটি এরকম: রাজকুমার সিধার্থ গৌতম কঠোর সাধনায় বুদ্ধত্ব লাভ করে পিতা শুদ্ধোধনের অনুরোধে এসেছেন কপিলাবস্তুতে। তিনি ‘অর্হৎ’ সর্বমান্য। আর্তের শরণ। যে রাতে রাহুল জন্ম নিল সে রাতে নবজাতক এবং যশোধরাকে ত্যাগ করে সিদ্ধার্থ বেরলেন তপস্যায়। সন্তান রাহুল আগে কখনও পিতার মুখ দর্শন করেনি। সকলের পরিত্রাতা হলেও স্বামী-পরিত্যক্তা যশোধরার অন্তরে লালন করছিলেন গভীর মর্মবেদনা এবং সংগত ক্ষোভ। তিনি সাত বছরের রাহুলকে বললেন-যাও পুত, পিতার কাছ থেকে পিতৃধন প্রার্থনা করো। রাহুলের প্রার্থনা শুনে বুদ্ধদেব বললেন-যথার্থ, আমি তোমাকে আমার শ্রেষ্ট ধন দান করব। বুদ্ধ তাঁর প্রধান শিষ্য সারিপুত্তকে ডেকে নির্দেশ দিলেন রাহুলকে প্রব্রজ্যমন্ত্র দান করতে। সারিপুত্ত রাহুলকে উপসম্পদা প্রদান করেন। বালক মায়ের সামনে এসে দাঁড়াল-মুণ্ডিতকেশ, গৈরিক বসন, ভিক্ষাপাত্র হাতে। ছোট্ট শ্রমণ রাহুলও বাবার ন্যায় মাকে ছেড়ে যাবে চিরকালের জন্য।

জাতকের এই গল্পটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সংজ্ঞায়িত ছোটগল্পের একটি সার্থক উদাহরণ। এখানে একক প্রতীতি জাত সংক্ষিপ্ত কাহিনিটির একতম বক্তব্য মানবিক দৃষ্টিকোণে ঐক্য-সংকটের মধ্য দিয়ে সামগ্রিকতা লাভ করেছে। এখানে আলোচ্য বিষয় যশোধরার জীবনের ঐক্য-সংকট। বৈশাখী পূর্ণিমার একই দিনে শাক্য বংশের রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম ও কৌলীয়গণের প্রধান সুপ্রবুদ্ধের কন্যা যশোধারার জন্ম। যশোধরার মা অমিতা ছিলেন গৌতমের পিতা তথা শাক্যগণের প্রধান শুদ্ধোধনের ভগিনী। সুশিক্ষিত অসামান্য রূপ-লাবণ্যময়ী যশোধরা সিদ্ধার্থের সমবয়সী পিসতোতো বোন। ষোল বছর বয়সে উত্তম পুরুষের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হলো। যশোধরার চোখে, সিদ্ধার্থ যথার্থ প্রেমিক। সিদ্ধার্থ বিদায়ের রাতে যশোধরা আঁতুরঘরে ছিলেন প্রসব বেদনায় ক্লান্ত অবসন্ন। তেমনি আনন্দিত, বিয়ের তের বছর বাদে তাঁদের সন্তান এসেছে ঘরে। মা হয়েছেন যশোধরা, ছেলের জন্মদিন মা হিসেবে তারও তো জন্মদিন। যশোধরার সেই একান্ত অপূর্ব অনুভূতি কোনো মর্যাদা স্বামীর কাছ থেকে পেলেন না। স্বামীও পিতা হবার পরম আনন্দ বিশ্বচরাচরে ভাগ করে নিলেন না। মধ্যরাতে নিভৃতে মায়ার বাঁধন ত্যাগ করে, সন্তানের ভবিষ্যৎ উপেক্ষা করে সিদ্ধার্থ সংসারত্যাগ করলেন। একমাত্র নবজাতক সন্তান হারাল পিতৃস্নেহ। সমস্ত সুখানুভূতির যবনিকা পড়ল সিদ্ধার্থের মহাভিনিষ্ক্রমণে। সিদ্ধার্থ সদ্য ভূমিষ্ট সন্তানের মুখ আদৌ দর্শন করেছিলেন কিনা তা নিয়েও সংসয় থেকে যায়। স্বাভাবিকভাবেই স্বামী পরিত্যক্তা সমবয়সী তরুণী বধূর মান-অভিমান, বেদনা, নিঃসঙ্গতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং ছেলের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে অসীম ক্ষোভ থাকা ন্যয় সঙ্গত। তাই ছেলেকে পাঠিয়ে সংসারত্যাগীর ঔদাসীন্যের সামনে স্ত্রীর দাবী যতটা সম্ভব তুলে ধরেছিলেন যশোধরা। শাস্তিও পেলেন কঠোরতম, সন্তানকেও হারালেন। মুণ্ডিতকেশে ভিক্ষাপাত্র হাতে একমাত্র যক্ষের ধন পুত্র যখন এসে দাঁড়াল, সহজেই অনুমেয়ে কী ভয়ানক হৃদয় বিদারক সেই মুহূর্ত মায়ের কাছে। কাকে বলবেন তাঁর মর্মকথা, শশুর শুদ্ধোধন প্রিয় সন্তানের মহাভিনিষ্ক্রমণে হৃদয় বিদীর্ণ ভেঙে এক পড়া পৌঢ়। মাতাসম বিমাতা গৌতমীর অবস্থাও তথৈবচ। স্বামী-সন্তান বিচ্ছিন্ন এমন অসহায় নারীর দেহ মনের করুণ অবস্থা অনুমান করে নিতে বিশেষ কষ্ট হয় না। পুরুষের ধর্মাচরণে বাধা দেবে নারী এত স্পর্ধা পায় কোথা থেকে? সমাজ নারীর অধিকার মানে? স্বামী ত্যাগ করলে ত্যক্ত হবে এটাই তো নিয়তি, অসহায় যাপনে কাটাবে বাকি জীবন। এ ছাড়া স্ত্রীর আর কি চাহিদা থাকতে পারে আধিপত্যবাদী সমাজের কাছে। যশোধারার ওই আচরণ স্বতঃসিদ্ধ সমাজ-ধারণার বিরুদ্ধে ছিল বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ। জাতকের কাহিনিটি আর পৌরাণিক আখ্যানে সীমাবদ্ধ থাকে না হয়ে ওঠে স্বামী পরিত্যক্তা সংকটময় এক নারীর প্রতিবাদী স্বর।

গৌতম বুদ্ধের জীবনীর সমসাময়িক কোনো লেখ্যরূপ নেই। ফলে বুদ্ধের জন্ম সাল থেকে তাঁর জীবনী নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। সম্রাট অশোকের সময় বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় দু’শো বছর পর থেকে শিলালিপিতে জীবন কাহিনি, উপদেশাবলী খোদিত হতে থাকে। মধ্যবর্তী সময় সংঘের শ্রুতি পরম্পরা, অজাতশত্রুর সময়ে প্রধম বৌদ্ধধর্ম সংগীতি ইত্যাদির মাধ্যামে বুদ্ধের জীবন, ধম্ম, শিক্ষা কিছুটা টিকে ছিল। গৌতম বুদ্ধ চর্চা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মৌর্য শাসক অশোকের সময়ই চালু হয়। বৌদ্ধ ধর্ম ও বুদ্ধের জীবন চরিত চলতে থাকে গৌতম বুদ্ধের কথিত ভাষ্যের পরম্পরায়। বুদ্ধ জীবনীর মূল উৎস হয়ে দাঁড়ায় ত্রিপিটকে বুদ্ধবংস, হিন্দু-জৈন ধর্ম সাহিত্য এবং দ্বিতীয় শতাব্দিতে অশ্বঘোষ রচিত ‘বুদ্ধচরিত’ জীবনীগ্রন্থ নির্ভর। এই মহাকাব্যটিই প্রথম পূর্ণ জীবনীগ্রন্থ। কিন্তু কোনো গ্রন্থেই যশোধরাকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। বুদ্ধ চর্চায়ও যশোধরা থেকে গেছেন উপেক্ষিত। তাঁর সম্বন্ধে খুব সামান্যই জানা যায়। সিদ্ধার্থ-গোপার বিয়ে, কপিলাবস্তুতে তাঁদের সাক্ষাৎকার এবং ভিক্ষুনী হিসেবে শেষ হয়ে যায় যশোধরা পরিচয়। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যশোধরা (সংস্কৃত)-র একাধিক নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন গোপা, সুভদ্দকচ্চানা (পলি), বিম্বা (সংস্কৃত)। পুত্র জন্মানোর পর শুদ্ধোধন আটজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে ডেকেছিলেন শিশুর নামকরণে। তাঁরা নাম দেন সিদ্ধার্থ, যিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন। অসিত নামে এক সাধু ভিবিষ্যদ্বাণী করেনে সিদ্ধার্থ রাজচক্রবর্তী অথবা একজন সিদ্ধ পুরুষ হবেন। সর্ব কনিষ্ঠ্য ব্রাহ্মণ সাধু কৌণ্ডিন্য স্পষ্টভাবে বলেন, এই শিশু ভবিষ্যতে বুদ্ধত্বলাভ করবেন। যশোধরা সম্বন্ধেও প্রায় একই ধরনের কিংবদন্তি চালু আছে। এক জ্যোতিষী রূপ-লাবণ্যে সুমতী কিশোরী যশোধরার হাত দেখে বলেছিল-তাঁর স্থান হবে রানির থেকেও উঁচুতে। এগুলো সবই চালু কিংবদন্তি, যেহেতু বাণী সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না কিন্তু সে সময়ের চালু কিংবদন্তি চর্চারও গুরুত্ব আছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিদ্যা, বুদ্ধি, সৌন্দর্য-এ, ধৈর্য-সহনশীলতায় যশোধরা ছিলেন বুদ্ধের সমকক্ষ। ধৈর্য-সহনশীলতায় হয়তো স্বামীকেও অতিক্রম করে যান। প্রশ্ন থাকতেই পারে, স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারীর ধৈর্যশীলা না হয়ে উপায় কী? বিকল্প রাস্তা নিঃসন্দেহে ছিল, ক্রমশ আলোচ্য।

বোধিসত্ত্ব প্রাপ্তির পর শুদ্ধোধনের অনুরোধে ভিক্ষুবেশে বুদ্ধ এসেছেন কপিলাবস্তুতে, সঙ্গে কুড়ি সহস্র ভিক্ষু। পিতা তার দর্শন অভিলাষী। কপিলাবস্তুতে অবস্থানকালে দ্বিতীয় দিনে ক্ষুন্নিবারণের জন্য গৌতম নগরের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষুদের নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন। নগরবাসী ছিঃ ছিঃ করছে, রাজপুত্র কিনা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে। তবু তাঁর মহিমা দেখে প্রাসাদের নারীরা গোপাকে অনুরোধ করল, প্রিয়নাথকে যেন দেখে আসে। কিন্তু যশোধরা তো সামান্য নারী নয়, সে রাজবধূ-বিদূষী-রাহুলের মা। তিনি ব্যক্তিত্ব বিদ্যায় সংস্কৃতকলায় এক অসামান্যা নারী। যশোধারা সিদ্ধান্তে অটল, স্বামী দর্শনে যাবেন না। সংবাদ দেন, যশোধরার কোনো গুণ অবশিষ্ট থাকলে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ আসবেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। গৌতম আসার সত্যতা দেখার জন্য রাজপ্রাসাদের জানালা থেকে শ্রমণদের সঙ্গে ভিক্ষুবেশে স্বামীকে দেখলেন। বুদ্ধের ব্যক্তিত্ব, গরিমায় মুগ্ধ যশোধারা রাজপ্রাসাদের অন্তরালে বসে লিখলেন প্রশংসাসূচক নয়টি শ্লোক (মতান্তরে আটটি শ্লোক), যা নরসিংহ গাথা হিসেবে পরিচিত। তার কোনো লেখ্যরূপ তো সেকালে ছিল না, শ্রুতিতে হয়তো টিকে ছিল।

নরসিংহ গাথার প্রথমটি ছিল নিম্নরূপ :

চক্ক-বরঙ্কিত-রত্ত-সুপাদো

লক্‌খণ-মণ্ডিত-আযাতপন্‌হি।

চমর-ছত্ত-বিভূসিত-পাদো-শরীরো

এসহি তুয্‌হ পিতা নরসিহো। (পলি)

বাংলা অনুবাদ : যাঁর রক্তবর্ণ চরণ চক্র দ্বারা অলংকৃত, যাঁর দীর্ঘ জঙ্ঘা শুভ লক্ষণ সম্পন্ন, যার চরণ শঙ্খ ও ছত্র দ্বারা অঙ্কিত হয়ে সুশোভিত হয়েছে, যিনি হলেন নরের মধ্যে সিংহ, তিনিই হলেন তোমার পিতা।

নবম গাথাটি:

গচ্ছান্তি নীলপথে বিয চন্দো,

তারাগণা-পরিবেঠিত-রুপো।

সাবক-মজ্ঝাগতো সমণিন্দো,

এসহি তুয্‌হ পিতা নরসিহো। (পলি)

বাংলা অনুবাদ : যিনি আকাশে তারা ঘেরা চন্দ্রের তুল্য অগ্রসর হচ্ছেন, যিনি শ্রমণদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভিক্ষুদের দ্বারা উচ্চতায় তারা ঘেরা চন্দ্রের মতো বেষ্টিত রয়েছেন, যিনি হলেন নরের মধ্যে সিংহ, তিনিই হলেন তোমার পিতা।

কবিতাগুলোতে প্রব্রাজ্যা স্বামীর প্রতি শুধু তাঁর মুগ্ধতাই প্রকাশ পায়নি, একাধারে যশোধরার কবিত্ব-মননশীলতাও ব্যক্ত হয়েছে। নরসিংহগুলো রচিত হয়েছিল একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। কপিলাবস্তুতে বুদ্ধ কুড়ি হাজার শ্রমণ নিয়ে ঘুরছেন সে সংবাদ শিশু রাহুলের কানেও গেছে। মা যশোধারা চান পুত্র তার পিতৃধন বা উত্তরাধিকার আদায় করুক। পুত্রের মুখ চেয়ে যদি বুদ্ধের করুণা হয়, ফিরে আসেন সংসারে। সে পিতাকে দেখেনি কোনো দিন, তা হলে পিতাকে এত সন্ন্যাসীর মধ্যে চিনবে কী করে? তাই পিতার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রকাশ করে ফেলছেন তাঁর মুগ্ধতা। সিংহ পুরুষ তো শুধু নরশ্রেষ্ঠ নয়, তাঁর মনের প্রিয় মানুষ নরসুন্দরও বটে। সিংহের মতো স্বামী, তাঁকে তরুণী ভার্যা তখনও ভালবাসে। দেহ-মন-শ্রদ্ধায়-ভক্তিতে। জৈবিক যশোধরা সিদ্ধার্থর শরীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘যাঁর দীর্ঘ জঙ্ঘা শুভ লক্ষণ সম্পন্ন’, ‘যাঁর নাক হলো চওড়া এবং সুডৌল’ বলতে ভোলেন না। তেমনি দৈহিক বর্ণনা আসে অন্য নরসিংহ গাথায় ‘আযত-যুক্ত-সুসন্ঠিত-নাসো,/গোপমুখো অভিনীল সুনেত্তো,/ইন্দ্রধনু-অভিনীল-ভমুকো,/এসহি তুয্‌হ পিতা নরসিহো।‘ (পলি)। স্বামী নগরে-প্রাসাদে এসেছেন জেনেও সবার মতো সিদ্ধার্থের স্ত্রী বুদ্ধ দর্শনে যেতে অস্বীকার করতে পারেন কিন্তু প্রেমিক স্বামীর জন্য উতলা নারী মনকে অস্বীকার করতে পারে না? জানালা দিয়ে গোপনে তরুণী ভার্যা দেখলেন স্বামীর পদচারণা। ফলে দেখা যাচ্ছে, কবিতাগুলি শুধুমাত্র একমাত্রিক নয়, হয়ে উঠেছে বহুমাত্রিক এবং জাগতিক।

সমবয়সী সিদ্ধার্থ ও গোপার বিয়ে হয়েছিল ষোল (মতান্তরে আঠাশ) বছর বয়সে। কোলীয়গণের প্রধান সুপ্রবুদ্ধের কন্যা যেমনি ছিলেন রূপবতী, তেমনি পিতা তাকে খালাধুলা, শিক্ষা-দীক্ষা, অশ্বচালনা, যুদ্ধবিদ্যা, নৃত্যকলা এবং বীণা বাদনে অনন্যা করে তুলেছিলেন। সংস্থাগারে শত শত শাক্য-সুন্দরীদের মধ্য থেকে স্বয়ং সিদ্ধার্থ যশোধরাকে পাত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। সিদ্ধার্থ কিশোর থেকে যৌবনে প্রবেশের পরই তার পিতা শুদ্ধোধন প্রাচুর্য, ঐশ্বর্যের অপরিমিত ভোগবিলাসের ঘেরাটোপে বন্দি করেন। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে আলাদা আলাদ রম্য প্রাসাদে রমণী পরিবেষ্টিত ভোগী জীবন যাপনের ব্যবস্থা হয়। বহু কলায় পারদর্শিনী সুসজ্জিতা সুন্দরী নারীরা তাঁর পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সেবা করত। পিতার উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধার্থের সন্ন্যাসের প্রতি যেন আকর্ষণ না জন্মায়। অথচ গোপার তের বছরের দাম্পত্য জীবন বাদে দ্বিতীয় কোনো পুরুষের জায়গা ছিল না। সে স্বামীর একান্ত অনুগামী। স্বামী পরিত্যাগের পর অনেক রাজকুমার যশোধরার পাণিপ্রার্থী ছিল। কিন্তু সে যে সিদ্ধার্থের স্ত্রী, সে কি গ্রহণ করবে এমন ঘৃণিত প্রস্তাব। এমনকি আত্মীয় স্বজনকে সাক্ষাৎকার পর্যন্ত দেননি স্বামী অনুগত গোপা। সিদ্ধার্থ গৌতমের কঠিন কঠোর সন্ন্যাস জীবনের কথা জানতে পেরে প্রাসাদের অন্তরালে যশোধরা স্বামীর ন্যায় রাজবস্ত্র ও অলঙ্কার ত্যাগ করে সাধারণ হলুদ বস্ত্র চীবর ধারণ করে একবেলা আহার করতে শুরু করেন। তিনি বেছে নেন ত্যাগ, তিতীক্ষা এবং স্বামীর জন্য ধৈর্যশীল অপেক্ষার জীবন। সে সময় মেয়েদের পুনঃবিবাহ এবং আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বিয়ের প্রচলন ছিলই। যশোধরারও সে সুযোগ ছিল। কিন্তু রাহুলের মা, গৌতমের স্ত্রী সে পথে হাঁটলের না। থেকে গেলেন উপেক্ষিতাদের দলে। রাজপ্রাসাদের অন্তরালে সন্তান-নাতি বিচ্ছেদে মুহ্যমান পিতৃসম শশুর শুদ্ধোধন আর শাশুড়ি মহাপ্রজাপতি গৌতমীর সেবা, সান্ত্বনা দানে হয়ে উঠলেন এক দায়িত্বশীলা নারী। ফল্গুধারার মতো তাঁর নারীত্ব, সে কী করে অস্বীকার করে সাংসারিক দায় দায়িত্ব? অন্যদিকে শান্তা গৌতম সে যাত্রায় ভাই নন্দকে তার একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিবাহের দিন সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষিত করে সংসার ত্যাগে বাধ্য করেছেন। সূচনা করছেন শাক্য রাজবংশ উত্তরাধিকার শূন্য পতনমুখী হতে। শত শত শাক্যপুরুষ সংসার ত্যাগী। নারীদের সংঘে প্রবেশাধিকার তখনও নেই। বেদনায় হাহাকার করে উঠেছিল শুদ্ধোধনে মন, ছেলেকে বললেন-হে বুদ্ধ, তুমি জগতের ভগবান, তুমি সবাইকে যদি শ্রমণ্য ধম্মে দীক্ষা দাও তবে সংসার ধর্ম টিকবে কী করে। পিতা-মাতার সম্মতি না নিয়ে কাউকে শ্রমণ্য ধম্মে দীক্ষা দিও না। শুদ্ধোধনের আবেদনে সাড়া দিতে বাধ্য হন বুদ্ধ। পিতার সন্তানের প্রতি এই কাতর নিবেদনে হয়তো যুক্ত হয়েছিল পুত্রবধূর বিরহ বেদনার কান্নাগাথা। এবং প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ।

যশোধরা সম্বন্ধে যৎসামান্য যা জানা যায়, তা থেকে বোঝা যায় সিদ্ধার্থ সংসার ত্যাগের পর থেকেই গোপা জীবন বদলাতে শুরু করেন স্বেচ্ছায়। জাগতিক যাবতীয় ভোগ বিলাসের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি বেছে নেন ত্যাগ তিতীক্ষার জীবন। পরিধান করতেন চীবর, একবেলা আহার করতেন। সাত বছর ধরে বন্ধন ছিল সন্তানের, তাও তাঁর অমতে দীক্ষিত করেছেন বুদ্ধ। শাক্য রাজবংশ ধ্বংসের মুখে রাজপুরীময় বৃদ্ধ শুদ্ধোধনের বিলাপের সুর। মানবতার খাতিরে অসহায় বৃদ্ধ শশুরকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেননি গোপা। তা হলে যশোধরা কী করতে পারেন? তিনি ধিরে ধিরে নিজেকে পালটে নিলেন। অভিযোজন ঘটালেন যাপন চরিত্রের। ঘরেই দীক্ষাহীন যাপিত জীবনে তিনি প্রায় সন্ন্যাসীনী। যেতে চান বুদ্ধের সংঘে, কিন্তু স্বয়ং বুদ্ধ নারী সংঘের বিরোধী। অথচ সংঘেই তো রয়েছে তাঁর প্রাণনাথ, প্রিয় সন্তান। সে সিদ্ধার্থের স্ত্রী, রাহুলের মা। তাঁদের কাছাকাছি থাকতে পারলে অন্তত চোখে দেখাটি যায়, ভিক্ষুনী হিসেবেই মিলতে পারে সেই পরম সুযোগটুকু। তাঁর জীবনে তো আর ভূত-ভবিষ্যৎ নেই। অতএব দেহমনে ভূষণে-আহারে হয়ে উঠলে সংঘমুখী। প্রতিক্ষার, বিবর্তনের। শুদ্ধোধন সাতানব্বই বয়সে বুদ্ধের উপস্থিতে দেহত্যাগ করেন, তখন যশোধরা সংসারের যাবতীয় দায় দায়িত্ব, বাঁধন মুক্ত। পিতার মৃত্যুর পর পিতৃব্য পুত্র স্থবির আনন্দ ও মাতা গৌতমীর পুনঃ পুনঃ অনুরোধে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিলেন গৌতম বুদ্ধ। স্বয়ং বুদ্ধ বৈশালীতে যশোধরাকে উপসম্পনা প্রদান করেন। স্বামী রূপান্তরিত হলো প্রভু বুদ্ধ ভগবানে। ইতিহাসে এমন ট্রাজিক বিবর্তন আর দ্বিতীয়টি হয়তো নেই। ছিলেন যশোধরা হলেন ভদ্দকচ্চানা থেরী। এলো স্বামী-সন্তানের কাছাকাছি নারী সংঘে থাকার সুযোগ। আরাধনার অন্তরালে দু’বেলা স্বামী পুত্রর দর্শন তো মেলে স্ত্রী-জননী-ভিক্ষুণী-ভদ্দকচ্চানা থেরীর। এ যেন নয়নের মধ্যে নয়ন খোঁজা। ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে‘-রবীন্দ্রনাথের গানের কলি বেজে চলে অনন্ত সত্তায়। এক বিরহিত নারীর জীবনে এটুকুই শান্তি। ভদ্দকচ্চানা থেরী নারী সংঘের প্রধানও হয়েছিলেন নিজগুণে। শেষ জীবনে অর্হৎ প্রাপ্ত হন তিনি। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের দুই বছর পূর্বে তাঁর মৃত্যু হয়। সমাপ্ত হয় এক উপেক্ষিতা নারীর ধর্ম ইতিহাসের আখ্যান।

কিন্তু যুগের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার অভিমুখও বদলাতে থাকে। যশোধরার প্রতি ধর্ম ইতিহাস নির্মোহ হলেও বর্তমান কালের নারীবাদীরা বা নারী লেখিকারা অতটা নির্মোহ নয়। তাঁরা যশোধরার বিপন্নতায় সমব্যথী। যশোধরার নারীত্ব, বিপন্নতা ভিন্ন দৃষ্টিকোণে দেখতে চায়। তারা যশোধরার বয়ানে কৈফিয়ত চায় স্বয়ং বুদ্ধের কাছে। এই বয়ান রচনা বোধহয় সূচিত হয়েছিল কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবীর হাত ধরে। তিনি ‘Yashodhara, Wife and Disciple of Lord Buddha’ বই লিখলেন, যেখানে যশোধরা সব অর্থেই একজন পূর্ণাঙ্গ নারী। আখ্যানের মুখ্য চরিত্র। তাঁর স্বকীয়তা, মহিমা আছে। বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে সিদ্ধার্থ পর্যন্ত অনুভব করেন যশোধরার প্রতি পিছুটান। যেন ভ্রমের মধ্যে অনুভব করেন যশোধরা ডাকছেন, দুঃখ-কষ্ট-অনাহার থেকে ফিরে এসো নাথ। ঘরে তোমার সুন্দরী বিদূষী পত্নী যশোধরা আছে তো। সংসার ত্যাগী স্বামীর প্রতি নারীর এটাই ঐকান্তিক কামনা। তেমনি তামিল লেখিকা ভোল্গা (পাপুরি ললিতা কুমারী) ‘যশোধরা’ নামে একটি উপন্যাস লিখলেন। যশোধরার ব্যথা বেদনা হয়ে উঠল উপন্যাসের উপজীব্য। সবার প্রায় অলক্ষ্যে বাংলার দুই লেখিকা আরো খানিকটা এগিয়ে নিলেন যশোধরার অন্তর-সংলাপের কথা। তারা আরো সাহসী, প্রগতিশীল। তারা যশোধরার বলতে চায়, যশোধরার মনের কথা। ধর্মশাস্ত্রে যার অস্তিত্ব নেই। যশোধরা এক অনুভূতিশীলা নারী, ফলে তাঁর স্বামী সংসার ত্যাগের পর নিঃসন্দেহে তৈরি হয়েছিল আত্মসংলাপ। স্বামীর বিচ্ছেদ কেন্দ্রিক বেদনা, অভিমান, হতাশা, অনুযোগ, প্রতিবাদের কথা। সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ হয়ে ওঠার পিছনে নারীদের অবদান অনিস্বীকার্য। নারীর আনন্দ গীত শুনে বদলে যান গৌতম। ভ্রমণ সেরে সিদ্ধার্থ যখন ফিরছিলেন কৃশা গৌতমী নামের এক নারী তার প্রাসাদ-অলিন্দে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখে আনন্দ গীতি গেয়েছিলেন —

নিব্বুতা নূন সা মাতা, নিব্বুতো নূন সো পিতা।

নিব্বুতা নূন সা নারী, যস্‌সায়ং ঈদিসো পতী তি।।

এই গীত শুনেই সংসারের মায়া ত্যাগ করে প্রব্রজ্যা নিয়ে নিবৃত্তির সন্ধানে সেই রাত্রেই গৌতম গৃহত্যাগ করেছিলেন। সুজাতা, নিগারমাতা বিশখা, মগধরাজ বিম্বিসারের প্রথম স্ত্রী অসাধারণ রূপবতী রানি ক্ষেমা শ্রমণা, শ্রাবস্তীর সুন্দরীশ্রেষ্ঠা উৎপলবর্ণা, বুদ্ধিমতী বারবনিতা অম্রপালী, পটাচরা, নন্দা থেরী, শ্যামাবতী, সুপ্রবাসা বা সুপ্রিয়ার মতো অসংখ্যা নারীর সেবা গৌতমকে সাহায্য করেছে পরমসম্বোধী প্রাপ্ত হতে, সংঘ চালনা করতে এবং ধম্ম প্রচার করতে। কেউ দিয়েছেন বিহার নির্মাণ করে, কেউ দান করেছেন ধন-সম্পদ-ঐশর্য-অম্রকানন। রানি ক্ষেমা শ্রমণা ছিলে বুদ্ধের দক্ষিণহস্ত মহাশ্রাবিকা, উৎপলবর্ণা বামহস্ত হিসেবে তাঁর সহচর্য লাভ করেছেন। নারীর সেবা সহচার্য ব্যাতীত সিদ্ধার্থের বোধিত্ব প্রাপ্তি এবং সংঘ-বিহার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধম্ম প্রচার কতটা হতো তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। অথচ গৌতম বুদ্ধ প্রথমে নারী সংঘের ব্যাপারে ছিলেন কঠোর, রাজি ছিলেন না নারী সংঘ প্রতিষ্ঠার। চাননি যশোধরা, মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে ভিক্ষুণী হিসাবে সংঘে নিতে। গৌতমের এই দ্বিমুখী অবস্থান যশোধরার নারীত্বে ঈর্ষা, অভিমান, ক্ষোভ সঞ্চিত হতে স্বাভাবিকভাবে ইন্ধন যোগায়। একালের লেখিকা অমৃতা খেটো বেশ কয়েকজন উপেক্ষিতা নারীর কাল্পনিক কথন চিঠি নিয়ে লিখলেন ‘সরোবরময়ীর পত্র’-এ। তাতে স্থান পেয়েছে ‘একান্ত অনুগামী ভার্যা গোপা’ ‘চীবরধারিণী রাহুলমাতা’ এবং ‘তোমার চরণে স্থিরমতি ভিক্ষুণী ভদ্দকচ্চানা থেরী’ নামে যশোদার তিনটি চিঠি। চিঠিগুলি যেন বেদনা, অভিমান, হতাশা, অনুযোগ, প্রতিবাদের আত্মসংলাপী স্বর। চাইছেন বুদ্ধের কৈফিয়ত। বস্তুত এসব নারীত্বের মর্মকথা। কাল্পনিক সংলাপ আরো প্রকট হয়ে ওঠে সাধনা বড়ুয়া রচিত ‘সুজাতা ও যশোধরা’ শ্রুতিনাটকে। বৌদ্ধ ধর্ম সাহিত্যে এমন প্রমাণ মেলে না যে সুজাতা ও যশোধরার কখনও সাক্ষাত হয়েছিল বা মুখোমুখী হয়েছিলেন। এই নাটকে তেমন একটি কাল্পনিক সাক্ষাৎকারে রক্ত মাংসের জাগতিক যশোধরার বেদনার মর্মকথা লিখলেন তিনি। দুই একটি সংলাপ দেখে নেওয়া যেতে পারে-

“সুজাতা।। আপনি সম্রাজ্ঞী, মাননীয়া, এমন দৈবপুরুষের সহধর্মিনী হতে পেরেছেন।

যশোধরা।। কে হতে চায় সম্রাজ্ঞী? চাই না, চাই না এসব কিছু চাই না। আমি এক সাধারণ নারী। স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলাম।রাজপুত্র সিদ্বার্থকে ভালবেসেছিলাম। অথচ আজ দেখ আমাকে, স্বামী নেই, সংসার নেই, এই রাজপ্রাসাদের এককোণে আশ্রিতার মতো বেঁচে আছি। তুমি তাকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছ।“

বা যশোধরা যখন বলেন “তুমি কি করে বুঝবে সুজাতা এই হারিয়ে ফেলার কষ্ট। অথচ রাজপুত্র সিদ্ধার্থ আমাকে নিজে নির্বাচন করেছিলেন, তোমাদের বুদ্ধ আমার কাছে রক্ত-মাংসের একজন মানুষ। আমার স্বামী। আমি প্রত্যেক মুহূর্তে হেরে যাই আমার সুখ-দুঃখের চাহিদার কাছে।“ অজান্তা গুহাচিত্রে কপিলাবস্তুত রাজপ্রাসাদে বুদ্ধ ও যশোধরা-রাহুলের সাক্ষাকার মুহূর্তের একটি অসাধারণ চিত্র আছে। চিত্রে রয়েছেন জ্যোতির্ময় বুদ্ধের এবং সামনে যশোধরা-রাহুল। স্ত্রী-পুত্রের মুখ যন্তণাকাতর। শিল্পীর অনুভূতি এড়ায়নি মা-সন্তানের মনোকষ্ট। কথিত, বুদ্ধ এই সাক্ষাতে যশোধরার ধৈর্য, সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেছিলেন কিন্তু কথোপোকথনে যশোধরা কী বলেছিলেন তা যথারীতি উহ্য। শিশু পুত্র রাহুলের পিতাকে দেখে কী-ই বা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? এবং স্বামী পরিত্যক্তা যশোধরার স্বামীর কাছে তো কোনো না কোনো আর্তি ছিলই। না বলা বা উহ্য কথার মনস্তাত্ত্বিক পরিসরও ছিল। অজান্তা মন্দিরগাত্রের চিত্রের মতো নির্বাক রয়ে গেছে সংলাপে যশোধরার কথন। স্বাভাবিকভাবেই এযুগের লেখকরা এক উপেক্ষিতা নারীর নীরব সংলাপের কথা ও মনস্তাত্ত্বিক ভাষ্য রচনা করবেন। রক্ত মাংসের যশোধরার অনুভূতি প্রকাশ করবেন। সেই সংলাপই হবে আগামী দিনে যশোধরা পরিচিতির ভাষ্য।

পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারতের যুগ থেকে চৈতন্য যুগে সীতা, দ্রৌপদী, বিষ্ণুপ্রিয়া বা হাল আমলের যশোদাবেন-র আত্মবিলাপের কথন কোথাও যেন বিপন্ন যশোধরার কথনে একমেরুতে এসে দাঁড়ায়। রাজ নন্দিনী থেকে ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যশোধরা ত্যাগ তিতিক্ষার দহনে জ্বলতে জ্বলতে ভিক্ষুণী থেরীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু জীবনে রাজকীয় বা ধর্মীয় মহিমা অতিক্রম করে সারা বিশ্বের উপেক্ষিতা নারীর দলেই থেকে গেছেন শেষ পর্যন্ত। আজকের নারীরা যে তার জন্য কলম ধরার যোগ্য হয়ে উঠেছ সেটিই যশোধরার নারীত্বের জয়।

তথ্যসূত্র :

১। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস -ডঃ মণিকুন্তলা হালদার (দে)। মহাবোধি বুক এজেন্সী, কলকাতা-৭০০০৭৩।

২। ছোটগল্পের বিষয়-আশয় -সুমিতা চক্রবর্তী। পুস্তক বিপনী, কলকাতা-৭০০০০৯।

৩। সুজাতা ও যশোধরা- সাধনা বড়ুয়া। পঞ্চদশ শ্রুতিনাটক -সম্পাদনা প্রীতিশেখর। লালমাটি, কলকাতা-৭০০০৭৩।

৪। সরোবরময়ীর পত্র -অমৃতা খেটো। কবিতিকা, পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১১০২।

৬। সুমনপাল ভিক্ষু-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা।

৭। গুগলস, উকিপিডিয়া।

(‘সংকটকাল ও বিনির্মাণযাত্রা’ প্রবন্ধ সংকলনে গ্রন্থিত। প্রকাশক: একুশ শতক)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন