আমবারুনির দিন ঘরের মেয়ে দুর্গাকে আরাধনা। আরামবাগের গড়বাড়ির দিঘীর পাড়ে শতাধিক বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের সম্প্রীতির সাক্ষী আজও বহন করে আসছে। অসময়ে দুর্গার আরাধনা ও সেই সঙ্গে সাতদিন ধরে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম আজও চলে আসছে। বিশ্বাস আর ভক্তি-দুইয়ের টানে লক্ষাধিক লোকের সমাগম। ‘অসময়ে দুর্গাকে আবাহন। আর পুষ্পাঞ্জলি অবনত মস্তকে। শ্রদ্ধা কেবল হিন্দু নয়, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষও হাজির হন। এ যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলন মেলা। প্রতি বছরের মতো এবারেও শুরু হয়েছে আরামবাগের ডিহিবায়রা গ্রামে দিঘির পাড়ে। অর্থাৎ আরামবাগের দিঘির মেলা। এক কথায় সকলে চেনে। প্রতি বছর বারুণীর দিন থেকে শুরু হয় মেলা। চলে সাত দিন। যদিও সরকারি অনুমতি তিন দিনের। সাত দিনে লক্ষাধিক লোকের সমাগমে এলাকায় সাজ সাজ রব হয়ে উঠেছে। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয়দের ভিড়। এর পাশ্ববর্তী জেলাগুলি থেকে ছোটো-বড় ব্যবসায়ীদের আগমন। এই আনন্দের জোয়ারে গা ভাসান শিশু, আবাল, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। সকলে অধীর আগ্রহে থাকেন এই মেলার জন্য। বারুণীর দিন থেকে মেলা শুরু। চলে সাত দিন। প্রসঙ্গত, এই দিঘির মেলা শতাধিক বছর আগে। কথিত আছে এই মেলার এক ভক্তিমূলক কাহিনী।
সে কাহিনি আজও এখানকার লোকমুখে প্রচলিত। স্থানীয় গড়বাড়ির রায় বংশ এই মেলার প্রতিষ্ঠাতা। মেলার প্রথম শুরুর কথা বলতে গিয়ে এই বংশেরই সদস্য পলাশ রায় এক কাহিনি শোনালেন। যে কাহিনি মানুষ আজও বিশ্বাস করে আসছে।অনেকের অলৌকিক মনে হলেও, এটাই বাস্তব সত্য বলে পলাশবাবু জানালেন। তিনি বলেন, — প্রায় ৪০০ বছর আগে রায় বংশের প্রথম পুরুষ ছিলেন রণজিৎ সিংহ রায়। ইনি রাজস্থানের রাজপুতনায় ছিলেন। গড়বাড়িতে এসে বসবাস শুরু করেন। মা দুর্গার তিনি একনিষ্ঠ ভক্ত ও সাধক ছিলেন। পাশে বিক্রমপুর গ্রামে জঙ্গলে ঘেরা বিশালাক্ষ্মী মন্দিরে সাধনা করতেন। একদিন মন্দিরের পাশে জঙ্গল থেকে একটি সদ্যজাত কন্যা সন্তানকে কুড়িয়ে পান এবং বাড়িতে নিয়ে যান। দুর্গা স্বপ্ন দেন মেয়ে রূপে তাঁর বাড়িতে এসেছেন। যেদিন রণজিৎ নিজ মুখে বলবেন সেদিন চলে যাবেন। পালিতা কন্যা বড়ো হচ্ছে জমিদার রণজিৎ সিংহ রায়ের বাড়িতে। একদিন মেয়ে বললেন, এলাকায় একটি বড়ো পুষ্করিণীর প্রয়োজন। গ্রামের মানুষ যাতে জলকষ্টে না পড়েন। এটা ভেবেই মেয়ের কথা শুনে রণজিৎ ডিহিবায়রা গ্রামে ১৩১ বিঘা এলাকা জুড়ে দিঘি খনন করলেন। জলাশয়ের এলাকা ৮০ বিঘা এবং দিঘির চারধারে মোট পাড় হল ৫১ বিঘা। দিনক্ষণ স্থির হল দিঘি প্রতিষ্ঠা হবে। তার আগে দিঘির মাঝখানে জাঠ কাঠ পোঁতা হবে। জাঠ কাঠ কোথায়? দুর্গা স্বপ্ন দিলেন রণজিৎকে, দ্বারকেশ্বর নদী থেকে ভেসে আসবে গীর্জা তলায় জাঠ কাঠ। ওই কাঠই পোঁতা হবে। রণজিৎ ৩০ জন লোক নিয়ে পরদিনই গির্জা তলায় গেলেন। দেখলেন কাঠ। কিন্তু ৩০ জন লোকে তুলতে পারলেন না। এ সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন সাধক অভিরাম গোস্বামী। অভিরাম গোস্বামী একপাশ ধরলেন। বাকি লোকেরা আর একপাশ। এভাবেই নিয়ে এসে জাঠ কাঠ পোঁতা হয়েছিল। এরপর হোমযজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠা। গ্রামের সকল মানুষ জড়ো হয়েছেন দিঘির পাড়ে। রণজিৎ বাড়ির সেরেস্তায় বসে চাষিদের নিয়ে সভা করছেন। এ সময় পালিতা কন্যা বাবাকে জিজ্ঞাসা করছে-‘বাবা আমি যাব দিঘিতে’। একবার নয়, তিনবার মেয়ে জিজ্ঞাসা করল। বাবা তিতিবিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুই যেখানে খুশি যা’। মেয়েটি এরপর চলে যায়। মেয়েটি দিঘির দক্ষিণ পাড়ে গিয়ে এক শাঁখারির কাছ থেকে শাঁখা পরে। শাঁখারি পয়সা চাইলে, মেয়েটি বলে-আমার বাবা রণজিৎ সিংহ রায়। বাবাকে গিয়ে বল, দক্ষিণ দিকের ঘরে আলোচালের হাঁড়িতে টাকা আছে। দিয়ে দেবেন। শাঁখারি শাঁখা পরিয়ে সন্ধের সময় রণজিৎ-এর বাড়িতে যান। রণজিৎকে বলেন, আপনার মেয়ে শাঁখা পরেছে, টাকা দিন। বাবা অবাক হন। দেখেন মেয়ে ঘরে। শাঁখারি বলছে কী। শাঁখারির সঙ্গে রণজিৎ দিঘির পাড়ে যান। এরপর কাকুতি মিনতি করেন, একবার মা দুর্গাকে দেখার জন্য। শাঁখা পরেছে–এটা দেখার জন্য রণজিৎ অশ্রুনয়নে মেয়েকে ডাকতে থাকেন। এরপর মা দুর্গা দিঘি থেকে দু হাত তুলে শাঁখা দেখান। দিনটা ছিল বারুণী। এদিনেই জমিদার রণজিৎ দক্ষিণ পাড়ে দুর্গার প্রতিমা গড়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। এদিন থেকেই শুরু হয় মেলা। সেই সঙ্গে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী চারদিন ধূমধামের সঙ্গে পুজো যেমন হয়, তেমন মেলাও বসে। অকালে দুর্গার আবাহন হলেও এলাকায় শ্রদ্ধা ও ভক্তির খামতি নেই। এ ঘটনা আজ নাস্তিকদের কাছে অবাস্তব, অবান্তর, রীতি প্রথার বহির্ভূত হলেও আস্তিকেরা আজও একে হৃদয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্থান দিয়েছে। ‘দিঘির জল যেমন পবিত্র এখানকার মানুষের কাছে, তেমনি দিঘির পাড়ে মন্দিরের বিরাজকে আজও নিত্য সেবার মধ্যে টিকিয়ে রেখেছে। যা আজ কেবল এলাকার মানুষের কাছে এক তীর্থক্ষেত্র। এককথায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছে এই দিঘি। এই মেলার বৈশিষ্ট যাঁরাই এখানে আসেন দিঘির জলে স্নান, তারপর মন্দিরে পুজো দেন। সেই সঙ্গে কেনাকাটা করেন। এই মেলায় সমস্ত রকমের জিনিস বিক্রি যেমন হয়, তেমনি বিনোদনের জন্য ছোটোখাটো সার্কাস, মরণকূপ খেলা, নাগরদোলাও বসে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, কামাররা তাদের তৈরি দা, কুড়ুল, বঁটি, কাস্তে, হাতুড়ি সব জিনিসই মেলায় বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। কুমোররাও হাতে গড়া সুন্দর মাটির পসরা সাজায়। ছুতোরেরা বাড়ির দরজা জানালা নিয়ে হাজির হন। তাছাড়া মনোহারী জিনিস যেমন আছে, তেমনি রকমারি মিষ্টি ও তেলেভাজার দোকানও মেলায় দেখা যায়। পোশাকের দোকানও মিলবে। আর মিলবে বিভিন্ন ধরনের পাখি। সস্তা দরে। যদিও বিক্রি নিষিদ্ধ। সরকারি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খাঁচায় বন্দি করে হাজার হাজার পাখি নিয়ে এখানে সাতদিন ধরে বিক্রি চলতে থাকে। আর মাদুর শিল্পীদের দেখা তো মিলবেই। পছন্দসই জিনিসও পেয়ে যাবেন। গরমের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য হাতে তৈরি তালপাতার পাখাও কিনতে পারবেন। বৈদুতিক পাখা তো আছেই। জেলেদের মাছ ধরার বিভিন্ন জাল, ঘুনি, পিলুই, পাং এর দেখা মিলবে। এক কথায় বলা যায় মানুষের নিত্য ব্যবহার্য সব জিনিসই এই মেলায় পাওয়া যায়। মেলায় প্রতি বছর ৩০০–র বেশি দোকান থাকে।একদিনই এদের কাছ থেকে সামান্য টাকা তোলা হয়। যা দিয়ে মন্দিরের পুজো হয় চারদিন। বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা মেলায় আসেন। এই মেলা আরামবাগের বৃহত্তম ও হুগলি জেলার অন্যতম মেলা বলে বিশেষ স্থান পেয়েছে।
প্রসঙ্গত, প্রতি বছর এই সময় মেলা হয়। পলাশ বলেন, যেটা বহুদিন ধরে চলে আসছে, যা আজ পর্যন্ত দিন বদলায়নি। তা পালটানো সম্ভবও নয়।
এদিকে দিঘির দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ৩ বিঘা জমি দান করা হয়েছে কৃষি বিকাশ শিল্প কেন্দ্রকে। এরা এখানে ১০০ শয্যার একটি বৃদ্ধাবাস গড়বে। স্বাস্থ্য পরিষেবা যেমন থাকবে, তেমনি বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের মানসিক শান্তি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থা থাকছে। খুব শীঘ্রই কাজ শুরু হবে বলে পলাশবাবু জানিয়েছেন।