এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শত বছর পেরিয়েছে। তার মধ্যে ৭০ বছরের বেশি তারা সংসদীয় রাজনীতি চর্চায় যুক্ত। তা স্বত্বেও আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে সেই কমিউনিস্ট পার্টি তথা বামেদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এই নির্বাচনেও তারা নির্ণায়কের ভূমিকা যেমন নিতে পারবে না তার থেকেও বড় কথা তারা তাদের উপস্থিতি জানান দিতে পারবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। যদি বা থাকেও তা এতটাই কম যে, তা উপেক্ষার পর্যায়ে পড়ে যাবে। দিল্লির জেএনইউতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জয়-জয়াকার যে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রভাব বিস্তার করে না তা বুঝতে হবে। একথা ঠিক, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় একদিন বামেদের মজবুদ ঘাঁটি ছিল। কারণ, এখানে তারা সংগঠন করতে সমর্থ হয়েছিল, তাই ভোটও পেত। কিন্তু এই তিন রাজ্যেই তাদের সাংগঠনিক শক্তি ছত্রাখান হয়ে গিয়েছে, তাই প্রাপ্তিও আজ শূন্যে এসে ঠেকেছে।। তবে চব্বিশের লোকসভা লড়াইতে তারা এই তিন রাজ্য ছাড়াও অন্যান্য রাজ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছে। সেই সঙ্গে এবারের লড়াই বামেদের কাছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার, তাই বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা, তামিলনাড়ুতে ডিএমকের সঙ্গে জোট করে, রাজস্থান, ত্রিপুরায় কংগ্রেস ও বিহারে আরজেডির সঙ্গে জোট করে, অন্ধ্রপ্রদেশেও জোটবদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকটি আসনে বামেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এবং এবারের লড়াইয়ে তারা যথেষ্ট আশাবাদী।
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্য, দেশে বিকল্প বাম ও গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার তৈরি করতে সংসদে বামেদের বিশেষ করে সিপিএমের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা জরুরি। কিন্তু দেখার বিষয়, সেই আসন সংখ্যা বাড়াতে তারা কী কৌশল নিয়েছে , কোন কোন বিষয়ের উপর ফোকাস রেখেছে কিংবা এজেন্ডা নির্ধারণ করেছে। বামেরা মনে করে, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এজেন্ডা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে তারাই। বামেদের রণকৌশলে বেশ কয়েকটি ইস্যু যেমন, ৩৭০ ধারা, সিএএ, কৃষি আইন, নির্বাচনী বন্ড হাতিয়ার। উল্লেখ্য, গত পাঁচ বছরে বিজেপি যে সব ইস্যুতে জাতীয় ক্ষেত্রে আলোড়ন ফেলেছে বামেরা সেগুলির বিরোধিতা করেছে কারণ, এই ইস্যুগুলিকে তারা সংবিধানের পরিপন্থী বলে মনে করে।
শেষ বিধানসভা নির্বাচনে বিহারে বামেরা উল্লেখ করার মতো সাফল্য পেয়েছিল।২৯টি আসনে লড়াই করে তাঁর জিতেছিলেন ১৬টি আসন। এর মধ্যে সিপিআইএমএল লিবারেশন একাই জিতেছিল ১২টি আসন। সিপিআই এবং সিপিআইএম জিতেছিল ২টি করে আসন। কংগ্রেস ৭০টি আসনে লড়েও জিতেছিল মাত্র ১৯টি আসন। অর্থাৎ স্ট্রাইক রেট সবচেয়ে ভালো ছিল বামেদের। ওই বিধানসভা নির্বাচনের পর চার বছর কেটে গিয়েছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) এবং কংগ্রেসের একাধিক বিধায়ক দল বদল করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছে। কিন্তু একজন বামপন্থী বিধায়কও শিবির বদল করেননি। বরং বিধানসভার ভিতরে এবং বাইরে তাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে নিজেদের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং জোরালো কণ্ঠস্বর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এবার বিহারে ১৯টি আসন জেতা কংগ্রেসের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ৯টি আসন৷ আর ১৬টি আসন জেতা বামেদের জন্য মাত্র ৫টি আসন! কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের স্ট্রাইক রেটের হিসাব মাথায় রেখে বামেদের জন্য এবার আরও আসন ছাড়া উচিত ছিল। তাতে মহাজোটেরই লাভ হত।
রাজনৈতিক বিশেষঙ্গদের ধারণা, কেরলের পর এবারের লোকসভা নির্বাচনে বামেদের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের ফাইট হবে বিহার। যদিও হিন্দি বলয়ে লাল পতাকার জোর তেমন শক্তপোক্ত নয়৷ কিন্তু এবার এ রাজ্য থেকে একাধিক বাম সাংসদের পার্লামেন্টে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিহারে সিপিআইএমএল লিবারেশনের পক্ষে আরা, কারাকাট এবং নালন্দায় লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হলেও বিধানসভা নির্বাচনের হিসাবে তাদের পাল্লা ভারী। আরায় ১৯৮৯ সালে ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়েছিলেন রামেশ্বর প্রসাদ। গত লোকসভা নির্বাচনেও আরজেডির সমর্থনে লিবারেশনের প্রার্থী রাজু যাদব ৪,১৯,১৯৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। এ বছরও আরা লোকসভায় বামেরা আশার আলো দেখছেন। খাগাড়িয়া আসনে লড়বে সিপিএম, বেগুসরাইতে সিপিআই। লড়াই কঠিন হলেও গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে বামেরাই এগিয়ে আছে।
অন্যদিকে ঝাড়খণ্ডের কোডারমা আসনে ইন্ডিয়া ব্লকের প্রার্থী হিসাবে লড়ছে সিপিআইএমএল লিবারেশন। এখানে লিবারেশনের সংগঠন বেশ শক্তিশালী।২০১৪ সালে জেলবন্দি অবস্থায় লড়ে লিবারেশন প্রার্থী রাজকুমার যাদব ২ লক্ষ ৬৬ হাজার ৭৫৬ (২৬.০৩ শতাংশ) ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। তবে ২০১৯ সালে দীর্ঘদিনের আরজেডি নেতা অন্নপূর্ণা দেবী যাদব বিজেপিতে যোগ দিয়ে বিরাট ভোটে জয়ী হন। এবারের নির্বাচনে লড়াই দ্বিমুখী। লিবারেশন বনাম বিজেপি। কোডারমা লোকসভার ৬টি বিধানসভার তিনটিতে বিজেপি বিধায়ক থাকলেও বাগোদর বিধানসভায় সিপিআইএমএলের বিধায়ক। তাছাড়াও ধানিয়াড় বিধানসভাতে ২০১৪ সালে লিবারেশন প্রার্থী জয়ী হয়েছিল। জামুয়া বিধানসভাতেও লিবারেশন শক্তিশালী। সব মিলিয়ে কোডারমার লড়াইতেও বামেরা জেতার আশা দেখছেন। বাংলা কিংবা ত্রিপুরায় বামেরা গত কয়েক বছর ধরে বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে এই দুই রাজ্যে তাদের ফলাফল কতখানি আশাপ্রদ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যদিও বঙ্গের মুর্শিদাবাদ আসনে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম কংগ্রেস বিশেষ করে অধীর চৌধুরীর সমর্থনে লড়ছেন। অন্য জন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী লড়ছেন দমদমে। সিপিএমের হিসাবে দু’টি আসনই ইতিবাচক। এই দুটি আসনে আশার আলো থাকলেও প্রবল প্রতিপক্ষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে ফাইটে জেতার মতো আর কি কেউ আছে? অতি বড় বামপন্থী সমর্থকের পক্ষেও আশাবাদী হওয়া মুশকিল।