আধুনিক যুগ যান্ত্রিকতার যুগ। যন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে মানুষও আজ যন্ত্রে পরিনত হচ্ছে। তার যন্ত্র সত্ত্বা আর মানব সত্ত্বা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তার প্রভাব পড়ছে শিশুদের উপর। কারণ বড়োরা যা করে, শিশুরা তা অনুকরণ করে। এভাবেই তার মনে সেই ঘটনার প্রভাব পড়ে। স্বভাবও তৈরি হয় এভাবেই, তা সে সু-ই হোক আর কু-ই হোক। এজন্য বলা হয় শিশুর স্বভাব তৈরি করে তার পরিবার, তার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, গুরুজন কিম্বা তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, তার সমাজ। এর মধ্যে বাড়িই আদর্শ স্থান। কারণ — Home is the first school, where the child learns his /her first lesson.
প্রত্যেকটা শিশুর নিজস্ব একটা জগৎ থাকে, সেই জগতেই সে বিচরণ করতে ভালোবাসে। কেউ হয়তো ছবি আঁকতে ভালোবাসে, কেউ গান গাইতে, কেউ নাচতে আবার কেউ কেউ হয়তো ছবি দেখতে, গল্পের বই পড়তে, টিভি দেখতে, গল্প করতে বা খেলতে ভালোবাসে। সেই জগৎ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা মানেই তার স্বাধীন সত্তাকে নষ্ট করে দেওয়া। একে এই অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তার মনে একটা নেতিবাচক প্রভাব (Negative effect) পড়ে। সে অবদমিত হয়ে পড়ে, হীনমন্যতায় ভোগে। কিন্তু কথা হচ্ছে শিশুদের এই অসহিষ্ণুতার কারণ কী?
সহ্যশক্তি বা সহনশীলতা মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু আজকের শিশু বোধ হয় সহনশীলতা হারাতে বসেছে একটুতেই উত্তেজিত হয়ে পড়া, জেদের বশে খারাপ কিছু করে ফেলা, আত্মহনন ইত্যাদির মত কাজ হচ্ছে আকছার। আবার মাত্র ২০ টাকা ধার নিয়ে শোধ করতে না পারায় সহপাঠীর হাতে সহপাঠী খুন। সামান্য বিষয় নিয়ে বন্ধুতে বন্ধুতে মারপিঠ, চুল ছেঁড়াছিঁড়ি খরবের কাগজের পাতায় নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সম্পত্তির লোভে ছেলের হাতে বাবা খুন, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রেমিকের হাতে খুন প্রেমিকা এ জাতীয় নানা খবর আমরা প্রতিনিয়ত পড়ে থাকি খবরের কাগজে। এর একটাই কারণ আজকের শিশু বড়োই অসহিষ্ণু। মাথা ঠাণ্ডা করে কোন কিছুর মীমাংসা করার মত সহনশীলতা এদের নেই।
এর কারণ আজকের শিশু না চাইতেই সবকিছু পায়। জন্মের পর থেকেই বাবা মা নিজে না খাইয়ে ছেলে মেয়েকে সবটুকু উজাড় করে দিতে চায়। না চাইতেই একের পর এক জিনিস এনে ঘরে পাহাড় করে। আর শিশু আধখাওয়া করে ফেলে দেয়। পরিবর্তে তুলে নেয় আর একটা নতুন জিনিস। এভাবেই হাতের কাছে সব জিনিস পেয়ে তাদের অভ্যাস এমন হয়ে পড়ে যে, পরবর্তীতে তা না পেলে যেনতেন প্রকরণে হোক সেটা আদায় করতে তৎপর হয়, সেটা যে কোন কিছুর বিনিময়ে। দোষটা তো আমাদেরই। সে সুযোগ তো শিশুকে আমরাই করে দিয়েছি।
শিশুদের মধ্যে একটা কৃত্রিম অভাব তৈরি করতে হবে, যাতে সে চাইতে না চাইতেই কোন জিনিস পায়। তবেই তো সে জিনিসের কদর বুঝবে। একটা জিনিস আধখানা খেয়ে ফেলে দেওয়ার জ্বালা তো তাকে বুঝতে দিতে হবে। আমার মনে আছে ছোটবেলায় তখন খুব সম্ভবত ক্লাস সেভেনে পড়ি। পূজার অন্তত দুমাস আগে বাবার কাছে বাইনা নতুন শু কিনে দিতে হবে। নেহাত একজোড়া শু, দামটাও কম নয়। তাই কি আর কিনে দেবেন বাবা!
শুরু হল বায়না। মাকে বলেও কাজ হল না। বাবার কথায় শেষ কথা। ‘তোমার বাবা যখন বলেছে, তার মুখের উপর কথা বলা আমার সাধ্যি কি?’ — মার স্পষ্ট জবাব। অনেক অনুনয় বিনয়। ‘আমি কিন্তু ভাত খাব না।’
‘না খেয়ো না খেয়ো।’ — বাবার স্পষ্ট জবাব। শেষে দু-মাস বাদে পুজো এল। সপ্তমীর সন্ধ্যা। জুতো কিনে না দিলে ঠাকুর দেখতেও যাব না।
বাবা এবার আমার কাছে হেরে গেল। শেষে আমার পছন্দমত জুতো পেলাম। তাহলে দু-মাস অনবরত একই বায়না করে জুতোটা পেলাম। আর এখন হলে ছেলে যেদিন বলবে সেই দিনই চায়। না হলে ছেলে ভয় দেখাবে ‘আমি চললাম।’ ভয়ে তো মা বাবার মুখ চুন। অগত্যা কিছু করার থাকে না। কিনে দিতে বাধ্য। এই কৃত্রিম অভাবটা আজকের ছেলেমেয়েদের বুঝতে দেওয়া হয় না বলেই আজকের ছেলেমেয়ে এত অসহিষ্ণু।
তাই অভিভাবক/অভিভাবিকাদের কর্তব্য আপনার বাচ্চাকে কৃত্রিম অভাবে রাখুন। সহ্য করার মত মানসিকতা গড়ে তুলুন শিশুকাল থেকেই। তবেই তো বড়ো হয়ে তার সহনশীলতার পাশাপাশি সবকিছুকে মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠবে। আবার কিছুকিছু ছেলেমেয়ে দেখা যায় তারা অত্যন্ত ঘরকুনো স্বভাবের। হাতে স্মার্টফোনে ব্যস্ত অধিকাংশ সময়। তাছাড়া যে সমস্ত ছেলেমেয়েদের বাবা মা চাকরি বাকরি করেন তাদের তো কোন কথাই নেই। তারা খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়। তারা না পায় মা বাবার স্নেহ, আদর, না পায় তাদের ভালোবাসা। এজন্য এসমস্ত শিশুগুলি ego centric হয়ে পড়ে। খুব সামান্য মানসিক আঘাতও তারা সহ্য করতে পারে না। কারণ তারা কখনও কারো কাছে আঘাত পেতে শেখেনি। ঘাত প্রতিঘাতেরর মধ্য দিয়ে সে বড়ো হয়নি। সে শুধু চেনে নিজেকে। তার বাবা মা তাকে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। এটা অভিভাবকদেরই দোষ বলতে হয়।
সবশেষে একথায় বলব আজকের শিশু যেভাবে সহিষ্ণুতা হারাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী দিনে তা এক ভয়াবহ আকার নেবে। সমাজে সহিষ্ণুতা বলে কিছু থাকবে না। আজকের সমাজ ঠিক সেদিকেই এগুচ্ছে।
প্রসেনজিৎ দাস, বিষ্ণুগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেতাই, নদিয়া।
Thank you…