সারসংক্ষেপ : শত শত বছর ধরে ভারতবর্ষে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী বৈষ্ণব ধর্ম ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপজীব্য। কিন্তু কৃষ্ণের দয়িতা রাধার প্রেমকে কেন্দ্র করে যে ভাবরসের সৃষ্টি হয়েছে, তার আবেদন বৈষ্ণব সাহিত্যের আঙিনা ছাড়িয়ে সমগ্র ভারতের সামগ্রিক সাহিত্য ভান্ডারেই পড়েছে। ধর্মীয় বলয়ে ধর্মবেত্তাদের মনে যেমনি, সাহিত্যাঙ্গনে ও আধ্যাত্মিক বলয়ে বৈষ্ণবশাস্ত্রীদের মনে তেমনি, আবার নৃবিজ্ঞানের ও ইতিহাসের পাঠকদের মনেও স্বভাবতই এই প্রশ্ন উদিত হয়েছে, কে এই রাধা? তিনি কি সাহিত্যের উপজীব্য মাত্র? তাহলে বৈষ্ণব ধর্মে তার এই চূড়ান্ত অধিষ্ঠানের পেছনের কারণ কি? পুরাণোক্ত রাধার কি কোন ঐতিহাসিক অস্তিত্ব রয়েছে? কৃষ্ণের সাথে রাধা যুক্ত হলেন কিভাবে? রাধা কি শুধুই কৃষ্ণের দয়িতা, নাকি তিনি আরো বেশি কিছু? এই প্রবন্ধে লেখক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বিস্তৃত আকারে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর ধর্মীয় অঙ্গন থেকে রাধা সাহিত্যে প্রবেশ করেছেন, নাকি তার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ছিলো ও পরে তিনি ধর্মীয় পরিসরে প্রবেশ করেছেন — সে বিষয়ে লিখতে গিয়ে কিছু যৌক্তিক অনুমানের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। রাধা বৈষ্ণব শাস্ত্রের আঙিনা পেরিয়ে তান্ত্রিক ও শাক্তদেরও আরাধ্যাতে পরিণত হয়েছেন। সেখানে তার রুপ কিরকম? লেখক সেই ধারণা দেয়ারও চেষ্টা করেছেন এই প্রবন্ধে। আর এই প্রবন্ধে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার মধ্য দিয়ে লেখক মূলতঃ রাধাকে একটি সামগ্রিক অবস্থান থেকে পাঠ করার চেষ্টা করেছেন। রাধা যেখানে সেখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই তার দয়িত বা প্রেমিক কৃষ্ণের প্রসঙ্গও উঠে আসবে। এখানেও তাই হয়েছে। রাধার ঐতিহাসিকতা বিচার করতে যেয়ে লেখক প্রাসঙ্গিকভাবে কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা নির্ণয় করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুমান এই প্রবন্ধে হাজির করার চেষ্টা করেছেন; বিশেষতঃ গোপ সম্প্রদায়ের মধ্যে বেড়ে উঠা কৃষ্ণ কি অন্ত্যজ শ্রেণীর প্রতিনিধি আকারে সমাজে প্রথম হাজির হয়েছিলেন? লেখক সেই প্রশ্নের উত্তরও এখানে পেশ করেছেন তার প্রাসঙ্গিক অনুমানের জায়গা থেকে।
ব্রহ্মের পরমকলা যে পদ্মিনী তা থেকে কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড উৎপন্ন হয়। এবং তার প্রসাদগুণেই রুদ্র, বিষ্ণু ও ব্রহ্মা সংহার, পালন ও সৃষ্টি কার্য্যে নিয়ত আছেন। পদ্মিনীর দেহকান্তিই প্রকৃতি এবং তার কোটি কোটি অংশ কোটি কোটি চন্দ্রমা। (রাধাতন্ত্রম, দেব্যুবাচ: ১২-১৪)
এক.
আমরা যারা হিন্দু বা সনাতন ধর্ম সম্পর্কে কিছু জানতে চাই তারা অবগত যে, কংসের অত্যাচারে ও অনাচারে যখন পৃথিবীর অবস্থা করুণ, তখন বৈকুন্ঠধামবাসী বিষ্ণু কৃষ্ণ নাম নিয়ে কংসের আপন ভগ্নীর পুত্র রুপেই ধরাধামে অবতরণ করলেন অর্থাৎ কংস বধের অভিপ্রায়ে তিনি অবতারত্ব গ্রহণ করলেন এবং নিজের মৃত্যুর বিষয়ে কংস যেহেতু গণক ও ধর্মীয় পন্ডিতদের মাধ্যমে আগে থেকেই জ্ঞাত ছিলো, সে তাই নিজের মৃত্যু ঠেকাতে একের পর এক তার বোনের সদ্যজাত সন্তানদেরকে হত্যা শুরু করলো। কৃষ্ণ ছিলেন তার পিতা-মাতা অর্থাৎ, বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম সন্তান, যিনি ছিলেন একমাত্র পুত্র সন্তান এবং বিষ্ণুর অবতার, সেই কৃষ্ণ অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান এবং গোকুলে পালক পিতা-মাতা নন্দগোপ ও যশোধার গৃহে প্রতিপালিত হন। এই গোকুলেই তার সাক্ষাৎ হয় তার ভবিষ্যৎ প্রেয়সী গোপকন্যা শ্রীরাধিকার সাথে, যাকে বৈষ্ণবকুল বিশেষতঃ বঙ্গে সবাই রাধারাণী নামেই ডাকতে বিশেষ ভালোবাসে। এহলো রাধাকে জানবার প্রথম পাঠ। কিন্তু বৈষ্ণব শাস্ত্রে রাধার ব্যাখ্যা আরো ব্যাপক। তিনি ব্রহ্মের পরম প্রকৃতি। তিনিই জগজ্জননী ও সৃষ্টির আদি কারণ, অর্থাৎ জগৎকারণ। তবে তিনি আদিতে কিভাবে এই জগজ্জননী এবং কৃষ্ণের সমবায়িনী শক্তি অর্থাৎ কৃষ্ণের সামগ্রিক সৃষ্টিশক্তির মূলপ্রবাহ হয়ে উঠলেন তার ব্যাখ্যা প্রথমে আমরা যে জায়গাগুলো থেকে আলোচনা করবো, সেগুলো করবো বৈষ্ণব ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবশাস্ত্রের ধারামতে, শাক্ত ও তান্ত্রিকদের চিন্তার আলোকে এবং রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাজ্ঞজনদের চিন্তানুসারে। শশীভূষণ দাশগুপ্তের ব্যাখ্যার জায়গা থেকেও আমরা রাধাকে কিছুটা বুঝবার চেষ্টা করবো। কারণ রাধাপাঠকে বিশেষতঃ বঙ্গাঞ্চলে একাডেমিক ডিসকোর্স আকারে হাজির করার পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য । তবে শুরুতেই বলে নেয়া ভালো যে, রাধাকে বৃহৎব্যাপ্তীতে বোঝার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারাগুলোর মধ্যে মিলও আছে; যেমন: ধর্মীয় ব্যাখ্যার জায়গা থেকে রাধার উপস্থাপনে প্রায়শই শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাগুলো প্রায় সমান্তরাল। কারণ এই ব্যাখ্যাগুলোর জন্য ধর্মীয় নানান ধারা ও উপধারাসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই একই উৎসসমূহ ব্যবহার করেছে। (চলবে)