মদন উৎসব বা মদন মহোৎসব প্রাকহোলি যুগের এক প্রধান উৎসব। মূলত কামদেব মদন ও রতিকে উপলক্ষ করে গড়ে ওঠা এই উৎসবের আয়োজন করা হত অশোকবৃক্ষের নীচে।
মদনের পঞ্চশরের মধ্যে অন্যতম অশোকবৃক্ষের ডাল।
পরে রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলাও সংঘটিত হত অশোকবৃক্ষের নীচে। তাই দোল বা হোলি যে মদনোৎসবের সিকোয়েলি বা সম্প্রসারণ, তা বোঝাই যাচ্ছে।
অশোকবৃক্ষের দেবীর নাম শোকরহিতা। এটি নবপত্রিকারও একটি সদস্য। শোকরহিতা কোনও বৌদ্ধ দেবীর হিন্দু আত্তীকরণ হতে পারে। গৌতমবুদ্ধ যে লুম্বিনী বনের এক অশোকবৃক্ষ বা দোহলীর নীচে জন্মগ্রহণ করেন তা সুবিদিত।
হিন্দু দেবী শিবপত্নী গৌরী অশোকবৃক্ষের নীচে তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
ফলিত জ্যোতিষে আছে, ‘পুবী দোহলী গোননী গড়ূকাদয়ঃ’। এই দোহলী অশোকগাছ, না গাভীর দোহনে প্রাপ্ত দুগ্ধজাত ননী, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের কাছে জানা দরকার। তবে গড়ুক মানে গ্রন্থি। অশোকফুল কাণ্ডের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে ফোটে। তাই দোহলী এখানে অশোকবৃক্ষও হতে পারে।
দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও ‘জৈমিনি মীমাংসা’য় রং উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়।
৭ম শতাব্দীর এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্মাবলী’তেও হোলিকোৎসবের উল্লেখ আছে। এমনকি আল বেরুনীর বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোন কোন অঞ্চলে মুসলমানরাও হোলিকোৎসবে সামিল হতেন।
মধ্যযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলোর অন্যতম প্রধান বিষয় রাধা-কৃষ্ণের রঙ উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন বা দোলা থেকে দোল কথাটির উদ্ভব হয়েছে বলে প্রচলিত বিশ্বাস। তবে আমার গবেষণায় প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি, শ্রীকৃষ্ণ যে গাছে দোলনা বা ঝুলন বাঁধতেন সেই অশোকবৃক্ষ বা দোহলী থেকেই দোল ও হোলি, কথাদুটির উদ্ভব হয়েছে। বাঙালি তথা হিন্দু সমাজের অন্যতম মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথি হচ্ছে এই পূর্ণিমা তিথি তথা দোলের তিথি। এই মহান পুরুষের জন্ম এই উৎসবকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। ধর্মীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে হোলি উৎসব আজ সার্বজনীন।
রবীন্দ্রনাথ যে অশোকফুল ও অশোকগাছ নিয়ে কতটা অবসেসড ছিলেন, তার পরিচয় তাঁর বিভিন্ন লেখায় পাওয়া যায়।
নটীর পূজা নাটকের ভেনু বা স্থান হচ্ছে অশোকগাছের নীচে। একটু উদ্ধৃতি দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে যুগটি।…
অশোকতল। ভাঙা স্তূপ
ভগ্নপ্রায় আসনবেদি
রত্নাবলী। রাজকিংকরীগণ। একদল রক্ষিণী
প্রথম কিংকরী
রাজকুমারী, আমাদের প্রাসাদের কাজে বিলম্ব হচ্ছে।
রত্নাবলী
আর একটু অপেক্ষা করো। মহারানী লোকেশ্বরী স্বয়ং এসে দেখতে চান। তিনি না এলে নাচ আরম্ভ হতে পারে না।
দ্বিতীয় কিংকরী
আপনার আদেশে এসেছি। কিন্তু অধর্মের ভয়ে মন ব্যাকুল।
তৃতীয় কিংকরী
এইখানেই প্রভুকে পূজা দিয়েছি, আজ এখানেই নটীর নাচ দেখা! ছি ছি, কেমন করে এ পাপের ক্ষালন হবে।
চতুর্থ কিংকরী
এতবড়ো বীভৎস ব্যাপার এখানে হবে জানতেম না। থাকতে পারব না আমরা, কিছুতে না।
রত্নাবলী
মন্দভাগিনী তোরা শুনিসনি, বুদ্ধের পূজা এ-রাজ্যে নিষিদ্ধ হয়েছে।
চতুর্থ কিংকরী
রাজাকে অমান্য করা আমাদের সাধ্য নেই। ভগবানের পূজা নাই করলেম কিন্তু তাই বলে তাঁর অপমান করতে পারিনে।
প্রথম কিংকরী
রাজবাড়ির নটীর নাচ রাজকন্যা-রাজবধূদেরই জন্যে। এ সভায় আমাদের কেন। চলো তোমরা, আমাদের যেখানে স্থান সেখানে যাই।
রত্নাবলী
রক্ষিণীদের প্রতি
যেতে দিয়ো না ওদের। এইবার শীঘ্র নটীকে ডেকে নিয়ে এসো।
প্রথম কিংকরী
রাজকুমারী, এ পাপ নটীকে স্পর্শ করবে না। পাপ তোমারই।
রত্নাবলী
তোরা ভাবিস তোদের নতুন ধর্মের নতুন-গড়া পাপকে আমি গ্রাহ্য করি!
দ্বিতীয় কিংকরী
মানুষের ভক্তিকে অপমান করা এ তো চিরকালের পাপ।
রত্নাবলী
এই নটীসাধ্বীর হাওয়া তোমাদের সবাইকে লাগল দেখছি। আমাকে পাপের ভয় দেখিয়ো না, আমি শিশু নই।
রক্ষিণী
প্রথম কিংকরীর প্রতি
বসুমতী, আমরা শ্রীমতীকে ভক্তি করেছি। কিন্তু ভুল করেছি তো। সে তো নাচতে রাজি হল।
রত্নাবলী
রাজি হবে না? রাজার আদেশকে ভয় করবে না?
রক্ষিণী
ভয় তো আমরাই করি, কিন্তু—
রত্নাবলী
নটীর পদ কি তোমাদেরও উপরে।
প্রথম কিংকরী
আমরা তো ওকে নটী বলে আর ভাবতুম না। আমরা ওর মধ্যে স্বর্গের আলো দেখেছি।
রত্নাবলী
নটী স্বর্গে গিয়েও নাচে তা জানিসনে!
রক্ষিণী
শ্রীমতীকে পাছে রাজার আদেশে আঘাত করতে হয় এই ভয় ছিল কিন্তু আজ মনে হচ্ছে রাজার আদেশের অপেক্ষা করার দরকার নেই।
প্রথম কিংকরী
ও পাপীয়সীদের কথা থাক্। কিন্তু এই পাপদৃশ্যে দুই চোখকে কলঙ্কিত করলে আমাদের গতি হবে কী।
রত্নাবলী
এখনো নটীর সাজ শেষ হল না। দেখছ তো তোমাদের নটীসাধ্বীর সাজের আনন্দ কত।
প্রথম কিংকরী
ওই যে এল! ইস, দেখেছিস ঝলমল করছে।
দ্বিতীয় কিংকরী
পাপ দেহে এক-শ বাতির আলো জ্বালিয়েছে।
শ্রীমতীর প্রবেশ
প্রথম কিংকরী
পাপিষ্ঠা, শ্রীমতী। ভগবানের আসনের সম্মুখে, নির্লজ্জ, তুই আজ নাচবি! তোর দুখানা পা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল না এখনো?
শ্রীমতী
উপায় নেই, আদেশ আছে।
দ্বিতীয় কিংকরী
নরকে গিয়ে শতলক্ষ বৎসর ধরে জ্বলন্ত অঙ্গারের উপরে তোকে দিনরাত নাচতে হবে এ আমি বলে দিলেম।
তৃতীয় কিংকরী
দেখো একবার। পাতকিনী আপাদমস্তক অলংকার পরেছে। প্রত্যেক অলংকারটি আগুনের বেড়ি হয়ে তোর হাড়ে মাংসে জড়িয়ে থাকবে, তোর নাড়ীতে নাড়ীতে জ্বালার স্রোত বইয়ে দেবে তা জানিস?
মল্লিকার প্রবেশ
মল্লিকা
জনাস্তিকে, রত্নাবলীকে
রাজ্যে বুদ্ধপূজার যে-নিষেধ প্রচার হয়েছিল সে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পথে পথে দুন্দুভি বাজিয়ে তাই ঘোষণা চলছে। হয়তো এখনি এখানেও আসবে তাই সংবাদ দিয়ে গেলেম। আরো একটি সংবাদ আছে। আজ মহারাজ অজাতশত্রু স্বয়ং এখানে এসে পূজা করবেন তার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন।
রত্নাবলী
একবার দৌড়ে যাও তাহলে মল্লিকা—শীঘ্র মহারানী লোকেশ্বরীকে ডেকে নিয়ে এসো।
মল্লিকা
ওই যে তিনি আসছেন।
লোকেশ্বরীর প্রবেশ
রত্নাবলী
মহারানী, এই আপনার আসন।
লোকেশ্বরী
থামো। শ্রীমতীর সঙ্গে নিভৃতে আমার কথা আছে।
শ্রীমতীকে জনান্তিকে ডাকিয়া লইয়া
শ্রীমতী।
শ্রীমতী
কী মহারানী।
লোকেশ্বরী
এই লও, তোমার জন্যে এনেছি।
শ্রীমতী
কী এনেছেন।
লোকেশ্বরী
অমৃত।
শ্রীমতী
বুঝতে পারছিনে।
লোকেশ্বরী
বিষ। খেয়ে মরো, পরিত্রাণ পাবে।
শ্রীমতী
পরিত্রাণের আর উপায় নেই ভাবছেন?
লোকেশ্বরী
না। রত্নাবলী আগেই গিয়ে রাজার কাছ থেকে তোমার জন্যে নাচের আদেশ আনিয়েছে। সে আদেশ কিছুতেই ফিরবে না জানি।
রবীন্দ্রনাথ যে কী সাংঘাতিকভাবে অশোকতাড়িত ছিলেন, তাঁর বিভিন্ন কবিতা ও গানে তার পরিচয় পাওয়া যায়। কতকগুলি দিলাম প্রাসঙ্গিক হবে মনে করে
১.
যেমন করে লাগে তরীর পালে,
যেমন লাগে অশোক গাছের কচি পাতার ডালে।
নাম ভোলা ফুল ফুটল ঘাসে ঘাসে
সেই প্রভাতের সহজ অবকাশে।
২.
কিন্তু যখন বসন্তের পর বসন্ত এসেছে,
অশোক বকুল পেয়েছে সম্মান;
ওকে জেনেছি যেন ঋতুরাজের বাহির-দেউড়ির দ্বারী,
উদাসীন, উদ্ধত।
সেদিন কে জেনেছিল–
ওই রূঢ় বৃহতের অন্তরে সুন্দরের নম্রতা,
কে জেনেছিল বসন্তের সভায় ওর কৌলীন্য
ফুলের পরিচয়ে আজ ওকে দেখছি।
৩.
তবু মনে প্রবোধ আছে —
তেমনি বকুল ফোটে গাছে
যদিও সে পায় না নারীর
মুখমদের ছিটা,
ফাগুন-মাসে অশোক-ছায়ে
অলস প্রাণে শিথিল গায়ে
দখিন হতে বাতাসটুকু
তেমনি লাগে মিঠা।
৪.
অশোক-কুঞ্জ উঠত ফুটে
প্রিয়ার পদাঘাতে,
বকুল হত ফুল্ল প্রিয়ার
মুখের মদিরাতে।
প্রিয়সখীর নামগুলি সব
ছন্দ ভরি করিত রব,
রেবার কুলে কলহংসের
কলধ্বনির মতো।
কোনো নামটি মন্দালিকা,
কোনো নামটি চিত্রলিখা,
মঞ্জুলিকা মঞ্জরিণী
ঝংকারিত কত!
আসত তারা কুঞ্জবনে
চৈত্র-জ্যোৎস্না-রাতে,
অশোক-শাখা উঠত ফুটে
প্রিয়ার পদাঘাতে।
৫.
ওই হোথা ওই ফুলশিশু-সাথে
বসি ফুলবালা অশোক ফুলে
দুজনে বিজনে প্রেমের আলাপ
কহে চুপিচুপি হৃদয় খুলে।”
৬.
ওই হোথা ওই ফুলশিশু-সাথে
বসি ফুলবালা অশোক ফুলে
দুজনে বিজনে প্রেমের আলাপ
কহে চুপিচুপি হৃদয় খুলে।”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৭.
শুয়ে শুয়ে অশোক-পাতায়
মুমূর্ষু শিশির বলে,”হায়,
কোনো সুখ ফুরায় নি যার
তার কেন জীবন ফুরায়?”
৮.
কেবল তব মুখের পানে
চাহিয়া,
বাহির হনু তিমির-রাতে
তরণীখানি বাহিয়া।
অরুণ আজি উঠেছে–
অশোক আজি ফুটেছে–
না যদি উঠে, না যদি ফুটে,
তবুও আমি চলিব ছুটে
তোমার মুখে চাহিয়া।
৯.
অশোক বনে আমার হিয়া ওগো নূতন পাতায় উঠবে জিয়া,
বুকের মাতন টুটবে বাঁধন যৌবনেরই কূলে কূলে
ফাল্গুনের এই ফুলে ফুলে॥
১০.
আন গো ডালা গাঁথ গো মালা,
আন মাধবী মালতী অশোকমঞ্জরী, আয় তোরা আয়।
আন করবী রঙ্গন কাঞ্চন রজনীগন্ধা প্রফুল্লমল্লিকা, আয় তোরা আয়।
অশোকবৃক্ষ মানে যে দোহলী, সেটার প্রয়োগ কোথাও সেভাবে পাচ্ছি না। ফলিত জ্যোতিষের একটি বাক্যেই আটকে আছি। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরা বলতে পারবেন।