গত লোকসভা নির্বাচনে যেখানে ৪৮টি আসনের মধ্যে পেয়েছিল মাত্র ১৭টি আসন, অন্যদিকে বিরোধীরা জিতেছিল ৩০টি আসন। সেখানে মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই রাজনীতির চিত্রনাট্যটি পুরোটাই ওলটপালট হয়ে গেল কিভাবে। শনিবার মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটের ফলাফল বুঝিয়ে দিল মহিলারা যেমন গোটা সংসারটিকে চালান তেমনি একটি রাজ্যের রাজনৈতিক চালিকাশক্তিরও নির্ণায়ক হতে পারেন মহিলারাই। হ্যাঁ; মহরাষ্ট্র বিধানসভা ভোটে তা ফের একবার প্রমাণিত হল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই।
মহারাষ্ট্রে যেসব পরিবারের বার্ষিক আয় আড়াই লক্ষ টাকার কম, সেরকম পরিবারের ২১ থেকে ৬০ বছর বয়সী মহিলারা ‘লাডলি বহিন যোজনা’ থেকে প্রতি মাসে ১৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন। গত জুন মাসে লোকসভা ভোটে খারাপ ফলাফল করার পর জুলাই মাস থেকে এই যোজনা চালু করেন মুখ্যমন্ত্রী শিন্ডে। প্রকল্পটি যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীশ্রী’ বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের অনুকরণেই তা বলতে অসুবিধা নেই। মহারাষ্ট্রের মহায়ুতি সরকার ১৫০০ টাকার লাডলি বহিন প্রকল্প চালুর করার সময় থেকেই মহা বিকাশ আঘাদি প্রকল্পের সমালোচনা করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মহা বিকাশ আঘাদি নিজেই তাদের নির্বাচনি ইস্তেহারে একই ভাবে দেড় হাজার টাকার বদলে তিন হাজার টাকা দেওয়ার একটি প্রকল্পের কথা বলে।
নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান বলছে, গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এই বার মহারাষ্ট্রে আড়াই শতাংশ মহিলা ভোটার বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট মহিলা ভোটারের মধ্যে ৬৫.২১ শতাংশই ভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে মোট পুরুষ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৬৬.৮৪ শতাংশ। একথা বলাই যায় মনে, একনাথ শিন্ডে সরকারের ‘লড়কি বহিন যোজনা’ প্রকল্প সে রাজ্যের মহিলাদের ভোটদানে অনেকটাই উৎসাহিত করেছে। যদিও মোট প্রার্থীর মধ্যে কেন মাত্র আট শতাংশ মহিলা প্রার্থী আর তার মধ্যে কেন ২১ জন জয়ী হয়েছেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে ভোটের ফলাফল দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ওই মারাঠাভুমের মা-বোনেরা উদার মনে ভোট দিয়েছেন। এবং একই সঙ্গে একথাও বলা যায় যে এনডিএ-র বিপুল জয়ে গেমচেঞ্জারের ভূমিকা নিয়েছে ‘লাডকি বহিন’ প্রকল্প।
ভোটে জিততে মহাজুটির সরকার লাডলি বহিন ছাড়াও টোল ট্যাক্সে ছাড়, ইলেকট্রিক বিলে ছাড়ের মতো খয়রাতি শুরু করে। ভোটের প্রচারে মহাজুটির নেতারা ‘লাডকি বহিন’ প্রকল্প নিয়ে ঢালাও প্রচার করেন। অন্যদিকে লোকসভা ভোটে ভাল ফলাফলের পর আত্মতুষ্টিতে ভোগা বিরোধী শিবির ধরেই নিয়েছিল বিধানসভাতেও পুনরাবৃত্তি হবে। কিন্তু এটা ছিল বিরোধীদের দুর্বলতা। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রে আরএসএস কোমর বেঁধে নেমেছিল। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে নাগপুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ নীতিন গাদকারিকেই মহরাষ্ট্রের ভোটে প্রচারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। মহারাষ্ট্রে দলিত ভোটারদের একত্রিত করতে ৬০ হাজারের বেশি কর্মসূচি নিয়েছিল বিজেপি-আরএসএস। যা এই জয়ের জন্য একটি কারণ তো বটেই।
অন্যদিকে এবারের ঝাড়খণ্ড বিধানসভা ভোটে বিজেপির প্রচারের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ’ ইস্যুটি। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার আগেই এবং নির্বাচনি সভাগুলিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তো বটেই প্রধানমন্ত্রী মোদীকেও বারবার বলতে শোনা গিয়েছে যে বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের জমি দখল করে নিচ্ছে। এমনকি ভোটের প্রধান কৌশলী হিসাবে হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। যিনি নিজের রাজ্য আসামেও বারবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকে ইস্যু করেছিলেন। আসলে বিজেপি নির্বাচনের প্রচার হিসাবে এই ইস্যুটিকে বিজেপি গুরুত্ব দিয়েছিলে এই কারণেই যাতে হিন্দু ভোট একজোট হয় অন্যদিকে বিজেপি লোকসভা ভোটে আদিবাসীদের যে ভোট হারিয়েছিল, তারও কিছুটা অংশ যাতে ফিরে আসে। কিন্তু কার্যত এই ইস্যুটির কোনো ভিত্তি নেই কারণ, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে অথবা আদিবাসী নারীদের বিয়ে করে নিচ্ছে- এমনটা ঘটনা নয়। যে কারণে এই প্রচার একেবারেই কোনো কাজে আসেনি। উলটে হেমন্ত সরেন যখন প্রশ্ন করেন(যদিও তা একবার) যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কথা বলা হচ্ছে, তাহলে কী করে সেদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, কি করে তার বিমান ভারতের মাটিতে নামার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাহলে কী বাংলাদেশের সঙ্গে আসলে বিজেপিরই কোনও গোপন বোঝাপড়া আছে।ফলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ যে আদৌ বিজেপির পক্ষে কাজ করে নি, তা ভোটের ফলেই বোঝা যাচ্ছে।
অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের মতো ঝাড়খন্ডেও ভোটের ফলাফলে নির্নায়ক হয়েছেন মহিলারা। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এ বার ঝাড়খণ্ডে ভোট দিয়েছেন ৯১ লক্ষেরও বেশি মহিলা। সংখ্যাটি পুরুষ ভোটারদের থেকে অন্তত ছ’লক্ষ বেশি। পাশাপাশি এই রাজ্যেও বাংলার ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’অথবা মহারাষ্ট্রের ‘লাডকি বহিন’ প্রকল্পের আদলেই ‘মাইয়া সম্মান যোজনা’ চালু করেছিলেন হেমন্ত সোরেনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম)-কংগ্রেস সরকার। এই প্রকল্পে সে রাজ্যের ২১ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মহিলারা মাসে ১০০০ টাকা ভাতা পেয়ে থাকেন। সেই জায়গা থেকে অনেকেই মনে করছেন, মহারাষ্ট্রে এনডিএ-র বিপুল জয়তে যেমন সহায়ক হয়েছে ‘লাডলি বহিন যোজনা’, তেমনই ঝাড়খণ্ডেও হেমন্তের জয়ে অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে ‘মাইয়া সম্মান যোজনা’।
উল্লেখ্য, ঝাড়খণ্ডে ২৬ শতাংশর বেশি উপজাতি জনসংখ্যা, কোনো কোনো বিধানসভা আসনে আদিবাসীদের সংখ্যা ৪০ শতাংশের বেশি। এই বিধানসভা ভোটের ফলাফল দেখলে বোঝা যায় যে আদিবাসীরা আরও একবার হেমন্তকেই ভরসা করেছেন। বস্তুত হেমন্ত সোরেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এমন কোনো আদিবাসী নেতাও বিজেপিতে নেই। চম্পাই সোরেন বা সীতা সোরেন জেএমএম ছেড়ে বিজেপিতে গেলেও তা আদিবাসীরা ভাল মনে নেয়নি।