শনিবার সকালে এসএসকেএম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার প্রতুল মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। এদিন শিল্পীর প্রয়াণের খবর পাওয়া মাত্রই হাসপাতালে ছুটে যান মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন ও সাংসদ দোলা সেন। অরূপ বিশ্বাস জানান, “দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে শনিবার তাঁর প্রয়াণ হয়। তিনি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিনিয়ত তাঁর শরীরের খোঁজখবর নিয়েছেন। রবীন্দ্র সদনে তাঁর নশ্বর দেহের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যাবে বিকাল ৪টে পর্যন্ত। এরপর তাঁর দেহ আবার এসএসকেএমে ফিরিয়ে আনা হবে, যেহেতু তাঁর দেহ ও চোখ দুটিই এসএসকেএম হাসপাতালে দান করা রয়েছে।” এসএসকেএম হাসপাতালের ডিরেক্টর মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ম্যালিগন্যান্সি রেক্টাম ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। সেখান থেকে তাঁর একাধিক অঙ্গে প্রভাব পড়তে থাকে। সেই কারণেই তিনি সিসিইউ-তে ভর্তি ছিলেন। তবে ক্যান্সার-জনিত রোগের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান ডা. মনিময় বন্দোপাধ্যায়।
এদিন রবীন্দ্রসদনে গিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোকবার্তায় মুখ্যমন্ত্রী জানান, কয়েকদিন আগেই হাসপাতালে গিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম। প্রতুলদার মৃত্যু বাংলা গানের জগতে অপূরণীয় ক্ষতি। যতদিন বাংলা গান থাকবে, ‘আমি বাংলায় গান গাই’ বাঙালির মুখে মুখে ফিরবে।
এদিন শ্রদ্ধা জানাতে এসে স্মৃতিমেদুর মুখ্যমন্ত্রী জানান, প্রতুলদা আগেও একবার অসুস্থ হয়েছেন। তখন আমি পিজি হাসপাতালে বসে, বললাম গানটা হবে? বললেন হ্যাঁ হবে। এত প্রাণখোলা মানুষ ছিলেন। গান গাইলেন। ভালো হলেন। বাড়িতে ফিরে গেলেন।
সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে আপনজন হারানোর বেদনা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। স্মৃতি চারণ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ওনার সঙ্গে আবার আমার দেখা, তখনও সুস্থ ছিলেন। যখন অবস্থার অবনতি হয়ে ওনাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। আমি শুনি উনি তিনদিন ধরে কোনও রেসপন্ড করছেন না। আমি যখন গিয়ে প্রতুলদা বলে ডাকলাম প্রতুলদা শুনলেন। দুটো চোখ খুললেন। ওনার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। খুব কষ্ট হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম। আমরা অনেক বললাম, আপনাকে তো ভালো হতে হবে। আবার গান গাইতে হবে। তখন সেই ওনার স্বভাবত দুটো হাত তুললেন। কিছু বোঝাবার চেষ্টা করলেন। তারপর আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ওনার আঙুল গুলো টিপে দিলাম। কথা বললাম।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী সর্বাণী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিন তিনি বলেন, প্রতুলদার সঙ্গে বৌদির সম্পর্ক ভাষায় বলা যাবে না। প্রতুলদা শেষের দিকে খাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। বৌদি নিজে না খেয়ে ছিলেন। সেদিন চোখ খোলার পর আমি বললাম বৌদি তুমি খাও। তুমি একবার দেখে এসো প্রতুলদা চোখ খুলেছে। দেখে রাখব একথা বলার দুঃসাহস আমার নেই। আমরা সবসময় যোগাযোগ রাখব। এদিন সর্বাণী মুখোপাধ্যায়কে নিজে হাতে জল খাইয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্য সরকারের তরফে প্রয়াত শিল্পীকে এদিন গান স্যালুট দেওয়া হয় রবীন্দ্র সদনে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। প্রয়াত শিল্পীর স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার পাশাপাশি বারবার স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন তিনি। ব্যক্ত করেন, শিল্পীর মৃত্যুর পরে তাঁর এইটুকুই সান্ত্বনা যে তিনি যাওয়ার আগে সাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন।
এসএসকেএম হাসপাতালে প্রতিদিন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের খোঁজ নিতেন মুখ্যমন্ত্রী। চিকিৎসকদের কথা বলতে গিয়ে এদিন তিনি বলেন, আমাদের চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেছেন। তাঁরা সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে যেভাবে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁকে সেই সংক্রমণ থেকে সরিয়ে আনা গেল না। কাল মধ্যরাতে ওনার প্রেসার হঠাৎ নেমে যায়। তখন থেকেই চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন আর শেষরক্ষা হবে না।
শনিবার বেলা ২টো থেকে বিকাল প্রায় ৫টা পর্যন্ত তাঁকে রবীন্দ্র সদনে শায়িত রাখা হয় শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। বিশিষ্ট শিল্পীদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী, সাংসদরাও। বিকালে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিন রবীন্দ্র সদনে গান স্যালুট সম্মাননা শেষে শিল্পীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানেই মরণোত্তর দেহ ও চক্ষুদানে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন শিল্পী।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন প্রয়াত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
এছাড়াও ‘সঙ্গীত সম্মান’, ‘সঙ্গীত মহাসম্মান’, ‘নজরুল স্মৃতি পুরস্কার’ সম্মাননা পেয়েছিলেন। এবিষয়ে এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমি গর্বিত, এমন গুণী মানুষকে আমাদের সরকার তাঁর যোগ্য সম্মাননা জানাতে পেরেছিল। সেই সঙ্গে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও অগণিত গুণগ্রাহীর প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এদিন শোকপ্রকাশ করেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসও। সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, “প্রখ্যাত বাংলা গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে আমরা শোকাহত, যিনি তাঁর বিখ্যাত উপস্থাপনা ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ও ‘ডিঙা ভাসাও সাগরে’ গানদুটির মধ্যে দিয়ে পরিচিত ছিলেন। বাংলা সঙ্গীতে তাঁর অবদান আজীবন আমাদের কানে অনুরণিত হবে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
তবে শনিবার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে স্বজন হারানোর বেদনা লক্ষ্য করা যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে। তিনি জানান, আমার এখনও খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি নিজেকে সামলাতেই পারছি না। এই সম্পর্ক, অতিপরিচিত কেউ চলে গেলে আমি তাঁর মৃত্যু মুখ দেখি না। কিন্তু প্রতুলদার ক্ষেত্রে না এসে থাকতে পারলাম না। এই টুকু স্বান্তনা যাবার আগে সাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন।
এদিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রয়াত শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে লেখেন — “‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে সাথীরে / ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে পূবের আকাশ রাঙ্গা হল সাথী / ঘুমায়োনা আর, জাগো রে।’ প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের মূর্ছনায় বাংলা সঙ্গীত জগত প্রাণবন্ত ও মুগ্ধ। তাঁর গায়নশৈলীতে বাক্রুদ্ধ সমগ্র সঙ্গীত জগত – সেই আধুনিক বাংলা গানের খ্যাতনামা শিল্পী, গীতিকার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে আমি শোকস্তব্ধ। আজ রবীন্দ্র সদনে তাঁর প্রতি জানালাম শেষ শ্রদ্ধা। আমি যেমন তাঁর একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত, তেমনই তিনিও আমার খুব কাছের মানুষ। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং সঙ্গীত জগতে তাঁর সুরেলা কণ্ঠের গায়কি আজীবন থেকে যাবে আমাদের মননে। আজ পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে গান স্যালুটের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানায় আপামর বাঙালি। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।”