সিন্ধুসভ্যতার ভাষা যে আদতে ছিল প্রোটো-দ্রাবিড়ীয়, সেটা মান্যতা পেয়েছে এতদিনে। সিন্ধিভাষার ব্যবহার ভারত ও পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেখা যায়। সিন্ধু উপত্যকার ভাষা সিন্ধি। এখনও সেই ভাষায় দ্রাবিড় শব্দ ব্যবহার হয় কিনা খোঁজ নিলাম। তার আগে বাংলাভাষায় দ্রাবিড় শব্দের কথা বলে নেওয়া যাক।
বাংলাভাষা যে দ্রাবিড়-অস্ট্রিক-সংস্কৃত-বিদেশি শব্দের ককটেল, তা ভাষাবিদরাই বলে গেছেন। আর্যরা আসার আগে বঙ্গে ছিল অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জনজাতির মিশ্রণে উদ্ভূত সংকর জাতি। বাংলার বহুশব্দ তাই দ্রাবিড় ভাষা (তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম, টুলু ইত্যাদি) থেকে আগত।
বিশেষ করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নাম দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে।
অধর, ঠোঁট, অলক, কুন্তল, আকল, আলজিভ, কড়ে, কনুই, কপোল, করোটি, খুলি, কবরী, কুঁচকি, গণ্ড, গাল, গাঁট, গিঁট, চোয়াল, ঘাড়, চেটো, তালু, দাড়ি, নাড়ি, পাঁজরা, পেট, বগল, মালাইচাকি, মুখ, ললাট, হাঁটু, — এই শব্দগুলি বাংলায় দ্রাবিড় ভাষার অবদান।
অনেক রোগবালাইয়ের নামও দ্রাবিড় থেকে এসেছে।
যথা, — হাম, হাঁচি, মেচেতা, মড়ক বা মারী, ফোসকা, পোয়াতি, পিত্ত, পঙ্গু, দাদ, তোতলা, ঢেকুর, টাটানো, জোড়া বা যমজ, টাক, জরুল, (মাথার) ছিট, ছড়া, ছেঁচে যাওয়া, চুলকানি, গেঁজলা, গয়ার, খোঁড়া, খোস, খিঁচুনি, খিল ধরা, কুষ্ঠ বা কুট, কুঁজো, কোঁড় বা শ্বেতী, খসা, কমলা (জন্ডিস), কালা, ওলাওঠা, এঁড়ে লাগা, ওগরানো, আঁটকুড়ি, ভোগা, মচকানো প্রভৃতি।
কয়েক হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে দ্রাবিড়রা দক্ষিণ ভারতে আসে প্রথমে। তারপর ক্রমশ উত্তরে এগোতে থাকে। সিন্ধু উপত্যকায় পোঁছায় সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে। সেইজন্যে সিন্ধু উপত্যকার ভাষায় দ্রাবিড় শব্দ লক্ষ করা যায়। যদিও অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর শব্দও ছিল অনেক। সিন্ধুলিপি তাই মিশ্রলিপি।
সিন্ধি ভাষাকে সাধারণভাবে সিন্ধু উপত্যকার ভাষা হিসেবে ধরা হয়। এখনও খুঁজলে অনেক দ্রাবিড় শব্দের দেখা মেলে এই ভাষায়।
সিন্ধিভাষীরা কনুইকে বলে কুনো। বগলকে বলে বগল।
কুন্তল বা মাথার কেশরাশিকে বলে কান্তাল। পশ্চাৎদেশকে বলে গাড়। বেগুনকে বলে বেঙ্গান। গণ্ডদেশ বা গালকে বলে গাল, দাড়ি-কে বলে দাড়ি। মারী বা রোগকে বলে মারি।
খুঁজলে আরও অনেক বেরোবে। এই শব্দগুলি বাংলাতেও এসেছে দ্রাবিড় ভাষা থেকে।
সিন্ধুলিপি যে আদতে প্রোটো-দ্রাবিড়ীয়, তা এইসব শব্দের অস্তিত্বই বলে দিচ্ছে।
(ঋণ : বাংলায় দ্রাবিড় শব্দ (ব্যুৎপত্তিকোষ) — ড. সত্যনারায়ণ দাশ এবং গুগল ট্রানস্লেট।)