শীত পড়তেই পরিযায়ী পাখির মত তাদের নতুন করে ঘর গোছানো বিরজানগরে। বোঁচকা বুঁচকি, টিনের ট্রাঙ্ক, মস্ত হাতা, খুন্তি, কড়া, বারকোষ নিয়ে টেম্পো থামে নড়বড়ে বাড়িটার সামনে। প্রতি বছর।
লাইট, সাউন্ড, অ্যাকশন… জ্বলে ওঠে মাটির উনোন। কড়ায় পাক হয় নলেন গুড়। কাঠের বারকোষে ছানা ডলে হাতের তেলোয়। রসগোল্লারা নতুন লালচে কোট পায়। কনকচূড় খই গুড়, ঘী আর ক্ষীরের মোহে বাঁধা পড়ে। ছোটোএলাচ গুঁড়োর বনেদী সুগন্ধে মোয়ার সাজ সম্পূর্ণ। শিল্পীর সুদক্ষ হাতে গোলাপ, আতা, শাঁখ, তালশাঁস, আনারস হাসে। কাঁচ ঢাকা শোকেসে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এবার পাটালি, মাখা সন্দেশ, নরমপাক, কড়া পাক, মোয়ার। গেরামভারি নলেন গুড় পৃথক থাকে। সে বড় সুখী। গরম সে মোটে সইতে পারে না।তার জন্যে আলাদা পাত্র। মাটির নাগরি হলে সব থেকে ভালো।
গলায় তুলসীর মালা নরোত্তম ঘোষ মাস্টার ক্রাফটস্ ম্যান। মিষ্টি তৈরি মধ্যবয়সী নরোত্তম ঘোষের জাত ব্যবসা। শীতকালে তার দোকানে রীতিমতো লম্বা লাইন। আশেপাশে ঝাঁ চকচকে ‘মনোমতো মিষ্টান্ন’, ‘রসভান্ডার’, ‘মিষ্টিকথা’য় তখন রীতিমত খদ্দেরের টান।
নরোত্তমের জোয়ান ছেলে বিপিন আশ্চর্য হয়। চকলেট রসগোল্লা, বেকড্ মিহিদানা, স্ট্রবেরী সন্দেশের মত আইটেম ফেলে লোকে কি আজকাল আবার পুরনো জিনিসে ফিরতে চায়!
বিপিনের বৌ কাবেরী বলে, “নাগো, তেমনটি নয়। এতদিনেও বোঝো নি, তোমার বাবা খাঁটি জিনিসের সঙ্গে কোনো আপোষ করে না! আমাদের জয়নগরের আশেপাশের গাঁগঞ্জে কত ঘুরে ঘুরে বাবা সরেশ গুড়টি, ভালো খই, টাটকা ছানার খোঁজ নিয়ে তবেই না অর্ডার দিল। লোক এখনো ভালো জিনিস পেতে চায় গো!”
নতুন বৌয়ের বাক্যি খাঁটি নলেন গুড়ের মতই মিঠে। তাই আর তর্কে গেলো না বিপিন। তবে একটা কথা বৌকে বলতে সাহস পেল না সে। শ্বশুর বৌমার সম্পর্ক বাবা-মেয়ের মত হলেও শাশুড়িবৌয়ের সামান্য খিটপিট আছে। বাবার এই ব্যবসায় মায়েরও যথেষ্ট হাতযশ। গতবছর মায়ের হাতের আনন্দনাড়ুর এত অর্ডার এসেছিল যে কুলিয়ে উঠতে পারা যায় নি। শহুরে মেয়েরা আজকাল আর শুভ কাজে গালগল্প করতে করতে আনন্দ নাড়ু বানায় না। সবটাই অর্ডার দেওয়া হয়।
আপাততঃ বিপিন বৌকে শহুরে জীবনের রঙিন স্বপ্ন দেখিয়েছে। তাদের চন্দনপুরের রুক্ষ, খড়ি ওঠা শীতকালের চেয়ে বিরজানগরের ঝলমলে আলো জ্বলা শীত যেন এক পাব্বণ। কত মেলা, রঙিন পোশাক, ফুলগাছ, হাসিমুখ! কাজের ফাঁকে ফাঁকে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সিনেমা দেখে বিপিন। শীতের কামড় বিরজানগরে অনেক কম। তিনমাস যেন দেখতে দেখতে কেটে যায়! আবার সব জিনিসপত্র তোলাপাড়া, চাবিচাবলা দিয়ে ফিরে এসে চন্দনপুরের সেই একঘেয়ে জীবন।
ঠাকুর্দার তৈরি বাড়িটা অবশ্য খুব লঝঝড়ে হয়ে গেছে। মেরামত না করলেই নয়। ভাঙাচোরা বাড়িতে থাকতে কাবেরী আবার নাক সিঁটকোবে না তো!
এই তো গেল বছর এক প্রোমোটারের দালাল এসে বাড়ি সমেত দোকানঘরটা কিনে দেবার প্রস্তাব দিয়েছিল। নরোত্তম দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তোমরা ভেবেছ কি? এই বাড়ি-দোকান আমার বাবার নিজের হাতে করা। আমার জাতব্যবসা আমি তুলে দেব নাকি!”
দালাল অরুণ দেঁতো হাসি হেসে বলল, “সারাবছর তো গ্রামেই পচে মরেন। শীতেই যা আপনার এখানে একটু বিক্রি বাটা। বাড়িটাতো ভেঙে পড়ছে। ভালো দাম আর একটা ফ্ল্যাট পেয়ে বিরজানগরে আরামে থাকতে পারতেন।”
— আর দোকান! মিষ্টির দোকান কোথায় যেত?
— বিরজানগরে কি মিষ্টির দোকানের অভাব আছে!
— অভাব নেই তবে ঊষারাণী মিষ্টান্ন ভান্ডার ও নেই। যান যান। সাফ কথা আমি বাড়ি-দোকান বেচব না।
দালাল চলে যেতে গজগজ করে বৌ ছেলের কাছে নরোত্তম বলল, “হিংসে, হিংসে। আশেপাশের সব মিষ্টির দোকানগুলোর শীতকালে আমার দোকান চালু হলেই বিক্রিবাটা কমে যায়! ঐ শালারাই প্রোমোটারকে লেলিয়েছে।”
দোকান-বাড়ি বেচায় বিপিনেরও একদম মত নেই। পিতৃপুরুষের ভিটে আর বিরজানগরের তিনমাসের আনন্দময় শীতজীবন দুয়ের প্রতি বড়ই টান তার। তবে বাড়ি মেরামতের কথা তো ভাবতেই হয়।
এবছর বর্ষা শেষ হতে যখন ভাদুরে রোদ উঠল, বিপিন বাপকে প্রস্তাব দিল, “বাবা বিরজানগরের বাড়িটার তো মেরামতি দরকার। আমি যাই। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যতটা পারি, সারিয়ে সুরিয়ে আসি। গেল বছর যে মিস্ত্রি দেখে খরচাপাতি বলে গেল, তার সঙ্গেই গিয়ে যোগাযোগ করি!”
— এবছরটা থাক। তোর বিয়েতে এত খরচাপাতি হয়ে গেল! শীতে দোকান তোলার পর হাতে কিছু পয়সাকড়ি আসবে। এবার তো বৌমা সঙ্গে আছে। চার জনে খুব খাটব। তারপর তুই নাহয় থেকে যাস। বাড়ি সারিয়ে একেবারে ফিরিস।”
বিপিনের মা কমলারও একমত। বিপিন দেখেছে মাবাবার কখনো মতের অমিল হয় না। বাবা মা’কে যথেষ্ট মান্যি করে চলে। মায়ের কথাতেই বাবা একদিন বিরজানগরের বাড়ি-দোকানে তালা ঝুলিয়ে চন্দনপুরে পাড়ি দিয়েছিল।
সে কবেকার কথা! কমলা তখন তিনমাসের গর্ভবতী। নরোত্তমের বাবা বৃন্দাবনের দুরারোগ্য লিভারের অসুখ ধরা পড়ল। জলের মত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।কোনো সুরাহা হচ্ছে না। দোকানের কর্মচারীরা এই সুযোগে চুরি করছে। অল্পবয়সী নরোত্তম তখন দিশেহারা। মা ঊষারাণীতো কবেই চলে গেছে। বাবাকেও বাঁচাতে পারলনা নরোত্তম।
কমলা ছেলেমানুষ কিন্তু সাংসারিক বুদ্ধিতে পাকা। সে বলল চলো, দোকানের পাট আপাতত উঠিয়ে আমরা চন্দনপুরে যাই। আমার আধপাগলা দাদা তো থেকেও নেই। বাবার মুদির দোকানে তুমি সাহায্য করবে। তারপর একটু সামলে নিয়ে নাহয় আমরা নতুন করে আবার সব শুরু করব।
নিরুপায় নরোত্তম বৌ কমলার কথা শুনে তখন ভালোই করেছিল। চন্দনপুরে চলে গেল ওরা। দুতিনবছর পর থেকে শীতের শুরুতে তাদের সংসার উঠিয়ে আবার বিরজানগরে ফিরে আসা। দোকানের ঝাঁপ খুলে, বাড়ি পরিষ্কার করে নতুন উদ্যমে মিষ্টির ব্যবসা। সারাবছর ধরে নয়। শীতকালে বাঙালির প্রিয় নলেন গুড় আর তার সরেস মিষ্টান্ন বিরজানগরবাসীর হাতে তুলে দেওয়া। শীত ফুরোলে আবার ফিরে যাওয়া পুরনো ডেরায়।
খাটিয়ে মেয়ে কমলা স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খাটে। শীতের তিনমাস তাদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না।আয়পয় ভালোই হয়।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে নরোত্তম মাঝে মাঝে ভাবে, দেখতে দেখতে আধা শহর বিরজানগর কেমন ঝাঁ চকচকে হয়ে গেল! কত নতুন খরিদ্দার আসে তার দোকানে। মিষ্টির প্রশংসা করে। বিয়েবাড়ির অর্ডার দেয়।
নরোত্তম খেজুরগুড়ের মিষ্টি, মোয়া, গুড়ের গুণমানে কোনোরকম আপোষ করে না। চন্দনপুরে মুদির দোকান ছাড়াও চাষের জমি কিনেছে ক’বিঘে। ময়রার পো চাষাবাদ বিশেষ জানে না। জমি অন্যকে দিয়ে খাটায়। বিপিন দেখভাল করে। বিপিনের বৌটিও কমলার মত ভারী লক্ষ্মীমন্ত। খাটিয়ে। শীতের তিনমাস এবার যেন দোকানে লক্ষ্মী উপচে পড়ে। চন্দনপুরে ঠাকুরের আসনের সামনে দাঁড়িয়ে নরোত্তম জোড়হাত করে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করল।
“চলো চলো, দেরী হয়ে যাচ্ছে”, টেম্পোতে মাল ওঠাতে ওঠাতে নরোত্তম তাড়া দিল সবাইকে। পুত্রবধূ কাবেরী কে ঠাট্টা করল, “এত কি ব্যাগপত্র নিয়েছ মা! বিরজানগরে গেরামের মত ঠান্ডা পড়েনা। এবার কিন্তু তোমায় মা শাশুড়ির কাছে আনন্দনাড়ু শিখে নিতে হবে। ওর মত অমন নাড়ু বাঁধতে ও তল্লাটে কেউ পারে না।”
বিপিন বলল, “বাবা এবার একটা দুটো আইটেম দোকানে বাড়াবে নাকি! তোমার বৌমা বলছিল তিলতক্তি, গুড় বাদাম নাকি ও খুব ভালো বানায়।”
— আগে তো পৌঁছই সেথায়। তারপর সময় করে সব হবে খুনি।
গাঁগঞ্জ-মাঠঘাট পেরিয়ে, ধুলো উড়িয়ে টেম্পো চন্দনপুর থেকে বিরজানগরে ঊষারাণী মিষ্টান্ন ভান্ডারের সামনে দাঁড়ালো। বিপিন তড়াক করে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল। ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি বা’র করে নরোত্তম দোকানের তালা খুলতে গিয়ে দেখল দরজার কড়ায় আরো একটা বড়সড় তালা আটকানো! কি ব্যাপার!
ছেলে বিপিন আঙুল তুলে দেখাল, দোকানের দরজায় একটা সাদা কাগজে নোটিশ লটকানো, “বিরজানগর মিউনিসিপ্যালিটির আদেশানুসারে এই পুরাতন বিপজ্জনক বাড়িটিতে বসবাস নিষিদ্ধ করা হইল। আদেশ লঙ্ঘিত হইলে আইনানুগ ব্যবস্থা লওয়া হইবে।”
টেম্পোওলা ততক্ষণে মালপত্র গাড়ি থেকে রাস্তায় ছড়িয়ে ফেলেছে। অঘ্রাণের ধোঁয়াশা ঘেরা সকালে ছেঁড়া ছেঁড়া অনুজ্জ্বল রোদ। মধ্যবয়সী নরোত্তম শিশুর মত হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে দোকানের সামনে থপ করে বসে পড়ল। তার মাথা কাজ করছে না। এলোমেলো চিন্তার ঘুরপাকে দিশেহারা মিষ্টির কারিগর ভাবছে মাঝ বয়সে এসে আমি কি আবার খেই হারিয়ে ফেললাম! ভিটেমাটি, জাতব্যবসা সবকিছুই কি আমার হাত থেকে একেবারেই চলে গেল!
আশেপাশে তখন অনেক ভিড়। কৌতুহলী চোখ। সবাই মজা দেখছে!