বাজবাহাদুরের প্রাসাদ মাণ্ডু, মধ্যপ্রদেশ
মালওয়া রাজ্যের সুলতান বাজবাহাদুরের আসল নাম মালিক বায়াজিদ। তাঁর আরও দুই ভাই ছিলো। তাঁর বাবা সুজাত খান নিজের নামে সুজাওয়ালপুর নামে একটি শহর গড়ে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সুজাত খান মারা যাওয়ার পরে, তিন ভাইয়ের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে কলহ ও লড়াই বেধে যায়।
বায়াজিদ এক ভাইকে হত্যা করেন। অন্য ভাই পরাস্ত হওয়ার পরে মালওয়া ত্যাগ করেন। ফলে সিংহাসন দখল করলেন বায়াজিদ।
বায়াজিদ পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাইসেন ফোর্ট দখল করলেন। এরপর তিনি রানি দুর্গাবতীর গণ্ডোয়ানা আক্রমণ করেন, তখন চৌরাগড়ে ছিলো রানির রাজধানী। কিন্তু গোণ্ড রানি দুর্গাবতীর কাছে হেরে পর্যুদস্ত হয়ে গেলেন।
সেই পরাজয় তাঁকে একেবারে অন্য মানুষ করে দিলো। যুদ্ধ করার শখ মিটে গেল বায়াজিদের। পাকাপাকিভাবে যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করলেন এবং তাঁর পিতার রাজধানী সুজাওয়ালপুর পরিত্যাগ করে মাণ্ডুতে এসে বসবাস শুরু করলেন।
ঐতিহাসিকেরা লিখেছেন, তাঁর সময়কালের সমস্ত পুরুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন সঙ্গীত ও হিন্দি গানে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী’ এবং তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী একজন গায়ক। গায়ক ও সুরকারদের সঙ্গে তিনি তাঁর দিনগুলি অতিবাহিত করছিলেন। দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিম ভারত থেকে তিনি গায়ক ও সঙ্গীতজ্ঞদেরকে সংগ্রহ করেছিলেন। পুরুষ এবং মহিলা উভয়ই, গায়ক ও গীতিকার এবং বীণা, রবাব, বাঁশি, সানাই, সারেঙ্গি, তম্বুরা সমস্ত বাদ্যযন্ত্রের বাদক, তাঁর দরবারকে আলো করে রেখেছিল। তাঁর দরবার কখনওই নিশ্চুপ থাকত না। গানের ও বাজনার শব্দ সবসময়ই মূর্ছনা তুলত, এবং তাঁর উপস্থিতি ছিল গোলাপের বাগানে বুলবুল পাখির মতো।
নারী, সঙ্গীত ও বাজনার পাশাপাশি, সিংহ, বাঘ, হরিণ ও বকের পিছনে ছুটে বেড়াতেও আনন্দ পেতেন। পশুশিকারের জন্য তিনি তাঁর পছন্দের সঙ্গীদেরকে নিয়ে মালওয়ার পাহাড়ে, টিলায় এবং গিরিখাতগুলিতে ঘুরে বেড়াতেন। রেওয়া নদীর পাশে ঘোড়ায় ঘুরে বেড়াতেন।
রেওয়া নদীর উপত্যকায় স্রোতের কিনারায় ধর্মপুরী শহর এবং তার মালিক ছিলেন রাঠোর বংশের একজন রাজপুত, যার নাম কেউ কেউ বলেন, ঠান সিং। নদীর মাঝখানে একটি দ্বীপে তাঁর দুর্গ ছিল এবং সেখানে তিনি বাস করতেন।
এই ঠান সিংয়ের কন্যা রূপমতি।
পবিত্র রেওয়া নদীর ধারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং নদীর দেবী তাঁর প্রতি দুর্দান্ত অনুগ্রহ করেছিলেন। নদীর কলধ্বনি তাঁর অন্তরাত্মার মধ্যে প্রবেশ করে তাঁকে আরও সুন্দর করে তুলেছিলো। বীণাবাদন ও গানে তিনি সব প্রশংসার ঊর্ধ্বে।
বনের মধ্যে রূপমতির সঙ্গে দেখা হলো তরুণ সুপুরুষ বাজবাহাদুরের।
তাঁর শিকারের সঙ্গীরা বললো, সুলতান, আপনি আজ্ঞা দিলে এই মেয়েটিকে ধরে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে আপনার হারেমে ঢুকিয়ে দিই !
কিন্তু কোনও কথাই বাজবাহাদুরের কানে প্রবেশ করছে না। তিনি শরাহত হরিণের মতো তাকিয়ে আছেন সেই রূপমতির দিকে, যেন জীবনে কখনও কোনও নারীকে দেখেননি, কোনও সুন্দর বস্তুও তাঁর চোখে পড়েনি।
*****
প্রতিটি কাহিনীর পিছনেই ভিন্ন একটি অভিমত ভেসে ওঠে।
কেউ কেউ বলেন, রূপমতি ধর্মপুরের রাজপুতের কন্যা নন। তাঁর পিতার নাম ঠান সিং নয়।
তিনি সারাংপুরের এক ব্রাহ্মণের মেয়ে। তাঁর পিতার নাম জাদু রাই।
সুলতান বায়াজিদ একদা তাঁর পিতার আদেশে সারাংপুরের জায়গিরদার হিসেবে কাজ করতেন। উজ্জয়িনী শহরের কাছে এই সারাংপুর। এখানে থাকার সময়ই জাদু রাইয়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। একদিন জাদু রাইয়ের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে ১৪ বছর বয়সী রূপমতির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে।
সেই সাক্ষাতে রূপমতির সৌন্দর্যে তিনি প্রায় পাগল হয়ে ওঠেন। সেই খবর তাঁর পিতা সুজাত খানের কানে ওঠে। তিনি খুব বিরক্ত হয়ে বায়াজিদকে সারাংপুর থেকে ফিরিয়ে আনেন।
৬ মাসের মধ্যেই পিতা সুজাত খান পরলোকে চলে গেলেন। এবার মাণ্ডুর রাজা বায়াজিদ। তিনি আস্তে আস্তে বাজবাহাদুরে রূপান্তরিত হচ্ছেন। ডেকে পাঠালেন সারাংপুরের জাদু রাইকে।
জাদু রাইকে তিনি জমি ও অনেক সোনা উপঢৌকন দিলেন। দিলেন সারাংপুরের জায়গিরদারি, যা তিনি নিজেই তাঁর পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। জাদু রাইকে এত খাতির করার একটাই শর্ত যে তিনি তাঁর কন্যা রূপমতিকে বাজবাহাদুরের হাতে তুলে দেবেন।
রূপমতির পিতা নিজেই তাঁর মেয়েকে বাজবাহাদুরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এবং এটি নিশ্চিত যে তিনি হারেমে প্রবেশ করেছিলেন, তবে বিবাহের কোনও অনুষ্ঠান করা হয়নি।
আনুষ্ঠানিক বিবাহ হয়নি বলেই রূপমতির নাম পরিবর্তনও ঘটেনি।
কিন্তু ভালোবাসার জন্য কি মন্ত্র কিংবা দু’লাইন শ্লোকের দরকার পড়ে? শাস্ত্রসম্মত বিবাহের চেয়ে এই বাধাবন্ধনহীন প্রেমের স্রোত কি কম আকর্ষণীয়? মানুষের হৃদয় কি সবসময় শাস্ত্র মেনে উদ্বেলিত হয়?
‘তবাকৎ-ই-আকবর’ গ্রন্থের লেখক রূপমতিকে ‘শ্রেষ্ঠ স্ত্রী’ বলেই আখ্যায়িত করেছেন।
*****
১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে আকবরের সেনাপতি আদম খান মালওয়া রাজত্ব দখল করলেন। তখন প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বাজবাহাদুর।
কী হলো রূপমতির?
কেউ কেউ লিখছেন, রূপমতি ফুলওয়ালির ছদ্মবেশে মুখ ঢেকে মাণ্ডুর প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর গন্তব্য সারাংপুর।
সারাংপুরে তাঁর পিতা জাদু রাই মারা গেছেন, তাঁর মা নিজের দেওরকে আবার বিয়ে করে সংসার পেতেছেন — এইসব খবর পেয়ে রূপমতি অভিমানে সারাংপুরের কথা ভুলেই ছিলেন। কিন্তু আজ তাঁর প্রণয়ীর অভাবে সেই পিতৃ-ভিটায় সারাংপুরের দ্বারস্থ হতে হলো তাঁকে।
আদম খান চারদিকে লোক পাঠিয়েছেন রূপমতিকে ধরে আনার জন্য। একদল সৈন্য হাজির হলো সারাংপুরে। হ্যাঁ, ভাইয়েদের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন রূপমতি।
রূপমতিকে ধরার জন্য সৈন্যেরা তাঁর তিন ভাইকে মেরে ফেলে রূপমতিকে নিয়ে চললো মাণ্ডুর প্রাসাদে।
আদম খানের আদেশে দাসীরা রূপমতিকে সাজাতে বসলো। মেঘাচ্ছন্ন পূর্ণচন্দ্রের মতো তাঁর রূপ। ক্লান্ত ও মলিন। কিন্তু ভিতর থেকে আলোর জ্যোতি ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
সন্ধ্যার পরে আদম খান এলেন রূপমতির কাছে। দীর্ঘকালের আকাঙ্ক্ষা এবার পূরণ হবে, সেই আনন্দে সুরায় বুঁদ হয়ে, রূপমতির ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকলেন ঘরে। নিজের জুতোর আওয়াজ ছাড়া ঘরে আর কোনও শব্দ নেই। বিছানার উপরে শায়িত এক সুসজ্জিতা নারী, স্থির ও চিত্রার্পিত।
আদম খান খুব বিস্মিত হয়ে, সেই শায়িত নারীর গায়ে হাত রাখতেই, চমকে উঠলেন! রানি রূপমতির শরীরে প্রাণ নেই। হিরের গুঁড়ো পান করে তিনি চলে গেছেন স্বর্গের সুর-লোকে।
ভয়ে আর্তনাদ করে বাইরে বেরিয়ে এলেন আদম খান।
রূপমতির জীবনীকার ফার্সিভাষায় লিখছেন, “রূপমতি তাঁর প্রণয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য জীবন দিয়েছেন এবং এই বিশ্বস্ততা তাঁকে অমরত্বের মুকুট দিয়েছে।”
***
সম্রাট আকবরের ডাকে আদম খান মাণ্ডু ত্যাগ করে দিল্লিতে ফিরে গেলেন।
আদম খানের বদলে এবার এলেন পির মহম্মদ খান ।
বাজবাহাদুর আশ্রয় নিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের খাণ্ডেশ শহরে। বাঁচার তাগিদে খাণ্ডেশের সুলতান মিরন মুবারক খান ও বিদর্ভের সুলতান তুফাল খানের সাহায্য নিয়ে আক্রমণ করলেন নতুন সেনাপতিকে। তাঁদের যৌথ আক্রমণে পির মহম্মদ খান প্রাণ হারালেন। মোগল সেনারা পালিয়ে বাঁচল।
এই সংবাদ পেয়ে সম্রাট আকবর খুব রুষ্ট হলেন। বাজবাহাদুরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি এবার আবদুল্লাহ খানকে মালওয়া পাঠালেন। ১৫৬২ সাল। আবদুল্লাহ খান দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে বাজবাহাদুরকে আক্রমণ করলেন।
বাজবাহাদুর মোগলবাহিনীকে প্রতিহত করতে না পেরে গণ্ডোয়ানা পাহাড়ে পালিয়ে গেলেন। পরে তিনি মেওয়ারের রানা উদয় সিংয়ের কাছে কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় পেলেন। যেখান থেকে তিনি গুজরাটে লুকিয়ে থাকলেন, অবশেষে তিনি আকবরের করুণাভিক্ষা করে আত্মসমর্পণ করলেন। কেউ বলেন, বাজবাহাদুর রাজস্থানের নাগৌরে সম্রাট আকবরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আকবর তখন নাগীঊরে অবস্থান করছিলেন (ঐতিহাসিক রমেশ্চন্দ্র মজুমদার)। অন্যেরা বলেন, সম্রাট আকবর তখন আগ্রায় অবস্থান করছিলেন, সেই আগ্রায় হাজির হয়েছিলেন বাজ বাহাদুর (ঐতিহাসিক গোলাম ইয়াজদানি) ।
সম্রাট তাঁকে প্রাণে না মেরে, অনুগ্রহ দেখিয়ে ২০০০ সেনার একটি মনসবদারের চাকরি দিলেন (ঐতিহাসিক গোলাম ইয়াজদানি)।
রমেশ্চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, এটা ১৫৭০ সালের ঘটনা।
***
এরপর কেমন কেটেছিলো বাজবাহাদুরের জীবন ?
ইতিহাস একেবারে নীরব।
শুধু জানা যায়, সারাংপুরের এক সরোবরের মধ্যে একটি ছোট্ট দ্বীপে রানি রূপমতিকে সমাধিস্থ করা হয়।
বাজবাহাদুরের মৃত্যুর পরে, তাঁর প্রিয়তমা রানির পাশেই তাঁর ঠাঁই হয়।
ক্যাপ্টেন এ্যাবট নামে এক ব্রিটিশ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, “মালওয়ার সারাংপুরে রানি রূপমতির সমাধি সংরক্ষিত। আমরা নিজেরাই সেখানে গেছি (১৮৩৫ সাল)। নারীর প্রেমের প্রতি সংবেদনহীন, যেমনটি সাধারণত ভারতের নেটিভেরা হন। তাঁর অতুলনীয় সৌন্দর্য, স্থিরতা এবং করুণা তাঁদের ঐতিহ্যে প্রোথিত আছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে কেউ যদি সেই সমাধিতে “রূপ-মতি” বলে ডাকে তবে প্রতিধ্বনিটি তাঁর নামের পুনরাবৃত্তি নয় বরং তাঁর হৃদয়ের প্রিয় পুরুষ বাজবাহাদুরের নাম নিয়ে ফিরে আসে।”
ফার্সি ভাষায় THE LADY OF THE LOTUS বইয়ের ইংরেজি অনুবাদক এল এম ক্রাম্প ১৯২৬ সালে লিখছেন, “হায়! আজ গম্বুজটি পড়ে গেছে এবং প্রতিধ্বনিও নেই” !
মধ্যপ্রদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জানাচ্ছে, সম্রাট আকবর রূপমতির মৃত্যুর কথা শুনে দুঃখ পেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। আকবর রূপমতির মৃতদেহ সারাংপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন (যে জায়গা থেকে তিনি এসেছিলেন) এবং সমাধি নির্মাণ করেন।
বাজবাহাদুর সম্রাট আকবরের অধীনে কাজ করার সময় একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে সারাংপুরে রানি রূপমতির সমাধির কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তিনি উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ও প্রাণবায়ু ত্যাগ করেন। তাঁর মৃতদেহও রূপমতির সমাধির পাশেই সমাধিস্থ করা হয়।
সম্রাট আকবর রানি রূপমতির কবরে “শহিদ-ই-ওয়াফা” এবং বাজবাহাদুরের কবরে “আশিক-ই-সাদিক” (সত্যিকারের প্রেমিক) শব্দগুলি খোদাই করে দিয়েছিলেন। সমাধিটির চার পাশেই গেট রয়েছে এবং ভিতরের কক্ষ রয়েছে। নীচে থেকে এটি যথাক্রমে বর্গাকার এবং তারপর অষ্টভুজাকার এবং ষোলটি বৃত্তাকার এবং এর উপরের অংশটি গোলাকার। গম্বুজ ও কবর দুটিই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এক সময় এখানে একটি খুব বড় স্মৃতিস্তম্ভ ছিল। সেটি এখন ধ্বংস হয়ে গেছে । তবে বাজবাদুর এবং রূপমতির সত্যিকারের প্রেমের কিংবদন্তি এখনও বেঁচে আছে। এটি সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশ রাষ্ট্রীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিগ্রহণ করেছে এবং কিছু কিছু পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।