ট্রেড এন্ড কমার্সিয়াল অর্গানিজেশন ইন বেঙ্গল ১৬৫০-১৭২০, উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু দ্য ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
সপ্তম অধ্যায়
বাঙলার ব্যবসা জগতে কোম্পানি
কোম্পানি ও দেশিয় ব্যবসা (কান্ট্রি ট্রেড)
পণ্য পরিবহণের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ চরিত্র হল, প্রথম দিকে মণ প্রতি পণ্যের ভাড়া অনেক বেশি হলেও পরের দিকে ডাচ আর দেশিয় বণিকদের বিপুল প্রতিযোগিতায় মণপ্রতি ভাড়া অনেক কমে যায়। ১৬৪২ সালে জনৈক কোম্পানি বহির্ভূত ব্যবসায়ীর জাহাজ হোপওয়েল ৪০টাকা মাথাপিছু যাত্রী এবং ১৫টাকা প্রতি মণে (৬৪ পাউন্ড-এর) পারস্যে যাত্রী-পণ্য পরিবহন করেছে (ওসি, ১৪ আগস্ট, ১৬৪২, ১৭৮৪, ১৮ খণ্ড)। ১৬৮৮-তে পারস্যে যাত্রী ভাড়া কমে হয় ৩০টাকা আর পণ্য পরিবহনের জন্যে ভাড়া হয় মণ (৭৪ পাউন্ডের) প্রতি ১০টাকা (বিএম এডি ম্যানু, ৩৪,১২৩, ৩৬এ)। কোম্পানির পণ্য পরিবহনের ভাড়া আরও কমে হয়ে যায় ৮ থেকে ৯টাকা প্রতি মণ অষ্টাদশ শতকের প্রথম দুই দশকে; অন্যদিকে দেশিয় জাহাজ পণ্য পরিবহন করত আরও এক-দুটাকা কমে ৬ থেকে ৭টাকায় (সি এন্ড বি এবস, খণ্ড ১, ৪৪৮, খণ্ড ২, ১৪৪; বিপিসি, রেঞ্জ ১, খণ্ড ৩, ৪৬৩-এ। জানা যাচ্ছে ১৬৮৫-তে কোম্পানি ৫০টাকায় যাত্রী পরিবহন করেছে এবং ভাল পণ্য মণ প্রতি ১৬টাকায়, ২০ টাকায় মোটা মাল, দেখুন, ওসি, ৩১ ডিসে, ১৬৮৫ ৫৪৫২, ৪৫ খণ্ড)। ভাড়ার দামের পতনের একটা কারণ হতে পারে বাংলা-সুরাট বা বাংলা-পারস্যের ব্যবসার পরিমান কমে যাওয়া, কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পিছনে এখনও প্রমান পাওয়া যায় নি। তাই ভাড়া কমার একটাই কারণ ধরে নিতে হবে, ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি এবং দেশিয় ব্যবসায়িদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হওয়া। এটাও দেখা গিয়েছে বহু ইওরোপিয় ব্যবসায়ি দেশিয় জাহাজে পণ্য পরিবহন করেছেন। ১৭০৫-এ ক্যাপ্টেন হ্যামিলটন ৬০০ টনের ভেঙ্কটেগিরি জাহাজটি ভাড়া করেন বাংলায় পণ্য পরিবহনের জন্যে। এই জাহাজে তিনি বাংলায় সুরাটের বহু মুসলমান ব্যবসায়িদের পণ্য ছাড়াও নিজের জন্যে ৬ বেল এবং ২ চেস্ট রেশম, ৪৬৭ বেল সুতি কাপড় নিয়ে আসেন (বিপিসি, রেঞ্জ ১, খণ্ড ১, ২২০)।
ব্যক্তিগত এবং ইন্টারলোপারদের ব্যবসা
আমরা যে সময় নিয়ে আলোচনা করছি, সেই সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাথা ব্যথা ছিল আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা এবং ইন্টারলোপারদের কাজকর্ম, যা কোম্পানির বাঙলার ব্যবসা বিনিয়োগকে প্রভাবিত করছিল। ব্যক্তিগত ব্যবসা করত কোম্পানির আমলারা আর কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত না থাকা ব্যবসায়ীরা, যাদের কোম্পানির খাতায় ফ্রি মার্চেন্ট্ররূপে উল্লেখ করা হয়েছে। যে সব কুঠিয়াল ব্যক্তিগত ব্যবসা করতেন, তারা স্বাভাবিকভাবে কোম্পানির স্বার্থ হানি করেই ব্যক্তিগত ব্যবসা চালিয়ে যেতেন এবং তাদের কোম্পানির প্রতিযোগী হিসেবেই দেখা হত। বহু সময়ে ব্যবসায়ীরা মধ্যস্থ বা দালালদের একটি বেশি অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিত এবং কোম্পানির দাদনের অর্থেই নিজেদেরব্যবসা চালাত ফলে কোম্পানির যে সব পণ্য ফিরিতি জাহাজ করে যাচ্ছে, তাতে কোম্পানির ক্ষতি হত।
বাংলায় ব্যবসার প্রথম যুগে কোম্পানি তার আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বন্ধ করার সদর্থক উদ্যগ নিয়েছিল। সপ্তদশ শতকের পাঁচের দশকে মাদ্রাজ কাউন্সিলের অভিযোগ ছিল, শুল্কের জন্যে বাঙলার কুঠিয়ালেরা সরকাররের কোষাগারে যে অর্থ দিচ্ছে, সেটিতে কোম্পানির বদলে আমলাদের স্বার্থ সিদ্ধি হছে (ব্রুস, প্রাগুক্ত। খণ্ড ১, ৪৮৫)। বাংলায় ব্রুজম্যান এবং তার সাথীরা বিপুল অঙ্কের ব্যক্তিগত ব্যবসা করতেন। ১৬৫৬-র জানুয়ারিতে ডাচ কুঠিয়ালেরা লিখল, তিনটে ছোট ব্যক্তিগত ব্রিটিশ জাহাজ বাংলায় এসেছে এবং ব্রিটিশরা আদতে ব্যক্তিগত ব্যবসাই করছে, এবং যে সব ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী লন্ডন থেকে বাংলায় আসছে, আমাদের মনে হয়েছে তাদের হয়ে কুঠিয়ালেরা ব্যবসা চালাচ্ছে এবং এই জন্যে তারা ভালই অর্থ পাচ্ছে (ট্রানজাকশন অব ডাচ রেকর্ডস, খণ্ড ২১টি, ৬৫৫ সংখ্যা ১)। কোম্পানি শীঘ্রই সমস্ত ব্যক্তিগত ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে (ব্রুস, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, ৪৩২; উইলসন, প্রাগুক্ত, খণ্ড ১, ৩৩। সোরা, কোরা রেশম এবং অন্য কয়েকটি কোম্পানির ব্যবসার জন্যে সংরক্ষিত পণ্য যেমন তাফেতা, নিলী ইত্যাদি টুকরো কাপড় বাদ দিয়ে অন্য যে কোনও পণ্য নিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা খুশি মনে ব্যবসা করতে পারত)। এতদসত্ত্বেও কোম্পানির পক্ষে শুধু বাংলা নয়, সর্বভারতীয়স্তরেও আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হয় নি।
১৬৬০-এ সুরাট কুঠিকে লিখে কর্তারা জানালেন, কিছু কুঠিয়াল (আমরা সব ধরণের ব্যক্তিগত ব্যবসা নিষিদ্ধ করেছি জেনেও) তারা পণ্যচলাচলের ব্যবসায় নিযুক্ত থেকে বন্দর থেকে বন্দরে চালু ব্যবসায় ব্যক্তিগত ব্যবসা চালায়। কর্তারা নতুন করে কুঠিয়ালদের জানাল যে, আবারও জানাচ্ছি, কোনও অবস্থাতেই কোনও কোম্পানি চাকুরেকে ব্যক্তিগত ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না (এবং যদি সংবাদ পাই, তাহলে সেই ব্যবসা ধ্বংস করা হবে) কারণ এই ধরণের ব্যবসা আমাদের দেশের জনগণের পক্ষ অতীব ক্ষতিকর (ডিবি, ৯ এপ্রিল, ১৬৬০, ৮৫ খণ্ড, ২৯৫)। কিন্তু এই হুঁশিয়ারির খুব বেশি ফল ফলল না। ১৬৮১তে কোর্ট অব ডিরেক্টরেরা আবার অভিযোগ করে লিখলেন, বাঙলার কুঠিয়ালেরা ব্যক্তিগত ব্যবসায় নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছেন (ডিবি, ৫ জানুয়ারি, ১৬৮১, ৮৯ খণ্ড, ২৭০)।
ব্যক্তিগত ব্যবসার পদ্ধতিটি হল, আন্তঃএশিয় ব্যবসা এবং দেশের মধ্যে দেশিয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় জাহাজ ভাড়া দেওয়া বা ব্যবহার করা। ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা বহু সময় দেশের ভূমিপথে ব্যবসায় নিযুক্ত থেকে নিজেদের খাতা খুলে ইংলন্ডে পণ্য পাঠাতেন। বাঙলার ব্রিটিশ ব্যবসার প্রথম পাদে, বটন, ব্রিজম্যান এবং ব্রুকহেভেনের মত কোম্পানির আমলা এবং ফ্রি মার্চেন্টরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা চালাবার জন্যে নিজেদের জাহাজ চালাতেন সুরাট, গম্ব্রুন এবং পারস্যের অন্যান্য বন্দরগুলির পথে (ওসি, ১১ জুলাই, ১৬৫৩, ২৩৩২, ২৩ খণ্ড)। আমরা যে সময় নিয়ে আলোচনা করছি, সেই সময়জুড়ে কোম্পানির বহু কুঠিয়াল, যে সব জাহাজ পণ্য ব্যবসায় নিযুক্ত ছিল, তার অনেকগুলির মালিকও ছিলেন। ১৬৮৭তে জন বেয়ার্ডের জাহাজ নীলগিরি, ম্যানিলা থেকে এই ধরণের একটি ব্যবসায়িক যাত্রা শেষ করে ফেরে (ফ্যাক্ট্রি রেকর্ডস, বালেশ্বর, খণ্ড ১, কনসালটেশন, ৫ জানুয়ারি, ১৬৮৬)। একইভাবে বালেশ্বরের একটি কনসালটেশনে বালেশ্বর কুঠির প্রধান Fitzhugh-র মালিকানার জাহাজের উল্লেখ আছে (প্রাগুক্ত, কনসালটেশন, ১৭ নভেম্বর, ১৬৮৬)। এডওয়ার্ড লিটলটনের বাঙলার আরমেনিয় আর Cuttaree-দের মালপত্র নিয়ে পারস্যের সঙ্গে ব্যবসা করা জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়লে সেটি ৪০,০০০ টাকায় বিক্রি করা হয় ১৭০১ সালে (ওসি, ২৫ নভেম্বর, ১৭০১, ৮৫৯২ সংখ্যা, ৭০ খণ্ড)। তার আরেকটি জাহাজ ছিল সারা এন্ড জেমস, যেটি মূলত ব্যক্তিগত ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হত (ওসি, ১১ ডিসেম্বর, ১৭০৩, ৮২১৩ সংখ্যা, ৬৬ খণ্ড)। এই ধরণের হাজারো উদাহরণ দেওয়া যায়।
ভূমিপথের ব্যবসায় ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা এমন বেশ কিছু পণ্য নিয়ে ব্যবসা করত যাতে নিশ্চিত লাভের হাতছানি থাকত। ১৬৭৮ সালে হুগলী থেকে এডওয়ার্ড রিড, বালেশ্বরের রিচার্ড এডওয়ার্ডকে লিখলেন, তারকাছে থাকা লঙ্কা (long pepper) এবং চালের কমিশন কেটে তার কাছে পাঠাতে এবং টেনাসরিম থেকে আগত জাহাজ থেকে তার হয়ে টিন কিনে রাখার জন্যে (ওসি, ৩ এপ্রিল, ১৬৭৮, ৪৩৯২; ২০ এপ্রিল ১৬৭৮, ৪৪০১, ৩৯ খণ্ড; ২৮ এপ্রিল ১৬৭৮, ৪৪০২ সংখ্যা, ৩৯)। একটা গুরুত্বপূর্ন বিষয় লক্ষ্যকরার মত, কোম্পানির আমলারা ব্যক্তিগত ব্যবসা বারাবার কাজে পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্বপুর্ণ যোগাযোগ বজায় রাখতেন। বাঙলার কুঠিয়ালেরা বাঙলার বাইরের সহকর্মীদেরও ব্যবসায় খুবই সাহায্য করতেন। মাদ্রাজের গভর্নর টমাস পিট যে শুধু ব্যক্তিগত ব্যবসার কারণে বাঙলার প্রেসিডেন্ট বেয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তাই নয়, তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ী র্যালফ শেলডন, কারজেনভেন ইত্যাদির সঙ্গেও ঘিনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রাখতেন (বিএম, এডি ম্যানু, ২২,৮৪৩, খণ্ড ২, ৬৬-৬৭)। ১৭০০-য় পিট খ্বোজা শুরহুদকে লিখে নিজের পারস্যগামী জাহাজ সেজইক, আরেকটি মোকার দিকে যাওয়া জাহাজের জন্যে সুন্দর সুন্দর পণ্য এবং ভাল মাল বহনের দাম চান (বিএম, এডি ম্যানু, ২৮,৮৪২, খণ্ড, ৭৫-৭৬)। (চলবে)