দৈবভূমি ভারতবর্ষ। হাজার হাজার বছর ধরে অসংখ্য ঋষি,সন্ন্যাসী এবং দার্শনিকের জন্মস্থান এই ভারত। এই দেবভূমিতে এক বিরাট ধর্মসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় চারটি জায়গায় প্রয়াগ, হরিদ্বার, উজ্জয়নী এবং নাসিকে। প্রতি ১২ বছর অন্তর এই চারটি জায়গায় পূর্ণকুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য একই বছরে চার জায়গায় হয় না, প্রতিটি জায়গায় আলাদাভাবে ১২ বছর পর হয়।
১৪৪ বছর পর, এবছর বিশ্বাস দেবত্ব এবং শ্রদ্ধার সঙ্গমে চলছে মহাকুম্ভ প্রয়াগরাজে। অতি পবিত্র স্থান এই প্রয়াগ। এখানে গঙ্গা-যমুনা এবং সরস্বতীর (অন্তঃসলিলা) সঙ্গম ঘটেছে। এই ত্রিবেণীতে স্নানের অনেক পুণ্যফল থাকে। কুম্ভমেলার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অমৃতস্নানের তারিখ পড়েছে আগামীকাল অর্থাৎ ২৯ শে জানুয়ারি। এই দিন রয়েছে মৌনী অমাবস্যা। ভক্তরা বিশ্বাস করেন এই দিন গঙ্গার জল অমৃতে পরিণত হয়। সেই কারণে মৌনী অমাবস্যায় পুণ্যস্নান বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ।
এদিন প্রয়াত পিতৃপুরুষের নামে তর্পণ ও দান করার রীতিও প্রচলিত আছে। এই দিন উপবাস রেখে স্নান করেন পুণ্যার্থীরা। পাশাপাশি এই আমাবসায় মৌনতা বজায় রাখার রীতিও প্রচলিত আছে। মৌনতা পালন করলে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা ও ধ্যান করা আরও সহজ হয়।এই তিথিতে সাধক মৌন থেকে সত্য আত্মসংযম পালন করেন।আত্মিক শান্তি ও সাধনায় গাম্ভীর্য আনার মাধ্যম হল মৌন ব্রত পালন।
মহাকুম্ভ এক অশেষ শক্তির উৎসস্থল যেখানে জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, আধ্যাত্মিকতা, পরম্পরাগত আচার-আচরণ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথা ও অভ্যাস এক মোড়কে আবদ্ধ। এ যেন এক বহির্জাগতিক অভিজ্ঞতা। আপনার বিশ্বাস এখানে সাক্ষী থাকবে প্রেম ও ভক্তির বিশুদ্ধতায়। আপনার আত্মা উপলব্ধি করবে এক চিরন্তন জাগরুকতা। কোটি কোটি পুণ্যার্থী আগামীকাল মহাকুম্ভে পুণ্য স্নান করবেন।
মহাকুম্ভে মোট ছয়টি স্নান হয়। তিনটি রাজকীয় স্নান এবং তিনটি প্রধান স্নান রয়েছে। যদিও সমগ্র কুম্ভের জন্য প্রতিদিন স্নান করলে পুণ্য পাওয়া যায়, তবে শাহী স্নানের দিনটির একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। প্রয়াগরাজে এইবার শাহীকুম্ভ স্নানের দিনগুলি হল:
১) জানুয়ারী ১৩, ২০২৫ : পৌষ পূর্ণিমা — এটি প্রথম শাহী স্নান।এই দিনটি মহাকুম্ভ মেলার অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।পৌষ পূর্ণিমা কল্পবাসের সূচনাকে চিহ্নিত করে, একটি তীব্র আধ্যাত্মিক অনুশীলন এবং ভক্তির সময়কাল যা মহা কুম্ভ মেলার সময় তীর্থযাত্রীদের দ্বারা পালিত হয়েছিলো।
২) ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫ : মকর সংক্রান্তি (দ্বিতীয় শাহী স্নান) — মকর সংক্রান্তি হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে সূর্যের তার পরবর্তী জ্যোতির্বিদ্যাগত অবস্থানে স্থানান্তরকে নির্দেশ করে। এই শুভ দিনটি মহাকুম্ভ মেলায় দাতব্য অনুদানের সূচনাকে চিহ্নিত করে।
৩) জানুয়ারী ২৯, ২০২৫ : মৌনী অমাবস্যা, তৃতীয় শাহী স্নান।
৪) ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ : বসন্ত পঞ্চমী (চতুর্থ শাহী স্নান) — বসন্ত পঞ্চমী ঋতু পরিবর্তনের প্রতীক এবং হিন্দু পুরাণে জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর আগমন উদযাপন করে। ভক্তরা স্নান করে এবং প্রাণবন্ত হলুদ পোশাকে নিজেদের সজ্জিত করে, এই শুভ অনুষ্ঠানের গুরুত্ব তুলে ধরে।
৫) ফেব্রুয়ারী ১২, ২০২৫ : মাঘী পূর্ণিমা — পঞ্চম শাহী স্নান। দিনটি ঋষি ও সন্ন্যাসীদের জন্য এক মাসব্যাপী তপস্যার সময়কালের সমাপ্তি চিহ্নিত করে৷
৬) ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ : মহাশিবরাত্রি — ষষ্ঠ বা শেষ শাহি স্নান । মহা কুম্ভের শেষ দিনটি মহা শিবরাত্রিতে পড়ে যা ভগবান শিবের বিবাহকে সম্মান করে এবং আধ্যাত্মিক বৃদ্ধির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিন।
বৈদিক পঞ্জিকা অনুসারে, মাঘের অমাবস্যা তিথির নাম মৌনী অমাবস্যা। এই মৌনী অমাবস্যায় অত্যন্ত শুভ সংযোগ তৈরি হতে পারে। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, এই তিথিতে মকর রাশিতে সূর্য, চন্দ্র ও বুধ উপস্থিত থাকবে। যার প্রভাবে ত্রিবেণী যোগ হবে। একইসঙ্গে বৃহস্পতির সঙ্গে এই তিন গ্রহের নবমপঞ্চম যোগ হবে।এই বিরল যোগও এই তিথিকে আলাদা মাহাত্ম্য এনে দিচ্ছে।
এই মৌনী অমবস্যা তিথি : পঞ্জিকা অনুযায়ী, মঙ্গলবার ২৮ জানুয়ারি ০৭ টা ৩৫ মিনিট থেকে মৌনী অমাবস্যার তিথি শুরু হবে। এই তিথি শেষ হবে ২৯ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬ টা ০৫ মিনিটে। ফলে মৌনী অমাবস্যা ২৯ জানুয়ারি হবে পালিত হবে। মৌনী অমাবস্যার ব্রাহ্ম মুহূর্ত থাকবে ২৯ শে জানুয়ারি ভোর ৫:২৫ মিনিট থেকে ভোর ছটা ১৮ মিনিট পর্যন্ত।
পুরাণ অনুযায়ী ঋষি মনু এই তিথিতেই জন্মেছিলেন বলে এই তিথির নাম মৌনী অমাবস্যা। এদিন থেকেই দ্বাপর যুগের শুরু।
আবার অনেকেই মনে করেন, এই তিথিতে মৌনব্রত অশুভ শক্তির বিনাশ করে বলে তিথির নাম মৌনী অমাবস্যা। আবার জ্যোতিষস্ত্র অনুযায়ী মনের দেবতা চন্দ্রদেব। মাঘী অমাবস্যার রাতের আকাশে চন্দ্রদেবকে দেখা যায় না। অন্যান্য অমাবস্যার তুলনায় এই অমাবস্যার রাত অনেক বেশি কালো হয়। তাই মানুষের মন বিহিত ও অশান্ত হয়ে ওঠে। মনকে শান্ত করার জন্য মৌনব্রত পালন করা হয়। তাই এই অমাবস্যার নাম মৌনী।
শাস্ত্র মতে এই দিন সমস্ত নদী-সহ গঙ্গার জল বিশেষ পবিত্র হয়ে ওঠে৷ এদিন নদীর জল অমৃতসম হয়ে ওঠে বলে বিশ্বাস৷ অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে যে পরিমাণ পুণ্য হত এদিন নদীতে স্নান করলে সেই পুণ্য অর্জন হয়৷ যদি নদীতে বা তীর্থ স্থানে গিয়ে স্নান করা না সম্ভব হয় তাহলে বাড়িতে স্নান করে ধর্মাচরণের মধ্যে দিয়ে দিনটি অতিবাহিত করা উচিত ৷
এ বছর মৌনী অমাবস্যায় শিববাস যোগ রয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিন ভগবান শিব মা গৌরীর সঙ্গে কৈলাস উপবিষ্ট থাকবেন। গ্রহ দোষ থাকলে অনেকই শিব মন্দিরে যেতে যান মুক্তি লাভের জন্য। মহাদেবকে রুদ্রাক্ষের মালা অর্পণ করতে হয় এবং ধুপ নিবেদন করতে হয়। বিধিমতে নিবেদিত রুদ্রাক্ষের মালা পুজো করে করার পর নিজের কাছে রাখতে হবে বা কণ্ঠে ধারণ করতে হবে।গায়ত্রী মন্ত্র বা মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করুন।
এই দিন সাধ্যমত কুষ্ঠরোগী এবং দরিদ্রদের দান করতে হবে। তিলের তৈরি মিষ্টি, কালো বা নীলকম্বল উলের বস্ত্র দান করা কর্তব্য।
শাস্ত্র অনুযায়ী, মৌনী অমাবস্যার সন্ধ্যায় অশ্বত্থগাছের নিচে প্রদীপ জ্বালাতে হয় কিম্বা তুলসী তলের প্রদীপ দিন। এছাড়াও, ভক্তরা বিশ্বাস করেন এদিন সূর্যদেবকে দুধ ও তিলের বীজ অর্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে মনের সব ইচ্ছা পূরণ হয়। পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ পেতে মৌনী অমাবস্যায় হলুদ রঙের পোশাক পরুন এবং নিজের পূর্বপুরুষের নামে ধ্যান করুন।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ মথুরাবাবুর সঙ্গে ১৮৬৩ এবং ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে দুবার প্রয়াগ ও ত্রিবেণী দর্শন করেছিলেন। তিনি গঙ্গা যমুনা সঙ্গমে স্নান ও তিনরাত বাসও করেন। ঠাকুরের প্রয়াণের পর মা সারদাদেবী ঠাকুরের অবশিষ্ট কেশ প্রয়াগে গঙ্গা যমুনা সঙ্গমস্থলে বিসর্জন দেন।
পরে এই প্রসঙ্গে মা বলেছিলেন, ‘ঠাকুরের চুল কি কম জিনিস! তাঁর শরীর ত্যাগের পর যখন প্রয়াগ যাই, তখন তার চুল তীর্থে দেওয়ার জন্য সঙ্গে নিয়েছিলাম। গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমের স্থির জলের কাছে ওই চুল হাতে নিয়ে জলে দেবো মনে করেছি, এমন সময় হঠাৎ একটি ঢেউ ওঠে ওটি আমার হাত থেকে নিয়ে আবার জলে মিলিয়ে গেল।তীর্থ পবিত্র হওয়ার জন্য তাঁর চুল আমার হাত থেকে নিয়ে গেল।’ প্রয়াগতীর্থ তাই জীবন্ত তীর্থ।
অনেকে ধারণা, বৃদ্ধ বয়সে তীর্থ করতে হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত ভুল কথা। কুম্ভস্নানের মত তীর্থ করতে হলে ২০ থেকে ৬০ বছর বয়সের মধ্যেই করা শ্রেয় কারণ তখন শরীর শক্ত থাকে। বৃদ্ধ বয়সে শরীর অশক্ত হয়ে পড়ে তখন তীর্থযাত্রা করা কষ্টকর। অল্প বয়সে তীর্থ করাই শ্রেয়। সম্ভব হলে ঘুরে আসুন প্রয়াগরাজে।
বলা হয়, যে পরমাত্মার সন্ধানে সাধক এবং যোগীরা কঠোর তপস্যা করেন, কুম্ভে একবার স্নান করে সেই একই ফল লাভ করতে পারেন সাধারণ মানুষ। মৌনী অমাবস্যায় কুম্ভ স্নান করলে হাজার বার অশ্বমেধ যজ্ঞর ফল লাভ হয়। কুম্ভমেলা তাই প্রকৃত অর্থেই ভারতের সর্ববৃহৎ ধর্ম সম্মেলন।
সুন্দর হয়েছে।
ধন্যবাদ