গ্রামে গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একটা সময় ঢেঁকি ছিল। ছিল বড়ো ঢেঁকশালও । ঠাকুমা, মা-কাকিমাদের পায়ের তালে তালে ঢেঁকির আওয়াজ শোনা যেত। ধান থেকে চাল, আর চাল থেকে চালগুঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। ঢেঁকি-ছাটা লাল চালের সুস্বাদু ভাত ও নানান রকম পিঠে আজও লোকমুখে শোনা যায়। তাই বয়স্কদের মুখে মুখে একটাই আফশোস ঢেঁকি নেই, সেই পিঠেও নেই। গ্রামীন সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার তাগিদও কারোর নেই।
প্রসঙ্গত, গাম-গঞ্জের ছোট ছোট ঘটনা আজও স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে। যতদিন যাচ্ছে সেই সমস্ত ঘটনাগুলি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিচ্ছে। আজকের প্রজন্মের কাছে ওই সমস্ত ঘটনা গল্প বলে মনে হচ্ছে। কয়েকটি ঘটনা যা আজকের সমাজের মহিলাদের কাছে বানানো গল্প বলে মনে হয়, সেগুলোর কথা তুলে ধরলে বোধহয় বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। তাছাড়া তৎকালীন সমাজের চিত্রটাও ধরা পড়বে। উল্লেখ করতেই হয় ঢেঁকির কার্যকলাপ। একটা সময় প্রতি বাড়িতে ঢেঁকশাল ছিল। আর সেখানেই বসানো থাকত টেঁকি। মা-ঠাকুমা, দিদি, মাসিদের দেখতাম ঢেঁকিতে ধান ভাঙতে। চাল গুঁড়োতে। তালে তালে পা দিয়ে ঢেঁকিতে ছাঁটা হত ধান। সেই ধান থেকে লাল ছাপ মারা চাল বের হত। যখন ওই চালের ভাত হত, দেখতাম আলাদা সুগন্ধ প্রকাশ পেত। ছেলেমেয়েদের দেখতাম সেই সুস্বাদু ফ্যানা-ভাত খেয়ে স্কুল-কলেজে যেতে। এখন সেই চালও নেই, সুস্বাদু ভাতও নেই।
এখন আছে রাইসমিলের চকচকে চাল। পালিশ করা। উপরের লাল খোলাটুকুর চিহ্ন নেই। ফলে এর নাকি ফ্যানা-ভাত হয় না। হলেও মুখে রোচে না, রুচবেই বা কী করে! এখন যে কীটনাশক মাখানো ওষুধের গন্ধ গা থেকে যায়নি। তাই কষ্ট হয়। মনে মনে ভাবি কবে ফিরে পাব সেই ঢেঁকিছাঁটা চাল, গুঁড়ি। যা দিয়ে সুস্বাদু ফ্যানাভাত, পিঠে-পুলি তৈরি হবে। না! এ আশা মনেতেই রয়ে যায়। ঢেঁকিগুলো আর দেখতে পাই না। ঢেঁকশালও নেই। নেই নীলমণি, রাধা, শ্যামাদের মতো বউরা। যাঁরা অনায়াসে বাচ্চা ছেলে কোলে নিয়ে ঢেঁকিতে পা দিতে পারত। সেই দৃশ্যও আর দেখি না। তা হল মায়ের কোলেই বাচ্চা কাঁদছে। সেই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে নীলমণিদের মতো বউয়েরা জামা খুলে বুকের দুধ টানার জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। বাচ্চা দুধ খাচ্ছে, নীলমণি আদর করে, সোহাগ করে বাচ্চার আশা মেটাচ্ছে, আর অপরদিকে রাতে সোয়ামীকে খুশি করতে পিঠের গুঁড়ি তৈরি করছেন। সন্ধ্যা হলে সোয়ামী মাঠ থেকে বাড়ি ফিরবে। তারপর নীলমণি পিঠে করতে বসবে। লম্ফ জ্বেলে। কাঠের আগুনে পিঠে হবে। সেই দৃশ্য আজ অতীত।
আরও একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। তা হল ঘরে ঘরে পাথরের যাঁতা। যা দিয়ে ডাল শস্য, তিল ভাঙা হয়। আজ আর দেখি না। সে দিনটার কথা আজও মনে পড়ে, যখন দেখতাম হাবুর মা অদ্ভুত কায়দায় হাতের আঙুল দিয়ে তিলের খোসা ছাড়াচ্ছেন, কিংবা খেসারি, মটর, ছোলা, মুসুর, কড়াইয়ের খোসাও ছাড়াচ্ছেন উবু হয়ে। হাবুর মা জানে, কত পাক ঘোরালে তবেই খোসা ছাড়বে। দেখতাম প্রতি ঘরে হাবুর মতো মায়েরা আছেন। ডাল, ডালের বড়ি, তিল ভাজা, তিলের নাড়ু, তিল পোস্ত খাওয়া হত। এখন সেগুলি দোকান থেকে পাই। কিন্তু পাই না সেই স্বাদ। হারিয়ে গেছে হাবুর মতো মায়েরা। এখন অত্যাধুনিক প্রজন্মের মায়েরা আছেন, কিন্তু যাঁতায় পাক দিতে জানেন না। এঁরা জানেন দোকান থেকে প্যাকেট করা খাবার। কষ্ট নেই এঁদের। এঁদের দেখি আর ভাবি সেই দিন কী আর ফিরে আসবে না? অপেক্ষায় আছি সেই স্বাদ, অনুভূতি, পরশের ছোঁয়া পাব বলে।