ফি-বছর বন্যা। কখনও দুঃখের, কখনও কষ্টের। সেচ দফতরের উদাসীন মনোভাব কষ্টে ফেলছে এখানকার বাসিন্দাদের। বাসিন্দাদের অভিযোগ, এখানকার সেচ দফতর এখনও বাম মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এখনও আসি যাই মাইনে পাই — এই মানসিকতা এখানকার সকল কর্মীদের মধ্যে। এর ফলস্বরূপ দেখা যাচ্ছে ১৯৭৮ ও ২০০০ সালের দুর্যোগের পদধ্বনি। অতি গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে টানা কয়েক দিন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিভিসি-র তরফে আচমকা ছাড়া জল। সোমবার ও মঙ্গলবার দু’দিনে ডিভিসি মোট আড়াই লক্ষ কিউসেক জল ছেড়ে দিয়েছে। এই কারণে আরামবাগের ছ’ ব্লক সহ দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ জেলার বিস্তীর্ণ অংশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সব মিলিয়ে পুজোর মুখে বানভাসি দক্ষিণবঙ্গ।
এখন একটাই প্রশ্ন জনমানসে তা হল বিজ্ঞানের যুগেও ফি বছর বন্যা কেন? বন্যা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ জেলার নদীর নাব্যতা কমেছে। নদীগুলোর পাড় বলে কোনো অস্তিত্ব নেই। এছাড়া নদীর পাড়ে দাঁত কাটা ইঁদুরের পাকাপোক্ত বসবাস। এগুলিতে নজরদারি থাকার কথা সেচ দফতরের। এসব ব্যাপারে দফতরের কর্তারা একেবারে উদাসীন। এমনটাই অভিযোগ, স্থানীয় মানুষের।
উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে দুর্যোগের কারণে একাধিক মৃত্যুর খবর পৌঁছেছে। একইসঙ্গে মিলেছে ব্যাপক মাত্রায় বৈষয়িক ক্ষয়ক্ষতিরও দুঃসংবাদ। অতি বৃষ্টির ফলে বিঘার পর বিঘা কৃষিজমির ফসল জলে তলিয়ে গেছে। বাম মানসিকতার কর্মীরা কাজে এলেও একদিনও সময় হয়না নদীগুলোর পাড় পরিদর্শন করা। যেখানে আরামবাগ মহকুমায় ছ-টি ব্লকের বুকের উপর দিয়ে দ্বারকেশ্বর, মুণ্ডেশ্বরী ও দামোদর এবং একাধিক শাখা নদী বয়ে গেছে, অথচ নজর রাখার দায়িত্ব যাদের উপর তাঁরাই উদাসীন। ফলে ডিভিসি জল ছাড়লেই জনমানসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার আরামবাগের পুরশুড়ায় বন্যা পরিস্থিতি ক্ষতিয়ে দেখতে পরিদর্শন করেন। তিনি অবশ্য সকলকে আশ্বস্ত করেছেন। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাঁর প্রশাশন সবরকম ব্যবস্থা নিচ্ছে। সরকার দুর্গতদের পাশে আছে। প্রসঙ্গত, আরামবাগ শহরের একাংশ দ্বারকেশ্বর নদের জলে প্লাবিত হয়েছে। রাস্তার উপর দিয়ে জল বয়ে যায়। বুধবার অবশ্য জল অনেকটাই কমে। তবে আরামবাগ পুরসভার চেয়ারম্যান সমীর ভাণ্ডারীর সেচদপ্তরের কাজকর্ম নিয়ে ক্ষোভ কমেনি। এদিন তিনি বলেন, নদীর বাঁধ সংলগ্ন ওয়ার্ডে যেসব স্লুইস গেট রয়েছে সেগুলির অধিকাংশ খোলা। তারজেরে নদীর জল শহরে ঢুকছে। সেচদপ্তরের এই ঘটনায় তৎপরতা নেওয়া প্রয়োজন। বিষয়টি প্রশাসনকে জানিয়েছি। সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, চেয়ারম্যান যা দেখেছেন, তা নিয়ে বলেছেন। তবে সেচদপ্তর কাজ করছে না এমনটা নয়। চেয়ারম্যান যা বলেছেন, সেটিও আমাদের করতে হবে। সমীরবাবু বন্যার্তদের উদ্ধারের জন্য নৌকার দাবি জানিয়েছেন। আরামবাগ মহকুমায় বিভিন্ন জায়গা ইতিমধ্যেই প্লাবিত হয়ে গিয়েছে। নতুন করে খানাকুল, পুরশুড়ায় প্লাবনে চরম ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন বাসিন্দারা। ফলে অনেক জায়গাতেই বিচ্ছিন্ন হয়েছে যোগাযোগ। তাই বাসিন্দারা পর্যাপ্ত নৌকা, স্পিড বোটের দাবি জানাচ্ছেন। মঙ্গলবার প্রশাসনিক বৈঠক থেকে এই ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, দ্বারকেশ্বর, মুণ্ডেশ্বরী ও দামোদরের জল বাড়তে থাকায় বাঁধ ভেঙে বহু গ্ৰাম প্লাবিত। খানাকুলের বন্দরের জেলেপাড়া এলাকায় বাঁধের বড় অংশ ভেঙে যায়। সেই ভাঙা অংশ দিয়ে হু হু করে জল ঢুকছে গ্রামে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বহু এলাকা। জল ঢুকছে বাড়ি-ঘরেও। বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছে দামোদর, মুণ্ডেশ্বরী, রূপনারায়ণ। ফলে বন্যার প্রমাদ গুনছেন আরামবাগ মহকুমার বাসিন্দারা। মঙ্গলবার গোঘাটের গোয়ালসারা এলাকায় খালে ডুবে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। পুলিস জানিয়েছে, মৃতের নাম শ্রীকান্ত ঘোষ (৬০)। খালে মাছ ধরছিলেন তিনি। অসাবধানবশত পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। এদিকে, দামোদর ও মুণ্ডেশ্বরী নদীর জল বেশ কিছু এলাকায় ঢুকেছে। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিনই আরামবাগে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের আর এক মন্ত্রী বেচারাম মান্না, হুগলির জেলাশাসক মুক্তা আর্য-সহ সেচ ও অন্যান্য দপ্তরের আধিকারিকরা। মানসবাবু দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার ও আধিকারিকদের রাত জেগে কাজ করার নির্দেশ দেন। নিম্নচাপের বৃষ্টির জেরে গত রবিবার রাত থেকেই মহকুমায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। দ্বারকেশ্বর নদ উপচে যায়। খানাকুলের কিশোরপুরে দু’টি পৃথক জায়গায় বাঁধ ভেঙে যায়।
রাজ্য সড়কে জল দাঁড়িয়ে পড়ায় সোমবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। তবে বুধবার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। রাস্তা থেকে জল অনেকটাই নেমে গিয়েছে। তবে কালীপুর এলাকায় এখনও জল জমে রয়েছে। সেখানে ত্রাণ শিবির চলছে। গোঘাটের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন। এদিন গোঘাটের হাজিপুর, কোটা, পাবা প্রভৃতি এলাকা আরামবাগের সাংসদ মিতালি বাগকে নিয়ে পরিদর্শন করেন সেচমন্ত্রী। আরামবাগ, খানাকুল ও পুরশুড়ার বাসিন্দারা বানভাসি হয়ে পড়ায় প্রশাসন পাশে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই পুলিসের তরফে এলাকায় মাইকিং করে বাসিন্দাদের সতর্ক করা হয়েছে। দুর্গতদের উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। খানাকুলের বিভিন্ন জায়গায় নদীবাঁধ দুর্বল হয়ে রয়েছে। এদিন সকাল থেকে স্থানীয় বাসিন্দারাই বাঁধ মেরামতির কাজে হাত লাগান। এরমধ্যে বন্দরের জেলেপাড়া এলাকায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বিপত্তি হয়। সেখানকার বাসিন্দা দীপঙ্কর পোড়ে বলেন, দ্বারকেশ্বর ও শিলাবতী নদীর সংযোগস্থলের কাছেই বাঁধ ভেঙেছে। অনেক বাড়িতে জল ঢুকেছে। মারোখানার বাসিন্দা সুজিত পাল বলেন, সোমবার থেকেই পানশিউলি বাজার জলমগ্ন। মানসবাবু বলেন, ডিভিসি না জানিয়ে প্রচুর জল ছেড়েছে। তার জেরে খানাকুল, পুরশুড়া প্রভৃতি এলাকা প্লাবিত হয়ে গেছে। আরামবাগ মহকুমায় সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন।