ছোটবেলায় যখন মায়ের কাছ থেকে রাজা-রানীর গল্প শুনতাম,তখন মনে হতো চোখ ঝলসানো প্রাসাদে অজস্র ধনদৌলতের মধ্যে উপচে পড়া সুখের মধ্যে বাস করে রাজার রানী আর রাজকন্যারা। তাদের জীবন যেন সোনার তবকে মোড়া রূপকথার গল্পের মত। কিন্তু বাস্তবে সে গল্প বড়ই দুঃখের। রাজকন্যাদের প্রেম বা বিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোটেও সুখের হতোনা। হতাশা থেকে তারা হয়ে উঠতেন আরো আগ্রাসী। রাজত্বের বন্দীদশায় নিয়মের বেড়াজালে কত স্বপ্নই না ধূলিসাৎ হয়ে গেছে জানা-অজানা বহু রাজকন্যার। অতৃপ্ত জীবন তাদের এগিয়ে দিয়েছে ভয়ঙ্কর সব পরিণতি দিকে। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাদেরই কিছু কথা….
প্রাচীণ ইজিপ্সিয়ান সমাজে বংশের ধারা খাঁটি রাখবার জন্য নিয়ম ছিলো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিয়ে করার। ফারাওরা বিশ্বাস করত তারা দেবতার বংশোদ্ভূত আর এই বংশকে পবিত্র রাখতে পরিবারের বাইরে তাদের বিয়ে করা উচিত নয়। তাই রাজপরিবারে ভাই-বোন, রাজা তার কন্যাদেরও বিয়ে করতেন।
মিশরীয় ফারাও আখেনাতেন সন্তান চেয়েছিলেন তার তিন কন্যার থেকে। অপরিণত বয়সে প্রসবকালে মারা যায় তার দ্বিতীয় কন্যা। ছোট মেয়ে আনখেসেনামুন হলেন ফারাওযের দ্বিতীয় স্ত্রী।আনখেসেনামুন (ইংরেজি : Ankhesenamun; ˁnḫ-s-n-imn, “তার জীবন আমুনের”) মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের একজন রানী হিসেবে পরিচত ছিলেন।তার পিতার মৃত্যুর পরে তার নাম পরিবর্তনের সাথে তার ধর্ম পরিবর্তন করতে হয়। এক কিশোরীর দুঃখ, বেদনা, উদ্বেগ ইত্যাদি তার মাতা-পিতার প্রাচীন রাজত্বের চিত্রে,নথিপত্রে ভালো ভাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
আসলে আনখেসেনামুন নামের এই তরুণী রানির জীবনটা ছিল বেশ বিষাদময়। নিজের পিতা, পিতামহ এবং সৎভাই তুতানখামুনের সাথে বিয়ে হয় তার।
আখেনাতেনের মৃত্যুর পর তার এক ক্ষমতাবান উপদেষ্টা বিয়ে করল আনখেসেনামুনকে। চার বছরের মধ্যে তারও মৃত্যু হলে আট বছরের সৎ ভাই তুতানখামেনের সঙ্গে বিয়ে হল ১৩ বছরের আনখেসেনামুনের।
তুতানখামুন এবং আনখেসেনামুন দুই কিশোর কিশোরী দশ বছর মিশরে রাজত্ব করেন এবং তাদের দুইটি কন্যা সন্তান হয়।তুতানখামুনের সমাধিতে পাওয়া দুইটি শিশুর মমি তার প্রমাণ। কিন্তু এই সামান্য সুখও সহ্য হলো না আনখেসেনামুনের কপালে। সেই সময় তাদের উপদেষ্টা ছিলেন আই, যিনি আনখেসেনামুনের পিতামহ ছিলেন। তাঁরই ষড়যন্ত্র খুন হলো ১৮ বছরের ফারাও তুতানখামুন। শুধু তাই নয়, আনখেসেনামুনকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে ওঠে আই।
অসহায় আনখেসেনামুন উপায় না দেখে গোপনে ইজিপ্টের শত্রু থিট্টির রাজার কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, রাজার বহু পুত্র সন্তানের মধ্যে একজনের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে রাজা যেন আনখেসেনামুনকে নিরাপত্তা দেন। লোকলস্কর দিয়ে নিজের ছোট ছেলেকে ইজিপ্টে পাঠালেন রাজা। কিন্তু আয়ের কাছে খবর চলে যাওয়ায় হত্যা করা হলো তাদের।চল্লিশ বছরের বড় আয়কে বিয়ে করতে বাধ্য হল আনখেসেনামুন। এর কিছুদিন পর তার মৃত্যুর কারণ আজও রহস্য।
এলিজাবেথ কে বলা হয় ভার্জিন কুইন। কিন্তু ইতিহাস বলে আদতে প্রকৃত কুমারী তিনি ছিলেন না। তবে বিয়ে কেন করেননি, সে নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তাঁর জন্মের দেড় বছর পর হত্যা করা হয় তার মা অ্যানিকে। এমনকি পিতা হেনরির সঙ্গে বিয়েও নাকচ করা হয়। এলিজাবেথকে অবৈধ সন্তান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলত সৎ ভাই ষষ্ঠ এডওয়ার্ড হয়ে যান রাজা। তার মৃত্যুর পর রানী হয়ে যান তুতো বোন মেরি। তখন বন্দি করে রাখা হয় এলিজাবেথকে।
কিন্তু এলিজাবেথ হারবার পাত্রী ছিলেন না। এলিজাবেথ একজন রাজপুত্রের মতো শিক্ষা লাভ করেছিলেন। পাঁচটি ভাষা জানতেন এবং একজন প্রতিভাবান সঙ্গীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী এবং ঘোড়সওয়ার ছিলেন।এলিজাবেথের ক্যাথলিক বোন মেরির রাজত্বকালে যেসব বিপদ তাঁকে ঘিরে ছিল, সেই অভিজ্ঞতা অল্প বয়সেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলে তাঁকে। ১৯৫৮ সালে মেরিকে সরিয়ে রানী হন এলিজাবেথ।
রাজপরিবারের আশা ছিল রানী রাজবংশ রক্ষা করবেন কারণ এলিজাবেথের ছেলেই হবে পরবর্তী রাজা। কিন্তু রানী অবিবাহিত রইলেন। ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন এলিজাবে জানতেন তিনি বন্ধ্যা। বহু রাজার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধুর রবার্ট ডাডলি ছিলো তাঁর আসল প্রেমিক। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ডাডলির স্ত্রী যখন মারা যায় কারণ করোনারের রিপোর্ট বলে এটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু সমালোচকরা বলে এলিজাবেথকে বিয়ে করার জন্য রবার্ট এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন।
একসময় এলিজাবেথও রবার্টকে বিয়ে করার কথা ভেবেছিলেন কিন্তু তার উপদেষ্টাগণ আপত্তি জানালেন যে এ বিয়ে হলে রাজ পরিবারের সম্মান আর জনসমর্থন তিনি হারাবেন।
৫০ বছর বয়সে এলিজাবেথের শেষ প্রেমিক ছিলেন তার থেকে ২২ বছরের ছোট আনজুর ডিউক ফ্রান্সিস।শেষ বয়সে অসুস্থ এলিজাবেথের উত্তরাধিকারের প্রশ্ন পার্লামেন্টএ ওঠে। রানী এতদিন বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে আসছিলেন, এমনকি একসময় তিনি উত্তরাধিকারের নাম ঘোষণা করবেন বলেছে কিন্তু করেননি, তার মৃত্যুর পর একান্ত নিজস্ব কিছু জিনিসপত্র থেকে পাওয়া যায় রবার্টের একটি চিঠি। যার উপর রানির নিজের হাতে লেখা ছিল “হিস্ লাস্ট লেটার”।
তার রাজত্বকালে, ইংল্যান্ড স্প্যানিশ আরমাডাকে পরাজিত করে। যেহেতু স্প্যানিশ নৌবাহিনীকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর চেয়ে উন্নত বলে মনে করা হত, এই বিজয় ইউরোপে ইংল্যান্ডের মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
২৮ বছর বয়সী একটি ডসিয়ার “দ্য নেমস অফ দ্য ইন্টেলিজেন্সার্স”-এ, ইতিহাসবিদ স্টিফেন আলফোর্ড গুপ্তচরবৃত্তির প্রধান রবার্ট সিসিলের নেতৃত্বে রাণীর গুপ্তচরবৃত্তির নেটওয়ার্ক আবিষ্কার করেছেন। এই নথিটি ১৫৯৬ সালের এবং জাতীয় সংরক্ষণাগারে পাওয়া গেছে। আলফোর্ড পরামর্শ দেন যে এটি “প্রথম ইংরেজ গোপন অনুসন্ধান” হতে পারে। এলিজাবেথ অত্যন্ত পারদর্শিতা সাথে বিশাল এক গুপ্তচর বাহিনী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন।
আসলে ‘নারীরা অনেক কাজই পারে না’ এমন মনে করাটাই ভুল। জীবনে চলার পথ মোটেই মসৃণ নয় প্রচুর বাধার সম্মুখীন হতে হয় পদে পদে। তার মধ্যে দিয়েই লড়াই চালিয়ে যাওয়া নামই তো জীবন। অসংখ্য নারীর নাম রয়েছে এ লড়াইয়ের তালিকায়।
১৯০৮ সালে মহিলাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রায় ১৫ হাজার লোককে রাজপথে নামান নিউইয়র্কের নারীরা। কাজের সময়ে কমিয়ে আনা,পারিশ্রমিক বৃদ্ধি ও ভোটাধিকার আদায়ের মতো বেশ কিছু দাবি নিয়ে শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন।এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করেন মার্কিন নেত্রী ক্লারা জেটকিন।তিনি ছিলেন একজন কমিউনিস্ট ও নারী অধিকার কর্মী।
এরপর নারীদের নানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯১৩ সাল থেকে প্রত্যেক বছর ৮ ই মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালন শুরু করে বেশ কয়েকটি দেশ।রাষ্ট্রসঙ্ঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে ১৯৭৫ সালে। তখন দেখেই প্রতিবছর একটি বিশেষ থিম বা ভাবনা নিয়ে পালিত হয় এই দিনটি।নারীর জীবনকে প্রভাবিত করে এমন আইন এবং সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে সংলাপ প্রচারের মাধ্যমে, আন্তর্জাতিক নারী দিবস জীবনের সকল স্তরের নারীদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ঐক্য নিশ্চিত করে।
প্রত্যেক বছর ৮ ই মার্চ ভিন্ন ভিন্ন থিম নিয়ে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবছরে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হবে “সকল নারী ও মেয়েদের জন্য: অধিকার। সমতা। ক্ষমতায়ন।” জাতিসংঘের মতে, পরবর্তী প্রজন্মের তরুণী এবং কিশোরী মেয়েদের — দীর্ঘমেয়াদে পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষিত করা এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য অপরিহার্য।
পেজ ফোরের তরফ থেকে সকল নারীদের জানাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা।।
খুব শক্ত লেখা। সাহসী।