“দাঁত ফোকলা দাঁতে কাঠি/টিকটিকিতে মারবে লাথি” ছোটবেলায় এমন গা জ্বালানো ছড়া কেটে ফোকলা বন্ধুকে ভ্যাংচায়নি ওমন ভালো মানুষ পাওয়া দুষ্কর। ছোটবেলায় দাঁতের পূর্বসূরি মানে দুধে দাঁত পড়ে গিয়ে নতুন দাঁত তো গজায় কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে দাঁত পড়ে গেলে ফোকলা অবস্থাতেই থাকতে হয়। ফোকলা দাঁতে জীবন চালানো শুধু কঠিন নয়, হাস্যকরও বটে। তাই দাঁত নিয়ে এহেন ভাবনা বা দুর্ভাবনার কথা সেই বহুকাল আগে থেকেই।
খ্রিস্টের জন্মে প্রায় ৭০০ বছর আগে ইতালির মানুষরা পড়ে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া দাঁতগুলোর জায়গায় বিভিন্ন পশুদের দাঁত সোনার তার দিয়ে বেঁধে রাখত। জাপানের লোকজনেরা নকল দাঁতের প্রয়োজনে বহু আগে থেকেই এক বিশেষ ধরনের গাছের কাঠকে কাজে লাগাত দাঁত তৈরির জন্য।
ফরাসি দেশে সে সময় নাপিতদের একটি সংঘ ছিল, যাঁরা দাঁত তোলার কাজ করত। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়, একদল এই কাজ ভালোভাবে শিখে নিয়ে ছিল এবং তা নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করত, নতুন নতুন উপায় বের করত।আর আরেকটি দল চিরাচরীত রীতিতে দাঁত তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো।
১৫ শতকে নিয়ম করে পুরনো বা হাতুড়ে উপায়ে দাঁতের চিকিৎসার কাজকর্মকে বন্ধ করে দেয়া হয়। এরই মধ্যে ১৫৩০ সালে জার্মানি ভাষায় একটি বই লেখা হয়েছিল এটাই সম্ভবত দাঁতের চিকিৎসার প্রথম বই। বইটির নাম ‘আর্তজনে বুকলিন’। বাংলায় হল ‘দাঁতের সব রকমের রোগ ও দুর্বলতার চিকিৎসার ছোট্ট বই’। যারা সেই সময়ে প্রকৃত শল্যচিকিৎসক, তাদের জন্য বইটা যেমন কাজে লাগতো একইভাবে যে সমস্ত নাপিত যারা এই কাজ করতেন, তাদেরও দরকার হতো।
১৮ শতকে ফরাসি দেশের নামকরা দাঁতের চিকিৎসক ছিলেন পিয়েরে ফুকার্দ (Pierre Fauchard)। “আধুনিক দন্তচিকিৎসার জনক” বলেই তাকে ভাবা হয়। ১৭২৮ সালে তিনি দন্তচিকিৎসার প্রথম সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পুস্তক লে চিরুরগিন ডেন্টিস্ট (“দ্য সার্জন ডেন্টিস্ট”) লেখার জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন [Le Chirurgien Dentiste (“The Surgeon Dentist”)]। বইটিতে মৌখিক রোগবিদ্যার মৌলিক শারীরস্থান এবং কার্যকারিতা, লক্ষণ ও উপসর্গগুলি বর্ণনা করা হয়েছে। রয়েছে ক্ষয় অপসারণ এবং দাঁত পুনরুদ্ধারের জন্য অপারেটিভ পদ্ধতি, পেরিওডন্টাল রোগ (পাইওরিয়া ), অর্থোডন্টিক্স, হারিয়ে যাওয়া দাঁত প্রতিস্থাপন এবং দাঁত প্রতিস্থাপন ।
এই বইয়ে নকল দাঁত নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছিলেন ঠিকই, তাতে ষাঁড়ের হাড়,জলহস্তী, সাগরঘোড়া বা সিন্ধুঘোটকের দাঁতকে মানুষের নকল দাঁত তৈরির জন্য কাজে লাগাতে হবে সেই পরামর্শ দিয়েছেন। নকল দাঁত তৈরি করতে কখনো বা মাড়ির মাপ নেওয়া হতো কালিপার্স কিংবা কম্পাস কাঁটার সাহায্যে।আবার কেউ মোমের উপর মাড়ির ছাঁচ নিয়ে সেই মতো দাঁতগুলোকে সোনার তার, ফিতে দিয়ে বেঁধে কোনভাবে মাড়িতে আটকে দিত। এরকম নানা উপায়ে নকল দাঁত তৈরিও বানানোর কাজ চলেছিলো বহুদিন।
পৃথিবীর ইতিহাস পড়লে জানা যায় এমন নানান অবাক করা ঘটনার কথা। ১৮১৫ সালে ১৮ই জুন বেলজিয়ামে নামকরা শহর ওয়াটারলু-র কাছে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হলো — ‘ওয়াটারলু’-র যুদ্ধ।এই যুদ্ধে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মতো ফরাসি সম্রাট হেরে গিয়েছিলেন। যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় হাজার পঞ্চাশের সেনার। ওয়াটারলুতে মিছিলকারী সৈন্যরা তরুণ এবং স্বাস্থ্যকর ছিল। তাই তাদের দাঁত, দাঁত তৈরির জন্য ছিলো আদর্শ। পিপে ভর্তি করে মরে যাওয়া সেনাদের দাঁতগুলি ইংল্যান্ডে নিয়ে আসা হয়।
কিন্তু মরা মানুষের দাঁত দিয়ে এতো আগ্রহ কেন?
উনিশ শতক থেকে ইংল্যান্ডে দাঁত তুলে নিয়ে তারপর সেই ফাঁকা জায়গা ভরার জন্য অন্য মানুষের দাঁত জুড়ে দেওয়া হতো। আর সেই কাজেই লাগানো হয়েছিল পিপে বোঝাই করে নিয়ে আসা মৃত সেনাদের দাঁতগুলো। শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, নানা দেশে নানান রীতি ছিল মাড়ির ফাঁকে দাঁতের জায়গা ভরাট করার। ক্রমে “ওয়াটারলু দাঁত” ব্রিটেনে ফ্যাশন হয়ে উঠলো এবং তাদের সরাসরি উত্স জানার অসম্ভবতা সত্ত্বেও প্রায়শই ট্রফি হিসাবে পরা হত।দাঁতের জন্য মানুষের দাঁত ব্যবহার করার এই অভ্যাসটি ১৮৬০-এর শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ “ওয়াটারলু দাঁত”-এর ব্যবহার ক্রমে বিখ্যাত হয়ে উঠলো।আঠারো শতকের শুরুর সময়ও আমেরিকায় জলহস্তি কিংবা হাতির দাঁত থেকে মানুষের নকল দাঁত বাঁধানো হত।
১৮ শতকের জার্মানির দন্ত চিকিৎসক ছিলেন
(Phillip Pfaff, February 28, 1713-March 4, 1766)। ১৭৫৬ সালে তিনি নকল দাঁত তৈরি নিয়ে এক নতুন ধারণা দিয়েছিলেন। তার মতে আগে মুখের ভেতর মাড়ির ছাপ নেওয়ার দরকার। সেজন্য ব্যবহার করেছিলেন গরম জলে নরম করে দেওয়া ‘প্লাস্টার অফ প্যারিস’, তাতে অনেকটা ঠিকঠাক দাঁতের পাটির মাপ পাওয়া গেল। সেই মত সোনার পাতের উপর নকল দাঁতগুলি বসিয়ে মাড়ির সঙ্গে আটকানো হতো বলা যেতে পারে। এই প্রথম নকল দাঁত তৈরি ও ব্যবহারের সাজানো-গোছানো উপায় জানা গেল।
১৭৫৬ সালে, Pfaff প্রকাশ করেন Abhandlung von den Zähnen des menschlichen Körper, “Treatise on the Teeth of the Human Body and their Diseases” অনুবাদে। এটি ছিল জার্মানিতে দন্তচিকিৎসা সংক্রান্ত প্রথম পাঠ্যপুস্তক। তার বইতে দাঁতের শারীরস্থান, শারীরবিদ্যা, প্যাথলজি এবং চিকিৎসার বর্ণনা রয়েছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন কিভাবে মাড়ির ফোড়া এবং ফিস্টুলাস আক্রান্ত দাঁতের জন্য নিষ্কাশনই একমাত্র বিকল্প। Pfaff দাঁতের এবং খিলান ছাপ নিতে প্রথম. বইটি বর্ণনা করে যে কীভাবে মোমের ছাপের সাথে কাজ করতে হয় এবং প্লাস্টার অফ প্যারিসের সাথে কাস্ট মডেলগুলি পেতে হয়।
তিনি এটি দুটি ধাপে নিতেন, প্রথমে বাম দিকের, তারপর ডান অর্ধেক এবং পরে দুটিকে একত্রিত করতেন। Pfaff কৃত্রিম দাঁত তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন উপকরণগুলিকে ব্যবহার করতেন যেমন রূপা এবং তামা। তার সময়ে, হাতির দাঁত, হাড় এবং সামুদ্রিক গরুর (sea cow) দাঁত ছিল ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী উপকরণ। দন্তচিকিৎসায় এই অবদানের পাশাপাশি, তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ফিলিং স্থাপনের আগে সোনার ফয়েল দিয়ে দাঁতের সজ্জার ক্যাপিং করেছিলেন। Pfaff তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন যখন তিনি অন্যদেরকে শক্ত টুথব্রাশ ব্যবহার না করার জন্য সতর্ক করেছিলেন যদিও তিনি প্রতি দুই সপ্তাহে একবার টুথব্রাশ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
সেই আমলে,কেবল অভিজাত ধনীরাই কৃত্রিম দাঁত ব্যবহার করতেন। এ ব্যাপারে বিখ্যাত ছিলেন রানী এলিজাবেথ। শোনা যায় পাবলিক ইভেন্টে যোগ দেওয়ার সময় তার দাঁতের ফাঁকে কাপড়ের টুকরো ভরে দেওয়া হত।
নকল দাঁত তৈরি করতে তখন বৃত্ত অঙ্কনের যন্ত্র দিয়ে মুখের মাপ নেওয়া হতো। সিল্কের সুতা দিয়ে আটকে রাখা হতো আংশিক নকল দাঁত। দামি ধাতু, যেমন সোনা বা হীরার দাঁত ব্যবহার করা ছিল আভিজাত্যের লক্ষণ।
সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে অনেক কিছুই। সৌভাগ্যবশত ২০ শতকে দাঁতের জন্য নতুন প্রযুক্তি এবং উপকরণ পাওয়া গেছে। তাই ফোকলা দাঁতের হাঙ্গামাও কমে গেছে। তবে পরিশেষে ছোট্ট করে একটাই উপদেশ, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিন। কোন সমস্যা হলে অতি অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। দাঁতে দাঁত লাগানো শীতে ভালো থাকুন সবাই।।
খুবই সুন্দর হয়েছে