দৈনন্দিন রান্নায় বাংলাদেশি-ভারতীয় খাবারে যে সকল মসলা স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে তার মধ্যে হিং অন্যতম। হিং ছাড়া সিঙ্গাড়া, ডালপুরি, আলুপুরি ইত্যাদি স্বাদে যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এছাড়াও দক্ষিণভারতীয় নৈমিত্তিক খাবার সাম্বার, রাসাম, ডাল, মেরুবড়া, ঝোলের তরকারি ইত্যাদিতে হিং ব্যবহার করা হয়। হিং ভারতীয় খাবারে একটি বহুল সমাদৃত মসলা এবং ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে বিভিন্ন রান্নায় হিংয়ের ব্যবহার হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ-ভারতে হিং নামে সুপরিচিত। যদিও অঞ্চল ভেদে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। হিং একটি প্রাচীন মসলা খাবার। বৈজ্ঞানিক নাম ফেরুলা অ্যাসাফিটিডা (Ferula assa-foetida L)। Umbelliferae পরিবারের অন্তর্গত। হিং এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো এবং এখনও হয়। এই প্রজাতিগুলো ইরানের মরুভূমিতে এবং আফগানিস্তানের পাহাড়ে জন্মায়। হিংয়ের আদিনিবাস ইরান ও আফগানিস্তানের পাথুরে অঞ্চলে হলেও ভারতে এর ব্যাপক চাষ হয়।
আসাফিটিডা এক সময় প্রথম দিকের মেডিটেরানিয়ান অঞ্চলে খুব জনপ্রিয় ছিল। যদিও এটি এখন ইউরোপ থেকে প্রায় চলেই গেছে এবং এখন ব্যাপক ভাবে ব্যবহার হচ্ছে ভারতে। ইরান এবং আফগানিস্তানে এদের সাধারণ নাম বাদিয়ান (badian) যার অর্থ হলো গ্যাস বা বাতাস। হিংয়ের একটি বিশেষ ব্যবহার হলো স্টমাকের বাতাস বা গ্যাস দূর করা। অ্যাসাফিটিডা এর একটি উগ্র গন্ধ আছে। এদের ট্রাইবাল নাম stinking gum অর্থাৎ দুর্গন্ধযুক্ত গাম। কিন্তু হিং দিয়ে রান্না করা ডিশের গন্ধ অনেকটা পেঁয়াজের গন্ধের মত। রান্না করার পর এদের গন্ধ বদলে যেয়ে সুঘ্রাণে পরিবর্তিত হয়। অ্যাসাফিটিডাকে অনেক সময় “food of the devils” বা “devil’s dung” বলে উল্লেখ করা হয়। হিং দিয়ে এক সময় মাছ ধরার চার তৈরি হতো। হিংয়ের গন্ধে ভিড় করত সিং-মাগুর ছাড়াও নানা জাতের মাছ।
ফেরুলা অ্যাসাফিটিডা উদ্ভিদের মূল থেকে হিং সংগ্রহ করা হয়। হিং আসলে শুকানো কষ যা রাইজোম বা ট্যাপ রুট থেকে সংগ্রহ করা হয়। গাছের বয়স বছর পাঁচেক হলে এর গোড়া থেকে কেটে মাটির হাঁড়ি রাখা হয় কষ সংগ্রহ করার জন্য। কষ জমে ভরে গেলে আবার নতুন হাঁড়ি লাগানো হয়। প্রথম দিকে এই কষের রঙ সাদা থাকে। পরে ধীরে ধীরে কষ হলুদ রং ধারণ করতে থাকে। প্রায় ৩ মাস ধরে এই কষ বেরুতে থাকে। একটি গাছ থেকে প্রায় ১ কিলোগ্রাম রেজিন পাওয়া যায়। ভারত ও নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশে হিং চিকিৎসার উপকরণ হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। মসলা হিসেবেই হিং নামটা আমাদের কাছে বেশি পরিচিত।
ফেরুলার বেশ কয়েকটি প্রজাতি থেকে হিং সংগৃহীত হয়। এটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ, এক থেকে দেড় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।
বেশ কিছু সংখক আরবীয় এবং ইসলামিক বিজ্ঞানী এবং ফার্মাসিস্ট আসাফিটিডা সম্পর্কে বর্ণনা দেন। বিখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনা হজম প্রক্রিয়ায় আসাফিটিডা এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। ইবনে আল বাইতার এবং ফখর আল-দিন আল-রাজি শ্বাসতন্ত্রের উপর হিং এর কিছু পজিটিভ কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেন।
১৬ শতক পর্যন্ত আসাফিটিডা ইউরোপে দুষ্প্রাপ্য ছিল। যা পাওয়া যেত তা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু ইন্ডিয়াতে তখন ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতো মশলা হিসেবে এবং ওষুধ হিসেবে। কোনো এক সময়ে ইটালিতে আসাফিটিডাকে ব্যবহার করা হতো ভূত তাড়ানোর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক কাজে।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় হিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ। পাকস্থলীতে অবস্থিত গ্যাসের পরিমাণ কমায় এবং হজমকারি এনজাইমের কার্যকারিতা বাড়ায়। বদহজম এবং পেটের বিভিন্ন অসুখ সারাতে বহু যুগ ধরে হিংয়ের ব্যবহার হয়ে আসছে। হিং খুবই ভালো এন্টি-অক্সিড্যান্ট। স্মৃতি শক্তিকে উন্নত করে। স্থূলতা কমানোতেও এর ভূমিকা আছে। হিং অম্লনাশক হিসেবে কাজ করে। ভেষজ ওষুধ হিসেবে হিং ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরণের ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাক এর চিকিৎসায়। জীবাণু বিরোধী হিসেবে হিং এর উপকারিতা অনেক তথ্যে পাওয়া যায়।
হিংয়ে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ফাইবার, প্রোটিন, ফসফরাস ও নিয়াসিন। হিং দিয়ে তৈরি করা ওষুধ যকৃত সংরক্ষণে কাজ করে। জানা যায় যে হিঙের মিশ্রন স্ট্রোক এবং করোনারি হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। ডায়াবিটিস এর রোগীদের জন্য হিং খুব উপকারী। শুকনো কাশি, হুপিং কফ, ব্রঙ্কাইটিস বা বুকে বসে যাওয়া সর্দি কমাতে সাহায্য করে। খাবার সংরক্ষণের জন্য হিং এর ভূমিকা রয়েছে।
Disclaimer: The purpose of this article is for education and discussion, not prescription to the patients. They need to meet qualified doctors for their safety.
কভারের ছবি : হিং গাছের পাতা ও ফুল (সূত্রঃ flickr.com)