এই বিরাণ জনপদে একাকী দাঁড়িয়ে জামেরী অচেতন মিতুলের জন্যে সংগ্রাম করে। তার উপন্যাস রচনা শেষ করে। ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে চিঠিপত্র কলামে মিতুলের কৃতিম শ্বাস প্রত্যাহার নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়। জামেরী কলম মরে মিতুলের পক্ষে। মিতুলের পিতাকে ইবলিশের মতো তার মনে হয়। শীতের কুয়াশার মতো চারিদিকের সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্মায়। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের জীবনী পড়ে অনমনীয় মনোবৃত্তির সাক্ষাৎ পায় জামেরী। মিতুলের শ্বাস প্রত্যাহারের বিপক্ষে যেমন সে অনড় মন্তব্য প্রকাশ করে। তেমনি তার প্রকাশিত উপন্যাসের বক্তব্যের স্বপক্ষে সে অনড় অবস্থান নেয়। তার প্রকাশিত উপন্যাসের বক্তব্য নিয়ে মৌলবাদী গোষ্ঠী উত্তেজিত হলে সে নির্বিকার থাকে। এজন্য প্রকাশকের সাবধানে থাকার উপদেশে সে হেসে বলে —
সাবধান থাকার আগ্রহ আমার নেই। যা আমি লিখেছি তার মোকাবিলা আমি নিজই করবো। তাকে ছেড়ে পালাবো না। পালিয়ে যাওয়ার অর্থ নিজেকে প্রতারিত করা। আমার বক্তব্যের প্রতিষ্ঠা যদি না হয়, তাহলে আমি লিখলাম কেন? কার ভরসা করে শব্দগুলো আমার প্রেমে পড়েছিলো? তাদের একলা ফেলে এখন আমার পালিয়ে যাওয়ারয কোন মানেই হয় না’’ (পৃ. ২০৩)।
জামেরীর কাম্য, সমাজের ষড়যন্ত্রে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ব্যক্তি, যে পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলে বেড় ওযে তাকে অবলম্বন করে উপন্যাস রচিত হয়। এ জন্যে কল্পনার রঙ মিশিয়ে ব্যক্তিকে ঔপন্যাসিক করে তোলেন জীবন্ত। একারণে জামেরী তার উপন্যাসে খুনী রায়হানকে হত্যা করলেও বাস্তবে ছন্দা জামেরীর চেয়েও বেশি জীবনবাদী।
কিন্তু সাইকি হয়ত রায়হানের সঙ্গে আবার ভালবাসার সূত্রে মিলিত হতে পারে। আর জামেরী? জামেরী নিস্তব্ধতার শূন্যে স্বপ্ন দেখে জীবন কাটাবে? নাকি সৃষ্টির নতুন সংবেদনায় আবার সজীব হয়ে উঠবে? —
“হাতের তালুতে চোখের জল মুছলাম। মনটা এমন। কিছুতেই বিষণ্ণতা ঠেকিয়ে রাখা যায় না। বাঁধ ভেঙে গলগলিয়ে ঢোকে। তছনছ করে যত্নের শস্যভূমি। আবার জল মুছলাম। হাতটা কেঁপে গেলো। থাক, মুছবো না। মনে হলো জলটাই উৎস। জলটাই সব। চারদিকে শান্ত গভীর সমুদ্র? আমি প্রোটপ্লাজমের বিন্দু হয়ে অসছি। চোখের জল এখন ছলছল কলকল। আদিম চরাচরে বুঁদ হয়ে গন্ধ নেয়ার দিন শুরু। কেবল আমার বুকে সৃষ্টির বেদনার চৈ চৈ’’ (পৃ. ২০৮)।
এই কেন্দ্রীয় চরিত্রের আত্মকথনে “মগ্ন চৈতন্যে শিস’’ উপন্যাসের অবয়ব গঠিত। নায়ক জামেরী তার ব্যক্তিজীবন, মিতুলের জীবন ও রায়হানের জীবন সর্বজ্ঞ স্রষ্টা হয়ে উপন্যাসে সক্রিয়। অন্যান্য চরিত্রের জীবন-দর্শন ও আচার-আচরণ তার প্রেক্ষণে বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে চরিত্রের জীবনরেন সংকট ও সমস্যাকে অতিক্রমণের যন্ত্রণা এবং আর্তনাদকে শব্দরূপ দেয়ার জন্যে ঔপন্যাসিক প্রমানত বিশে¬ষণমূলক, গীতময় ও ভবিষ্যৎ নির্দেশকে মনোকথনের স্বপ্নময় পরিচর্যা রীতিতে উপস্থাপন করেছেন। অতীত বর্তমানকে মেলবন্ধনরূপে ও স্মৃতিচারণে বিজ্ঞান, প্রাচীন সাহিত্য মিথ প্রভৃতি অনুষঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন —
(ক) শিল্প হোল সেই ক্রীট দ্বীপের ক্রুর হৃদয়হীন নিষ্ঠুর বাদশাহ মিনোস। শিল্পীকে সে গোলকধাঁধার ভেতর মিনোট —ওরের সামনে ঠেলে দেয়। শিংওয়ালা ষাঁড়ের মাথা আর মানুষের শরীর নিয়ে সে জন্তু খাবার জন্যে হাঁ করে থাকে। সে এক বিচিত্র জগৎ। সে ধাঁধায় ঢুকলে পথ খুঁজে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। শক্তিমানরা পারে মিনোটওরকে হত্যা করতে। আরি-আদনির মতো অনির্বাণ প্রজ্ঞা রেশমী সূতো হয়ে পথ দেখায়। কিন্তু দুর্বলেরা মরে। ব্যর্থতার জ্বালা নিয়ে পথ হাতড়ায়। কোনদিন সে পথ খুঁজে পায় না তারপর মিনোটওরের খোরাক হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শিল্পের যে গোলকধাঁধায় আমি নেমেছি, তা আমি অতিক্রম করবই। অফুরাণ শক্তির খনি আমার গায়ের নিচে জমে আছে। মিনোটওরকে হত্যা করব। হৃদয়ের আলো আরি-আদনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেশমী সুতো ধরে। আমি বেরিয়ে আসবই’’ (পৃ. ১৭)।
মিতুলের সৎ ভাই মিন্টু জামেরীকে নিয়ে অন্তরালে ঠাট্টা করলে, জামেরী তা শুনে মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে পড়ে। ফলে তার বিক্ষিপ্ত মানসিকতা রূপায়রের জন্যে আগুন জ্বলে ওঠা এবং গ্যালিলির প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয় সত্যবাদীতার জন্যে নির্যাতনের কথা। এখানেও জামেরী তার উপন্যাসের জন্যে মিন্টুর কাছে যে উপেক্ষা পেয়েছে তাকেই প্রতীকায়িত করা হয়েছে।
(খ) “মুকুটের মতো নীল বাতি মিতুলের নীল বেনারসী হয়ে আমার বুকে আটকে রইল।’’ নীল বাতি যেমন মুকুটের মতো সৌন্দর্য বিস্তার করে তেমনি জামেরীর কেনা মিতুলের জন্যে নীল বেনারসী হৃদয় জুড়ে থাকল।
বস্তুত সাবলীল গদ্যভঙ্গ ও ছোট ছোট বাক্যে সেলিনা হোসেন “মগ্ন চৈতন্যে শিস’’ উপন্যাসে যে শিল্পীর জীবন রূপায়ণ করেছেন তা বিংশ শতাব্দীর ঢাকা নগরের সংকীর্ণ, অব্যবস্থাপূর্ণ ও অসঙ্গতিময় জীবনেরই চিত্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যেখানে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন, সীমাহীন শূন্যতায় নিমজ্জমান এবং ব্যক্তির হৃদয় খুঁড়ে যে শিল্প প্রকাশ পায় তাও সমাজের গ্লানিতে নিরর্থক হয়ে যায় অথচ এরই ভেতর শিল্পী পুনরায় নিজের ভেতর উৎসাহ বোধ করে। চেতনা পায়, আবার সৃষ্টির বেদনা নিয়ে জেগে ওঠে। ঔপন্যাসিকের আত্মদর্শনই যেন এভাবে প্রকাশ পায়, আমাদের আলোড়িত করে।
“খুন ও ভালোবাসা’’ (১৯৯০) নাগরিক চেতনায় লালিত জনৈক শাহরিয়ার প্রণয়িনী শামান্তাকে সন্দেহ বশত হত্যা করে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামী হয়ে পলাতক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা শেষে বিবেক দংশনে পীড়িত হয়ে আইনের কাছে আত্মসমর্পণের কাহিনী। নাগরিক জীবনে সমকালের নানাবিধ অসঙ্গতি কিভাবে ব্যক্তি মানুষকে অসহায় বিপর্যস্ত করে তুলেছে চৈতন্যের গূঢ় প্রবহমানতায় সেলিনা হোসেন আলোচ্য উপন্যাসে তা বিধৃত করেছেন।
বন্ধু কায়সারের সংবাদে শাহরিয়ার ইমতিয়াজের সাথে শামান্তার অবৈধ সম্পর্ক কল্পনা করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে শামান্তাকে, প্রতারণার প্রতিশোধ হিসেবে। নগরসভ্যতা সবকিছু গ্রাস করেছে। এখানে ভালোবাসা স্নেহ মমতা নিক্তির পরিমাপে নির্ণিয় হয়। ব্যক্তিজীবনের আকাঙ্ক্ষা আশ্লেষে পূর্ণ হয়ে ওঠে সমাজের নানাবিধ ব্যধির কারণে। এ জন্যে নাগরিক মানুষ ভালোবাসার কাঙ্গাল হয়ে নির্ভর করে প্রেমিকার ওপর। কিন্তু প্রেমিকা যখন প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে তখন আশ্রয়চ্যুত মানুষ ভয়ানক হয়ে ওঠে। মানুষের এই মনস্তত্ত্বের পশ্চাতে তার জৈবিক এবং একক কর্তৃত্ব অর্জনের মানসিকতা প্রধান ভূমিকা পালন করে। মূলত প্রেম এবং নরনারী সম্পর্কের নানাবিধ জটিল উপল ক্ষণভঙ্গুর চেতনার অবলম্বন–সেলিনা হোসেনের নাগরিক জীবনসম্পৃক্ত উপন্যাসের মৌল বৈশিষ্ট্য।
উপন্যাসটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা যেতে পারে। ঔপন্যাসিক প্রথমেই শাহরিয়ারকে উপন্যাসে অবতীর্ণ করে ১-৩২ পৃষ্ঠাব্যপী তার শামান্তা হত্যার কারণ, স্মৃতি তাড়না থেকে তার ভানুগাছের মনিপুরিদের মাঝে বন্ধু দীননাথের সহায়তায় আশ্রয় গ্রহণ ও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করেছেন। ৩৩-৮৬ পৃষ্ঠার মধ্যে শ্রীমঙ্গলের জুরিন চা বাগানে কাহারির সাহচর্যে খাসিয়া পরিমণ্ডলে জীবনের অন্য প্রান্তের অভিজ্ঞতা অর্জন বিধৃত। এখানে কাহারি সোনাই একটি উপকাহিনী সংশ্লিষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে ৮৭-১৫৭ পৃষ্ঠায় শ্রীমঙ্গল থেকে অজানার উদ্দেশে যাত্রা করে সাজেক ভ্যালির লুসাই সম্প্রদায়ের সঙ্গে শাহরিয়ার আত্মীয়তার সম্পর্কের পটভূমি সৃজিত। বৃহৎ পরিসরে শাহরিয়ারের লুসাই সমেয়ে রুহিনের সঙ্গে খ্রিষ্টান রবিনে পরিবর্তিত হয়ে বিবাহ বন্ধন এবং রুহিনের সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যু ও তাদের সম্প্রদায়ের জীবন-যাপন নিয়ে বড় ক্যানভাসে চিত্র অঙ্কনের কাহিনী প্রকাশ পেয়েছে। এখানেও মেরীর থিওপিল এবং সর্দারের উপকাহিনী সংযুক্ত হয়েছে। ১৫৮-১৭৪ পৃষ্ঠার মধ্যে ভবঘুরে খুনি শাহরিয়ারের গোমতী নদীর তীরে জেলে হারাধন বুড়োর আশ্রয়ের কাহিনী চিত্রিত হয়েছে। অবশেষে ১৭৪-১৮৪ পৃষ্ঠায় ৭ বছর পরে আত্মগ্লানিতে উন্মুলিত শাহরিয়ারের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন এবং পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের নাটকীয় ঘটনা পরিণতির সহজ মীমাংসায় পর্যবসিত।
বস্তুত এই ক্রম উল্লম্ফন জীবনাচারের ভেতর দিয়ে ঔপন্যাসিক শাহরিয়ারের আত্মগ্লানি থেকে প্রশান্তি এবং শেষে আবার অন্তর্লীন বেদনা যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে উত্তীর্ণ হবার প্রক্রিয়াটি অঙ্কন করেছেন। [ক্রমশ]