‘আমসত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস — হুপুস শব্দ,
চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে…’
ছোটবেলায় এই কবিতা শুনেই জিভে জল আসতো শুধু তাই নয়, কবির এই যে বর্ণনা এটি খাদ্য হিসেবে যেমন রুচিকর তেমনি একটি সম্পূর্ণ পুষ্টিকর আহার। দুধের প্রোটিন ও ফ্যাট, পাকা কলার কার্বোহাইড্রেট ভিটামিন ও ফ্রুকটোজ এবং সেই সঙ্গে আমসত্ত্বের নানান গুন। এই খাবারটির মধ্যে আজ বলবো পুষ্টিকর, তেমনই সুস্বাদু, ব্রেকফাস্টের সঙ্গীটিকে নিয়ে।
কলা এমনই একটি ফল যা সারা বছর পাওয়া যায়। দামেও অপেক্ষাকৃত সস্তা এবং একটি সম্পূর্ণ আহার। হজম হয় তাড়াতাড়ি, খেতেও ভালো– শিশু বৃদ্ধির সকলের কাছে এই ফলটি বিশেষ উপকারী।
সংস্কৃতে কলার নাম ‘কদলী’। ‘ক’ অর্থে বায়ু এবং ‘দল’ শব্দের অর্থ দলন। এভাবে কদলী শব্দের অর্থ হলো যা বায়ুকর্তৃক দলিত হয়। পাকা কলা হাতিদের খুব প্রিয় সেজন্য সংস্কৃতে পাকা কলার একটি নাম করীপ্রিয় আরেকটি বারণবল্লভ। করী ও বারণ অর্থে হাতি। কলার রম্ভা নামটি তো সকলেরই জানা আছে। কলা’কে ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়ে থাকে “মুসা সেপিয়েন্তাম” যার বাংলা অর্থ হলো “জ্ঞানী মানুষের ফল”।
কলার আদি নিবাস নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনেকেই মনে করেন এই ফলের উৎপত্তি এশিয়া মহাদেশ সম্ভবত ভারতে। কেরালা তামিলনাড়ু অন্ধপ্রদেশ পশ্চিমবঙ্গ অসমে প্রচুর কলা চাষ হয় ।পৃথিবীতে প্রচুর জাতির কলা জন্মায় তবে তার মধ্যে কাঁঠালি চাঁপা মর্তমান সিঙ্গাপুরি কলা ভারতে সহজে পাওয়া যায়।
একটি মাঝারি কলায় প্রায় ১১০ ক্যালোরি, ২৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৩ গ্রাম ফাইবার, ১ গ্রাম প্রোটিন, এবং ১৪ গ্রাম চিনি থাকে। এছাড়া কলায় রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-৬, এবং পটাসিয়াম যা শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও ক্যালসিয়াম ফসফরাস সালফার আয়রন কপার আয়োডিন ইত্যাদি ধাতব গুণগুলি কলায় পাওয়া যায়।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয়,সকালে কলা খেলে তার মূল্য তামার সমান, দুপুরে খেলে তার মূল্য রুপোর সমান আর বিকালে কলা খেলে তার মূল্য সোনা সমান। কলার মিষ্টতা সৃষ্টি হয়েছে তার গ্লুকোজের জন্য এই গ্লুকোজ প্রাকৃতিক, কাজেই মিষ্টতার সঙ্গে সঙ্গে এতে শরীরের পুষ্টি ও বৃদ্ধি হয়।আমাদের পাকস্থলী একটি কলা হজম করতে সময় নেয়। রাতে আমাদের শরীরের মেটাবলিজম সবচেয়ে কম থাকে। অতএব, একজন আদর্শভাবে সকালে বা সন্ধ্যায় কলা খাওয়া উচিত এবং রাতে খাওয়া এড়াতে হবে। তবে খালি পেটে কলা খাওয়ার একবারই উচিত নয়।
পাকা কলার গুনাবলী :
১) পটাসিয়াম : পাকা কলা তার উচ্চ পটাসিয়ামের জন্য বিখ্যাত , যা রক্তচাপ, পেশীর কার্যকারিতা এবং স্নায়ু সংকেত নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।নিয়মিত কলা খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে, ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। এতে থাকা পটাশিয়াম টেস্টোস্টেরন হরমোনের উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনিয়।
২) কলাতে আছে প্রচুর ভিটামিন এ, বি-১ ও সি যা শুক্রাণু উৎপাদনে সহায়তা করে। এসব ভিটামিনের কারণে যারা নিয়মিত কলা খায় তাদের শুক্রাণু বেড়ে যায়।
৩) ফাইবার: কলা পাকা হওয়ার সাথে সাথে তাদের আঁশের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে এবং পরিপাকতন্ত্রকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।
৪) ভিটামিন : পাকা কলায় ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-৬, এবং ভিটামিন-এ সহ বিভিন্ন ভিটামিন রয়েছে, যা ইমিউন ফাংশন, শক্তি বিপাক, এবং দৃষ্টি স্বাস্থ্যকে উন্নত করে।
৫) অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস : কলা পাকার সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে পারে, যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহ থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
৬) কলায় থাকা প্রাকৃতিক চিনি এবং কার্বোহাইড্রেট তাৎক্ষণিক শক্তি প্রদান করে। তাই অনেকে একে ‘প্রকৃতির এনার্জি বার’ বলেন। ব্যায়ামের আগে বা পরে কলা খেলে তাৎক্ষণিক এনার্জি পাওয়া যায়।
৭) ট্রিপটোফ্যান : কলায় থাকে ট্রিপটোফ্যান নামক একটি উপাদান মস্তিষ্কে সেরোটোনিন হরমোনের উৎপাদন বাড়ায়। সেরোটোনিন হরমোন মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে এবং বিষণ্ণতা দূর করে।
৮) ম্যাগনেশিয়াম : প্রতিটি কলায় গড়ে ২৭ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম থাকে, যা মন ভালো রাখতে এবং ভালো ঘুম পাওয়ার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কলায় ক্যালোরি কম এবং ফাইবার বেশি। ফলে এটি খেলে পেট ভরে যায় এবং ক্ষুধা কম লাগে। তাই যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য কলা একটি আদর্শ ফল।
৯) কলায় থাকা আয়রন রক্তাল্পতা দূর করতে সাহায্য করে।
১০) কলায় থাকা ভিটামিন বি-৬ এবং ম্যাগনেসিয়াম মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং স্মৃতিশক্তি বাড়ায়,মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে।
১১) কলায় থাকা পটাশিয়াম এবং ভিটামিন চুলের গোড়া মজবুত করে এবং চুলের বৃদ্ধি বাড়ায়।
১২) কলায় থাকা বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন শরীরে ফ্রি র্যাডিক্যাল দূর করে, যা ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারণ। বিশেষ করে কলায় থাকা ভিটামিন সি এবং ফ্ল্যাভোনয়েড ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
১৩) কলায় ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে, যা হাড়ের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক,অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমায়।
১৪) কলায় অবস্থিত একধরনের প্রতিরোধী স্টার্চ, যা পরিপাকের প্রক্রিয়াটিকে সুচল করে এবং বৃহদন্ত্রে গিয়ে স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া খাদ্যে পরিণত হতে পারে। যখন ডায়রিয়া হয়, শরীর থেকে অপক্ষয়িত খনিজ পদার্থ পূরণে কলার খাবার মাধ্যমে জরুরি পূরণ করা যেতে পারে।
১৫) অগ্নিদগ্ধ স্থানে কলার প্রলেপ লাগালে জ্বালা কমে। কলা চটকে পাতি লেবুর রস মিশিয়ে পাতলা করে লাগালে দাহ ও চুলকানিও সারে।
কলার এত উপকারীতা থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত করা ছেলে তা বিপত্তি বয়ে আনে। যাদের মাত্রারিক্ত মাইগ্রেনের সমস্যা রয়েছে তাদের কলা না খাওয়াই উত্তম।
কিডনি রোগে আক্রান্ত যারা তাদের কলা খাওয়া অনুচিত। অতিরিক্ত কলা খেলে দাঁতের ক্ষয় হয়, বদহজম, ক্লান্তি, গ্যাস সৃষ্টি, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, অ্যালার্জির সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
পাকা কলা দিয়ে কাস্টার্ড, মিল্কশেক, কেক, ফ্রিটার্স, রায়তা, স্মুদি সবই খেতে দারুন। ময়দা চিনি আটা মৌরি থিত করে চটকানো পাকা কলা মিশিয়ে সাদা তেলে ভাজা গরম গরম কলার বড়ার স্বাদই আলাদা। নানা রকম ফল মিশিয়ে মিক্স ফ্রুট জ্যামের সঙ্গে পাকা কলা মিশিয়ে ঘরে তৈরি করে রাখতে পারেন যা পাউরুটি বা রুটিতে মাখিয়ে খেতে অপূর্ব। তবে সবার উপরে পাকা কলা দিয়ে সত্যনারায়ণের সিন্নি, যার স্বাদ পার্থিব।
কলার খোসায় পলিস্যাকারাইড ফলিকুকার জেলজাতীয় নামক পদার্থ থাকায় “পা পিছলে আলুর দম” হওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে তাচ্ছিল্য করা বস্তুটিও অনেক উপকারী।
১) চটজলদি জুতো পরিষ্কার করতে চাইছেন অথচ হাতের কাছে কিছু নেই। চামড়া ও ফোমের তৈরি জুতো চকচকে করতে কলার খোসা ঘষে দিন।
২) টানা কয়েকদিন পায়ের ফাটা গোড়ালিতে কলার খোসার সাদা অংশ ঘষলে নরম ও চকচকে হয়ে শুষ্ক খসখসে ত্বক পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক ময়শ্চরাইজার হিসেবেও বেশ কার্যকর কলার খোসা।
৩) মশা বা অন্য পোকা মাখলে কামড়ে তখন ফুলে উঠলে পলিস্যাকারাইডে ভরপুর কলার খোসা ঘষে দিন, দারুন কাজ করে এই টোটকা।
বোঝাই যাচ্ছে, সামান্য পাঁচ টাকা দামের একটি কলা কতখানি উপকারী আমাদের জীবনে। অতএব সামান্য বলে একে তাচ্ছিল্য না করে সর্বঘটের কাঁঠালি কলাকে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত ডায়েটে রাখুন।
আমি প্রত্যেক দিন 1 টা করে খেতে চাই কিন্তু পাই না।
খুবই ভালো খাবার।
যদি কোনও ডায়াবেটিক রোগীর ডায়েটে ১০০-১৫০ গ্রাম ফল থাকে, তা হলে তার অর্ধেক অর্থাৎ ৫০-৭৫ গ্রাম কলা খাওয়া যাবে। খুবই স্বাস্থ্যকর ফল।
খুব সুন্দর লেখনী,,,,, কলার গুন অপরসিম। খুব সস্তায় এরকম ফল এই বাজারে পাওয়া খুব মুসকিল।
মতামতের জন্য ধন্যবাদ। সস্তায় পুষ্টিকর ফল হলো কলা।