রাজা দুষ্মন্ত বনের মধ্যে শিকার করতে এসে দেখা পান সুন্দরী শকুন্তলার।
গোয়ালিয়রের রাজা মানসিং ‘তোমর’- তাঁর ৮ জন রানি, তার পরেও জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে দেখতে পান আদিবাসী কন্যা নিন্নিকে— তাঁকে নিয়ে আসেন প্রাসাদে ও তাঁর নতুন নামকরণ হয় মৃগনয়নী।
সেকালে হয়তো বনের মধ্যে শুধু বাঘ-ভালুকেরা বাস করতো না, বাস করতো সুন্দর-সুন্দর মেয়েরা !!!
সুতরাং এতে আর আশ্চর্যের কী আছে – মালওয়ার সুলতান বাজবাহাদুর বনের মধ্যে দেখা পাবেন রূপমতির !
কোথায় ছিলো এই মালওয়া রাজ্য ?
আধুনিক ভারতের পশ্চিম ও মধ্য মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের একটি বড় অংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থান এবং উত্তর মহারাষ্ট্র রাজ্যের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিলো মালওয়া রাজ্য । বিন্ধ্য পর্বতমালার উত্তরে। প্রথমে রাজ্যের রাজধানী ছিল ‘ধার’। কিন্তু পরে মাণ্ডুতে স্থানান্তর করা হয়
আজও বলা হয়, ‘বেনারসের ভোর, আউধের সন্ধ্যা, মালওয়ার রাত।’ মালওয়ার রাত ছিলো এতটাই মোহময় !
শের শাহ ১৫৪৫ সালে এই মালওয়া রাজ্য জয় করে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রেখে গেলেন সুজাত খানকে। সুজাত খান মাত্র ১০ বছর পরেই দেহরক্ষা করলেন। তাঁর তিন পুত্র, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন মালিক বায়াজিদ।
মালিক বায়াজিদ এই মালব রাজ্যের সিংহাসন পেলেন ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু রাজকার্যে তত মন নেই। তাঁর সাধনার ক্ষেত্র হলো সঙ্গীত। প্রায়ই বীণা হাতে এদিকে-সেদিকে, গ্রামের প্রান্তে, পাহাড়ের নিচে, অরণ্যে, নির্জন পথে, তিনি ঘুরে বেড়ান ও সঙ্গীতের সাধনা করেন।
তখন তিনি আর মালিক বায়াজিদ নন, তিনি বাজবাহাদুর।
এমনই এক সময়, তাঁর সঙ্গে দেখা হলো রূপমতির। দুই সঙ্গীত-সাধকের মধ্যে হলো চেনাজানা, মন দেওয়া-নেওয়া।
লোককাহিনী তৈরি হয়েছে রূপমতি ও বাজবাহাদুরকে নিয়ে। কতো গ্রামীণ কবি ও গায়কেরা নানারকম অলৌকিক কাহিনী ফেঁদেছেন এই দুই রাজা-রানিকে নিয়ে।
বাজবাহাদুর নর্মদা নদীর ডান তীরে জঙ্গলে শিকার করতে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর কানে প্লাবিত হতে থাকল দূর থেকে ভেসে আসা সুরের ঝরনা। নারীকণ্ঠের সুমধুর গান। তিনি শব্দ অনুসরণ করতে থাকলেন এবং ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেন, যেখানে একটি বিশাল গাছের নীচে বসে একটি তরুণী কন্যা গান গাইছে, আর তার সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে বনের হরিণ ও পাখিদের ঝাঁক।
বাজবাহাদুর মেয়েটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং তার অতুলনীয় গানেও তিনি বিমোহিত । তিনি তার হৃদয় জয় করার চেষ্টা করলেন। সামান্য কথাবার্তার পরেই তিনি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন মাণ্ডুর রানি হওয়ার।
রূপমতির সপাট উত্তর, “যখন মাণ্ডুর মধ্য দিয়ে নর্মদা প্রবাহিত হবে, তখন আমি আপনার রানি হবো, তার আগে নয়।”
বাজবাহাদুর দৃঢ়সংকল্প করলেন যে নর্মদা নদীই তাঁর প্রেমের কণ্ঠস্বরকে মান্যতা দেবে এবং পাহাড়ের উঁচুতে আরোহণ করবে।
তিনি নিজে নর্মদা নদীর গতিপথ পালটে মাণ্ডুতে নিয়ে আসার জন্য দা-কোদাল হাতে কাজে নেমে পড়লেন।
তখনই এক বিশালাকার দেবতা হাজির হয়ে বলল, তোমার ভালোবাসার যোগ্য পুরস্কার নাও, তোমাকে নদীর কাছে যেতে হবে না। নদীই তোমার কাছে আসবে। … খুঁজে দেখো একটা ঝাউয়ের জঙ্গল, সেখানে খুঁড়লেই পাবে মন্ত্রপূত ঝরনা, সেই জল নর্মদা মায়েরই জল — সেই জলে কুণ্ড তৈরি করো।
তিনি ঝরনা খুঁজে পেলেন, সেখানে জলাধার খনন করলেন, পাশেই পাহাড়ের মাথায় একটি প্রাসাদ তৈরি করলেন এবং ঝরনার জলকে প্রাসাদের উপরে তোলার ব্যবস্থা করলেন।
বাজবাহাদুর রূপমতিকে এবার নিজের কাছে আসার প্রস্তাব দিলেন। রূপমতি ছিলেন নর্মদা দেবীর উপাসক। তাঁর বাড়ির কাছ দিয়েই বইত নর্মদা নদী। রূপমতি বাজবাহাদুরকে শর্ত দিয়েছিলেন, তিনি যেন তাঁর প্রাসাদ থেকে নর্মদা নদীকে রোজ দেখতে পান। আর, নর্মদার জল ছাড়া তিনি স্নান করবেন না। — সেই শর্ত পালন করেছেন বাজবাহাদুর। রানির প্রাসাদ একটি টঙের উপরে, সেখান থেকে চোখ মেলে তাকালেই দেখা যাবে নর্মদা নদীর প্রবাহকে।
রূপমতির বাবা এই প্রণয়ের কথা জানতে পেরে রূপমতিকে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার আদেশ দিলেন।
কিন্তু বাজবাহাদুর এবার সুলতানের বেশে সৈন্যদল নিয়ে রূপমতিকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন নিজের কাছে।
উঁচু একটা পাহাড়ের মাথায় তৈরি হলো রানি রূপমতির মহল। সেখানে উঠলেন রানি রূপমতি। সকালবেলায় ঘুম ভেঙেই দক্ষিণদিকে তাকিয়ে তিনি প্রণাম করেন নর্মদা নদীকে।
আর, নর্মদার জল থেকে তৈরি হলো একটি কুণ্ড। রেওয়া কুণ্ড। রেওয়া — আমাদের উচ্চারণে রেবা— নর্মদা নদীর অন্য একটা নাম। সেখান থেকে জল উত্তোলন করা হতো রানির প্রাসাদে।
রানি রূপমতি কবিতা লেখেন, গান লেখেন। দু’জনে বসে সেই গান গাইতে থাকেন। পাহাড়ের মাথা থেকে সুরের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে সারা মাণ্ডুতে।
সেই সময়ের এক ঐতিহাসিক তাঁর ‘তবাকৎ-ই-আকবরি’ বইয়ে লিখেছেন, “বাজ বাহাদুর ছিলেন সঙ্গীতে এবং হিন্দি গানে তাঁর সময়ের সবচেয়ে পারদর্শী মানুষ। তিনি তাঁর বেশিরভাগ সময় গায়ক ও সঙ্গীতশিল্পীদের সমাজে অতিবাহিত করতেন।”
শের শাহ তখন আর নেই, দিল্লির সিংহাসনে বসেছেন সম্রাট আকবর। আকবর তাঁর সাম্রাজ্য বাড়িয়ে চলেছেন। আকবরের সেনাপতি আদম খান কোকা — হানা দিলেন মালব রাজ্যে। বাজবাহাদুর ও রূপমতির গানের ভুবনে পড়লো অশুভ কালো ছায়া।
আদম খান কোকা নাকি শুনেছিলেন রানি রূপমতির সৌন্দর্যের কথা। তাই রাজ্যজয়ের পাশাপাশি তাঁর মনের ভিতরে কোনও গোপন লালসা উদ্রেক হয়ে থাকতে পারে।
সারংপুরের যুদ্ধে আদম খানের কাছে পরাজিত হলেন বাজবাহাদুর। মাণ্ডু-সহ পুরো মালব রাজ্যকে ছ’মাস অবরোধ করে রাখলেন হানাদার আদম খান । হার স্বীকার করতে বাধ্য হলেন বাজবাহাদুর। মাণ্ডুর দুর্গ আক্রমণ করলেন ভয়ঙ্কর আদম খান। দুর্বল বাজবাহাদুরের প্রতিরোধ খড়কুটোর মতো উড়ে গেল।
প্রিয় মানুষটির পরাজয়ে শোকগ্রস্থ রানি — সেই অবস্থায় তাঁকে তলব করলেন আদম খান।
অপমানে রূপমতি আত্মহত্যা করলেন। শত্রুহস্তে বন্দি হওয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় !
আর কী হলো ভাগ্যাহত বাজবাহাদুরের ?
মাণ্ডু ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। প্রথমে মহারাষ্ট্রের খান্দেশ — সেখান থেকে রাজস্থানের চিতোর — প্রাণভয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
অবশেষে আগ্রা ফোর্টে সম্রাট আকবরের কাছে হাজির হয়ে নতজানু হয়ে বশ্যতা স্বীকার করলেন। আকবর তাঁকে ২০০০ সৈন্যের মনসবদার পোস্টে চাকরি দিলেন।
***
১৫৯৯ সালে, আহমদ-উল-উমারি তুর্কোমান নামে এক লেখক ফারসি ভাষায় রানি রূপমতির গল্প লেখেন। তিনি রানি রূপমতির লেখা ২৬টি কবিতা সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেগুলিকে তাঁর রচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
তুর্কোমানের মৃত্যুর পরে মূল পাণ্ডুলিপিটি তাঁর নাতি ফুলাদ খানের কাছে ছিলো। তার এক বন্ধু মির জাফর আলি ১৬৫৩ সালে পাণ্ডুলিপিটির একটি অনুলিপি তৈরি করেন। মির জাফর আলির অনুলিপি শেষ পর্যন্ত দিল্লির জনৈক মেহবুব আলির কাছে পৌঁছায় এবং ১৮৩১ সালে তার মৃত্যুর পর দিল্লির এক মহিলার হস্তগত হয়।
ভোপালের জনৈক ইনায়েত আলি ওই মহিলার কাছ থেকে এই পাণ্ডুলিপি আগ্রায় নিয়ে আসেন। এই পাণ্ডুলিপিটি পরে সি.ই. লুয়ার্ড নামে এক ব্রিটিশের হাতে পৌঁছেছিল এবং এলএম ক্রাম্প এই পাণ্ডুলিপিটি ১৯২৬ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, “দ্য লেডি অফ দ্য লোটাস : রূপমতি, মাণ্ডুর রানি : বিশ্বস্ততার একটি অদ্ভুত গল্প” — এই শিরোনামে।
এই বইয়ে আছে রানি রূপমতির বারোটি দোহা, দশটি কবিতা এবং তিনটি সওয়াইয়া । সওয়াইয়া (सवैया) হলো একটি বিশেষ ছন্দের কবিতা।