শনিবার | ৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:৩৩
Logo
এই মুহূর্তে ::
নেহরুর অনুপস্থিতিতে প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদও ৩৭০ অনুমোদন করেছিলেন : তপন মল্লিক চৌধুরী সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার সাহিত্যিকদের সংস্কার বা বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে শ্রীপাণ্ডবা বা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত দশহরার ব্যুৎপত্তি ও মনসাপূজা : অসিত দাস মেনকার জামাই ও জামাইষষ্ঠী : শৌনক ঠাকুর বিদেশী সাহিত্যিকদের সংস্কার ও বাতিক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ভক্তের ভগবান যখন জামাই (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘সময়ের প্ল্যাকটফর্ম’ গুহাচিত্র থেকে গ্রাফিটি : রঞ্জন সেন জামিষষ্ঠী বা জাময়ষষ্ঠী থেকেই জামাইষষ্ঠী : অসিত দাস কার্বাইডে পাকানো আম দিয়ে জামাইষষ্ঠীতে জামাই খাতির নয়, হতে পারে ক্যান্সার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ভক্তের ভগবান যখন জামাই (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত কাশ্মীর নিয়ে বিজেপির নেহরুকে দোষারোপ ধোপে টেকেনা : তপন মল্লিক চৌধুরী রবীন্দ্র নাটকের দুই ট্র্যাজিক রাজা : শৌনক দত্ত কবির মৃত্যু : দিলীপ মজুমদার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের সপ্তসঙ্গিনী : স্বামী তেজসানন্দ মহারাজ দীঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক : সন্দীপন বিশ্বাস সিঁদুরে মেঘের গর্জন : অসিত দাস শতবর্ষে অন্য বিনোদিনী — তৃপ্তি মিত্র : শৌনক দত্ত আমার প্রথম অভিনয় দেখে সত্যেন বসুই বলেছিলেন— তোর হবে : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রজিৎ আমাকে ক্লান্ত করে কেবলই ক্লান্ত : তপন মল্লিক চৌধুরী মনোজ বসু-র ছোটগল্প ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রেস কটেজ বুলেটিন প্রকাশ : দীপাঞ্জন দে অথ ওয়াইন কথা : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসাবিভ্রাট : অসিত দাস বাংলা ইসলামি গান ও কাজী নজরুল ইসলাম : আবু বকর সিদ্দিকি পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি : মনোজিৎকুমার দাস কঠোর শাস্তি হতে চলেছে নেহা সিং রাঠোরের : দিলীপ মজুমদার রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন : শান্তা দেবী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (গুরু পূর্ণিমা) আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার

দিলীপ মজুমদার / ৮৭ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ৬ জুন, ২০২৫

শাঁখার মতো সিঁদুর হিন্দু সধবা নারীর প্রতীক। সেই সিঁদুরের কথা আজ মানুষের মুখে মুখে। ঘরে ঘরে যাবে সেই সিঁদুর। সরে সরে যাবে অ-হিন্দুত্বের রেশ। তখন সে হবে শৌর্যের প্রতীক। সেই সিঁদুরের সাতকাহন তুলে ধরার ইচ্ছে। না, কোন পক্ষপাত নেই। একেবারে তটস্থভঙ্গিতে বলতে চাই তার কাহিনি, তার ইতিকথা। চলে আসব সুদূর অতীত থেকে সাম্প্রতিক বর্তমানে।

সিঁদুরের ইতিকথা

নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতীয় হিন্দু সমাজে সিঁদুর শুভ প্রতীক। নারীকে সিঁদুর দানের পরে তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে পুরুষ। সিঁদুর তাই সধবা নারীর চিহ্ন। স্বামী মারা গেলে মুছে ফেলা হয় সিঁদুর। ভেঙে ফেলা হয় শাঁখা। কুমকুম সিঁদুরের আরেক নাম। সিঁদুর দান প্রথার মতো চালু আছে পসুপু কুমকুমা প্রথা।

কবে থেকে চালু হয় এই সিঁদুরদানের প্রথা? হিন্দুত্ববাদীরা বলেন এই প্রথার বয়স নাকি ৫ হাজার বৎসর। কিন্তু তার সপক্ষে প্রমাণ যথেষ্ট নয়। তবে বেলুচিস্থানের মেহেরগড় থেকে উৎখনন করা এমন কিছু নারীমূর্তি পাওয়া গেছে যেখানে নারীদের সিঁথিতে লাল রঙের প্রয়োগ দেখা যায়। তবে এই নিদর্শন যে সিঁদুরপ্রথাই সেকথা নিশ্চিত করে বলেন নি পুরাতাত্ত্বিকরা।

বেদ-উপনিষদ প্রভৃতি প্রাচীন শাস্ত্রে এ প্রথার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। আছে পুরাণে। ‘ব্রহ্মপুরাণে’ উল্লেখ আছে শাঁখা-সিঁদুরের। মনে হয়, শাঁখার ব্যবহার সিঁদুরের চেয়ে প্রাচীন। দাক্ষিণাত্যে দু’হাজার বছর আগে শাঁখার প্রচলন ছিল। কৃষ্ণানুরাগিনী রাধা তাঁর কপালে তৈরি করেছিলেন যে নকশা, তার উপাদান ছিল কুমকুম বা সিঁদুর। ‘মহাভারতে’ দ্রৌপদী হস্তিনাপুরের ঘটনায় মুছে ফেলেন তাঁর সিঁদুর। ‘ললিতসহস্রনামা’ এবং ‘সৌন্দর্যলহরী’ গ্রন্থেও সিঁদুরের উল্লেখ আছে। আদি শঙ্করাচার্যের ‘সৌন্দর্যলহরী’ (৪৪) থেকে একটি শ্লোকের অনুবাদ করেছেন পিআর রামচন্দ্র :

‘হে জননী, তোমার কেশের সিঁথির রেখাটি যেন এক স্রোতের পথ,

যার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তোমার সৌন্দর্যের জলোচ্ছ্বাস,

যা উভয় পাশে আবদ্ধ করে রেখেছে তোমার সিঁদুরকে,

যা উদীয়মান সূর্যের মতো দীপ্তিমান, আর তা ঘিরে রেখেছে তোমার চুল,

যা শত্রুসেনার গাঢ় অন্ধকার সৈন্যদলের মতো,

এই সিঁথি যেন আমাদের রক্ষা করে এবং শান্তি দান করে।

শেষ লাইনের ‘আমাদের’ সর্বনামটি পুরুষদের ইঙ্গিত করছে। তার মানে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে সিঁদুর একটি মঙ্গলচিহ্ন; এটি স্বামীর আয়ু বর্ধকের প্রতীক।

কিন্তু সমাজতাত্ত্বিকরা এই সিঁদুরের মধ্যে প্রাচীন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের লিঙ্গ-বৈষম্যের বৈশিষ্ট্য দেখতে পেয়েছেন। সেই সমাজে নারীকে পুরুষদের ‘সম্পত্তি’ হিসেবে গণ্য করা হত। সিঁদুর প্রথার আগে পাথর দিয়ে নারীর কপাল রক্তাক্ত করা হত, হাতে-পায়ে পরিয়ে দেওয়া হত লোহার বেড়ি। পরবর্তীকালে এই সূচকগুলি পরিবর্তিত হয়ে শাঁখা-সিঁদুর প্রথায় দাঁড়িয়েছে। লোহা > নোয়া। লোহার বেড়ি = আয়স্ত। আবার আয়স্ত > এয়োস্ত্রী।

ডাঃ ভবানীপ্রসাদ সাহু তাঁর ‘নারী : অস্তিত্ব ও সংস্কার’ বইতে বলেছেন, আদিম সমাজে শারীরিকভাবে অধিক বলশালী পুরুষরা প্রায়শই নারীদের জোর করে অপহরণ করে নিজের ঘরে তুলে নিয়ে যেত। অনিচ্ছুক নারীকে অঘাত করে রক্তাক্ত করে দিত, হাত-পা বেঁধে ফেলত। এই বন্ধন ও কপালের রক্তচিহ্ন বিশেষ পুরুষের অধীনস্থ হওয়ার সমার্থক ছিল। পরবর্তীকালে এই অধীনস্থ হওয়া তথা বিশেষ এক পুরুষকে স্বামী বা প্রভু রূপে গ্রহণ করার ব্যাপারটি জন্ম দেয় বিবাহপ্রথার। কিন্তু এই বিবাহিত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে আদিম চিহ্নাদি সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। হাত-পা-গলার বন্ধন পরিণত হয় অলঙ্কারে। নারীদের গলার হার, হাত বা পায়ের বর্তুলাকার গয়নাগুলিকে অনায়াসে আদিম বর্বর প্রধার প্রতীক হিসেবে দেখা যেতে পারে। একইভাবে মেরে-ধরে রক্তপাত ঘটিয়ে নারীকে করায়ত্ত করার আদিম ক্রিয়াকাণ্ড জন্ম দেয় রক্তবর্ণ সিঁদুরের।

মাটি ফুঁড়ে উঠে এলো দস্যুর দল

এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গি হানার কথা। কিন্তু তার আগে স্বঘোষিত হিন্দুত্ববাদীদের ‘সিঁদুর’ নিয়ে প্রচারের কারণটা বলে নিতে হবে। আগের অধ্যায়ে আমরা সিঁদুরের জন্মের যে সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছি, তা স্বীকার করবেন না হিন্দুত্ববাদী শাসকদল। নারীর স্বাধীনতা, স্বাধিকার ইত্যাদি ব্যাপারেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ। অনেকে তাঁদের ‘মনুবাদী’ বলে থাকেন।

সুঙ্গযুগ থেকে গুপ্তযুগের কালে বেদ-বেদান্তের অনুশাসনগুলির নতুন বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখনকার রাষ্ট্রশক্তি সেই বিন্যাসের কাজে সহায়তা করে। আসলে হিন্দুধর্মের সংকট সৃষ্টি করেছিল বিভিন্ন গোষ্ঠীর আগ্রাসন ও বেদ-বিরোধী বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসার। হিন্দুধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য রচিত হয় স্মৃতিশাস্ত্র। রচিত হয় ‘মনুসংহিতা’। এই মনুসংহিতার যুগে নারীকে সামগ্রিকভাবে পুরুষের পদানত করে রাখার চেষ্টা হয়।

‘ধর্ম, সংস্কার ও কুসংস্কার’ গ্রন্থের রচয়িতা কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুশাস্ত্রের অনুশাসন অনুযায়ী ভারতীয় আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে সর্বত্র নারীকে শূদ্রের ও পশুর সাথে একাসনে বসানো হয়েছে। বৈদিক যুগেও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না। ‘শতপথব্রাহ্মণে’ নারীকে শুধু শূদ্র নয়, কুকুর এবং কালো পাখির (কাক) সঙ্গে তুলনা করে সবাইকে ‘অনৃত’ বা ‘মিথ্যা’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। স্মৃতিশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনুও নারীকে ‘মিথ্যার মতোই অপবিত্র’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ‘ভগবদগীতা’য় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই যে চাতুর্বর্ণ্য সৃষ্টি করেছেন এই কথা বলার সময় প্রসঙ্গত আরও বলেছেন যে বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী প্রভৃতি ‘পাপযোনি’রা তাঁকে আশ্রয় করেই পরমগতি লাভ করে। অর্থাৎ বৈশ্য, শূদ্র এবং নারী সবাই একই স্থানীয় এবং পাপী। পরবর্তীকালে অনেক পুরাণেও একই কথা শোনা যায়।’

পুরুষ-পদানত নারীর সিঁদুর নিয়ে বড় চিন্তিত হিন্দুত্ববাদীরা। আর পহেলগামে জঙ্গি হানা তাঁদের উসকে দিয়েছে সিঁদুরের রাজনীতিকরণের।

কিন্তু পহেলগামে কি হয়েছিল?

অনন্তনাগ জেলার পহেলগাম থেকে প্রায় ৭ কিমি দূরে বৈসরণ উপত্যকা। ঘন পাইন বনে ঢাকা এই উপত্যকা। পর্যটকদের প্রিয় স্থান। ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল। সেই মনোরম উপত্যকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন পর্যটকরা। হঠাৎ সেখানে ঢুকে পড়ল সামরিক ধাঁচের পোশাকপরা জনা তিন চার মানুষ। তারা মৃত্যুদূত। হাতে তাদের এম ৪ কার্বাইন ও এ কে ৪৭।

আমেরিকার ফ্লোরিডায় কর্মসূত্রে থাকেন বিতান অধিকারী ও তাঁর স্ত্রী। জঙ্গীদের গুলিতে প্রাণ হারান বিতান। তাঁর স্ত্রীর বিবরণ:

‘আওয়াজ হচ্ছিল। ও (বিতান) বলছে হয়তো বাজির শব্দ। হতে পারে মিলিটারিরা অনেক সময় প্র্যাকটিশ করে। বুঝতেই পারিনি। হুট করে দেখলাম আমার বাচ্চাটাকে এভাবে টেনে …. আগের দিন যেহেতু বৃষ্টি হয়েছিল। সেকারণে কাদাও ছিল। টেনে আ আ করে চেঁচাতে চেঁচাতে যাচ্ছে। পেছন ফিরতেই দেখি একটা লোক দৌড়াচ্ছে… এই আপনি আর আমার মধ্যে যেমন দূরত্ব….. আর ডান….. শেষ….. পড়ে গেল। আমার পেছনে যারা ছিল … মারল আর পড়ে গেল। সবাই গিয়ে একটা জায়গায় বসে পড়লাম। আমার বাচ্চা তো ছোট। প্রচণ্ড আও্য়াজ হচ্ছে। ও (বাচ্চা) বলছে মা ফায়ার…ইটস সো লাউড সাউণ্ড… ও তো কাঁদছে … আমার হাজব্যাণ্ড একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল। ও বুঝতে পারেনি যে টেররিস্ট অ্যাটাক হয়েছে। টেররিস্টরা চলে এসেছিল। ওর টুপিতে ক্যামেরা ছিল। বলছে কারা কারা মুসলিম সরে যান… কারা কারা মুসলিম সরে যান… কারা কারা হিন্দু আছেন বলুন … আমার হাজব্যাণ্ড আ আ করছিল। আমি সামনে ছিলাম যাতে ওর কিছু না হয়। কিন্তু এখানে গুলি করেছে আমি দেখি নি। ওরা দুটো গুলি করেছে। আমি ভাবছিলাম যা হয় আমার ওপরে হোক। আমার হাজব্যাণ্ড, বাচ্চার যাতে কিছু না হয়… কিন্তু যখন দেখেছে যখন আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছি …. ওরা পুরোপুরি পুরুষদের টার্গেট করেছিল।’

কানপুরের নব বিবাহিত শুভম দ্বিবেদী তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন। জঙ্গিরা শুভমের কাছে এসে জানতে চায়, ‘আপনি হিন্দু না মুসলিম? ‘শুভম নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিলে তারা তাঁর মাথায় গুলি করে।

পুনের এক হিন্দু পর্যটকের মেয়ে বলেছেন, জঙ্গিরা তাঁর বাবাকে একটি ইসলামিক আ্য়াত পাঠ করতে বলেছিল, তিনি ব্যর্থ হলে তাঁকে তিনটে গুলি করে। মধ্যপ্রদেশের এক খ্রিস্টান ব্যক্তি কালেমা পাঠ করতে না পারায় গুলিবিদ্ধ হন।

এই হামলায় নিহত হন ২৫ জন পর্যটক ও স্থানীয় এক মুসলমান অপারেটর সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ। তিনি পর্যটকদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত জঙ্গীদের গুলিতে নিহত হন। বাকি যে পঁচিশজন নিহত হন তাঁরা হলেন :

১] নৌবাহিনীর কর্মকর্তা বিনয় নারওয়েল / হরিয়ানার কর্নেল

২] এন রামচন্দ্রন / কেরালার কোচি

৩] বিতান অধিকারী / পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা

৪] দীনেশ আগরওয়াল / চণ্ডীগড়

৫] নীরজ উধওয়ানি / রাজস্থান

৬] দিলীপ দেশাল / মহারাষ্ট্রের মুম্বাই

৭] সঞ্জয় লক্ষণ লেলে / মহারাষ্ট্রের থানে

৮] জে এস চন্দ্র মৌলি / অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্ত্নম

৯] সমীর গুহ / পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা

১০] সুশীল নাথিয়াল / মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর

১১] অতুল শ্রীকান্ত মনি / মহারাষ্ট্রের থানে

১২] হেমন্ত জোসি সুহাস / মহারাষ্ট্রের মুম্বাই

১৩] প্রশান্ত সতপতি / ওড়িশার বালেশ্বর

১৪] ভারতীয় বিমান বাহিনীর কর্পোরাল টেজ হালভিং / অরুণাচল প্রদেশের জিরো

১৫] মধুসূদন সোমিসেট্টি / কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু

১৬] ভারত ভূষণ / কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু

১৭] ইয়াতিশ পারমার / গুজরাটের ভাবনগর

১৮] সুমিত পারমার / গুজরাটের ভাবনগর

১৯] মঞ্জু নাথ রাও / কর্ণাটকের শিবমোগা

২০] সন্তোষ জগদালে / মহারাষ্ট্রের পুনে

২১] কস্তোবে গণভোট / মহারাষ্ট্রের পুনে

২২] শৈলেশ ভাই কালাখিয়া / গুজরাটের সুরাট

২৩] শুভম দেউদি / উত্তরপ্রদেশের কানপুর

২৪] আবগারি পরিদর্শক মণীশ রঞ্জন / পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার ঝালদা

২৫] সুদীপ নোয়েপানি / নেপালের রূপানদেহি

পহেলগাঁওর সন্ত্রাসবাদী হামলার স্বতন্ত্য কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। প্রথমত, সন্ত্রাসবাদীরা বেছে বেছে ‘হিন্দুদের’ (হিন্দু + সিঁদুর) হত্যা করেছে। হিন্দু কি না তা পরীক্ষা করার জন্য প্যান্ট খুলেছে, আয়াত ও কলেমা পাঠ করতে বলেছে। দ্বিতীয়ত, তারা শুধু হিন্দু পুরুষদের হত্যা করেছে, নারীদের রেহাই দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদীদের এ রকম ‘বিবেচনাবোধ’ আগে আমরা দেখতে পাই নি। তৃতীয়ত, যারা শুধু হিন্দুদের হত্যা করবে, তারা কেন আদিল হুসেন শাহকেও হত্যা করল? চতুর্থ, সন্ত্রাসবাদীরা যেন ‘ইনভিজিবল ম্যান’। তারা এলো কোথা থেকে, গেলও বা কোথায় জানা গেল না। পাঁচ লক্ষধিক সেনা যেখানে মোতায়েন আছে, গোয়েন্দারা যেখানে সদা সতর্ক, সেখানে সন্ত্রাসবাদীদের নিশ্চিন্ত আসা-যাওয়ার মধ্যে রহস্যের গন্ধ আছে বলেই মনে হয়। পঞ্চমত, কাশ্মীরের পুলিশ কেন তিন সন্ত্রাসবাদীর ছবি রাস্তায় সেঁটে দিয়ে জনসাধারণের কাছে আবেদন জানাল যে তাদের ধরে দিতে পারলে কয়েক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে? (যার অর্থ সেই সন্ত্রাসবাদীরা এখনও কাশ্মীরে আত্মগোপন করে আছে)।

এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘর্ষের ইতিহাস শুরু হয়েছে ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করেই এই সংঘর্ষ। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৪৭-৪৮ সালে যুদ্ধবিরতি হয়। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত হয়। ভারত নিয়ন্ত্রণ নেয় জম্মু ও কাশ্মীরের একটি অংশ আর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ নেয় আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত-বালাতিস্থান। এরপর ১৯৬৫ সালের কচ্ছ যুদ্ধ। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষীরা ভারত-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঢুকে পড়ে। ৮ এপ্রিল উভয় পক্ষ কচ্ছ অঞ্চলে একে অপরের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। এরপর ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ। কাশ্মীরের কার্গিল জেলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে ভারতের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এরপর ২০১৯ সালের পুলওয়ামা যুদ্ধ। ১৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি জঙ্গিদের আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। ভারতের সেনারা পাকিস্তানের জঙ্গিঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায়।

পহেলগামের ঘটনা সেই হামলার নতুন সংস্করণ।

সিঁদুরের নামে দুর্জনেরে হানো

২০২৫ সালের ৭ মে। শুরু হল ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’। কেন এ রকম নাম? কারণ হিন্দু নারীর সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়েছে যে বর্বরেরা, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান। এ নাম কি সচেতনভাবে দেওয়া? মনে তো হয়। ধারাবাহিকভাবে কর্তারা বলে আসছেন ‘বড় সংকটে আছে এদেশের হিন্দুরা’ (হিন্দু খতরে মে হ্যায়)। পহেলগাঁও সেই সংকটের নিদর্শন। বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা? শুনেই হিন্দু জনতার মনে জাগবে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভ হবে প্রতিহিংসার উৎস। একেই কি বলা যাবে ‘সিঁদুরের রাজনীতি’!

অপারেশন সিঁদুর।

২০২৫ সালের ৭ মে।

ভারত শুরু করল অপারেশন সিঁদুর নামে এক সামরিক অভিযান। পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের মুজাফফারাবাদ, কোটলি এবং পাকিস্তানের পঞ্জাব, পাকিস্তান বাহাওয়ালপুরসহ মোট ৯টি স্থানে হামলা করা হয় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী ভারতের লক্ষ্য ছিল লশকর-ই-তাইয়েবা ও জইশ-ই মুহাম্মদের সন্ত্রাসী ঘাঁটি, পাকিস্তানের কোন সামরিক স্থাপনায় আঘাত করা হয় নি। ভারতীয় বিমান পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ না করেই ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। পাকিস্তানের ভাষ্য অনুযায়ী ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৩১জন নিহত, অন্তত ৪৬ জন আহত হয়েছে। ২০০১-এ সংসদ হামলা, ২০০৮-এ মুম্বাই হামলা, ২০১৬-এ পাঠানকোট ও ২০১৯-এ পুলওয়ামা হামলায় যে জইশ-ই- মুহাম্মদ প্রধান মাসুদ আজহারের হাত ছিল, সেই মাসুদ আজহার বলেছেন যে ভারতের হামলায় তাঁর পরিবারের ১০জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৫ শিশু ছিল। ইসলামাবাদের অবশ্য দাবি ছিল এই জঙ্গিকে তাঁরা আশ্রয় দেন নি।

পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ রাখা হয় ৪৮ ঘণ্টার জন্য। বাতিল করা হয় সব ফ্লাইট। পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে বনধ রাখা হয় সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভারতের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ২৫ টি বিমানবন্দর বন্ধ রাখা হয়। পাকিস্তানি টিভি চ্যানেল ছাড়াও ভারত সরকার ৬টি বাংলাদেশি চ্যানেলের ইউটিউব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়।

পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ জানান যে একাধিক ভারতীয় ড্রোন পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। এসব ড্রোন করাচি ও লাহোরসহ ৯টি জায়গায় পাঠানো হয়, লাহোরের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়।

পারিষদদলে বলে তার শতগুণ

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তানের মিডিয়া এই হামলাকে কেন্দ্র করে অজস্র ভুল তথ্য প্রচার করে। আমরা ভারতের মিডিয়ার ভুয়ো খবরের কথাই এখানে আলোচনা করব। আমাদের সেনারা যা বলেন নি, এমন কি সরকারের প্রতিনিধিরা যা বলেন নি, তাই সাড়ম্বরে বলে চলেছিল মিডিয়া। এদের খবর দেখে মনে হচ্ছিল করাচি, লাহোর, আজাদ কাশ্মীর সবই যেন দখল হয়ে গেছে। এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করা হয়, যাতে এদেশের নাগরিক মুসলমানদের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ঘৃণা সৃষ্টি হয়।

আমেরিকার প্রভাবশালী পত্রিকা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ভারতের শীর্ষস্থানীয় মিডিয়াগুলি যাচাই-বাছাই না করে ভুয়ো খবর পরিবেশন করেছে। এমন কি গাজা অঞ্চলে বোমা হামলার পুরানো ভিডিয়ো দেখিয়ে তা পাকিস্তানের হামলা বলে তারা চালিয়ে দিয়েছে।’ পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানকে ভূপাতিত করার খবরও ভুল ছিল। ভারতীয় সাংবাদিক রাজদীপ সে কথা স্বীকার করেছেন। ভারতের সেনা প্রধান অনিল চৌহান রাফাল বিমান ধ্বংসের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।

‘নিউইয়র্ক টাইমসে’র রিপোর্টটি এই রকম :

‘Disinformation on social media in the days during and since India and Pakistan’s intense military confrontation last week has been overwhelming. Sifting fact from fiction has been nearly impossible on both sides of the border because of the sheer volume of falsehood, half- truths, memes, misleading video footage and speeches manipulated by artificial intelligence.

‘But some of that flood also made its way into the mainstream media, a development that alarmed analysts monitoring the evolution of outlets in India once trusted for their independence. The race to break news and a jingoistic approach to reporting reached a fever pitch during the four day conflict, as anchors and commentators became cheerleaders for war between two nuclear-armed states. Some well-known TV networks aired unverified information or even fabricated stories amid the burst of nationalistic fervor.

‘And news outlets reported on a supposed strike on a Pakistani nuclear base that was rumored to have caused radiation leaks. They shared detailed maps that purported to show where the strikes had been. But there was no evidence to uphold these claims. The story of the Indian Navy attacking Krachi was also widely circulated. It has since been discredited. ’

গভীরে গোপনে ঘৃণা, লুকাবে কোথায়?

সিঁদুর অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি।

কে এই সোফিয়া কুরেশি?

সোফিয়া কুরেশি ভাদোদরায় মহম্মদ কুরেশি ও আমিনা কুরেশির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বরোদার মহারাজা সায়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব প্রযুক্তিতে ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে অফিসার্স ট্রেনিং অ্যাকাডেমি থেকে আর্মি সিগন্যাল কর্পসে স্নাতক হওয়ার পরে কুরেশি জম্মু ও কাশ্মীর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে বিদ্রোহী-বিরোধী অভিযানে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে তিনি সেনাবাহিনীর প্রথম মোবাইল ডিজিটাল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরিতে সাহায্য করেন। ২০১৬ সালে তিনি ফোর্স ১৮ অনুশীলনের সময়ে ভারতীয় সৈন্যের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি উল্লেখযোগ্য।

সামরিক যোগাযোগ ও সাইবার যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি অপারেশন সিঁদুরে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। কুরেশি উইং কম্যাণ্ডার ব্যোমিকা সিং এবং বিদেশ সচিব বিক্রম মিসরির সঙ্গে অপারেশন সিঁদুর সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন।

আর এই কর্নেল কুরেশি সম্পর্কে কি বললেন বিজেপি নেতা কুনওয়ার বিজয় শাহ? এই মান্যবর আবার মধ্যপ্রদেশের উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রী। মহৌতে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে এই মন্ত্রী বললেন,

‘জিনহোনে হামারি বেটিওঁ কে সিঁদুর উজাদেদে… হমনে আনহিকি বেহেন ভেজ কর কে উনকি আইসি কি তাইসি করওয়াই’ অর্থাৎ ‘যারা আমাদের মেয়েদের কপাল থেকে সিঁদুর মুছে দিয়েছে আমরা তাদের বোনকে পাঠিয়েছি তাদের শিক্ষা দিতে।’

এখানেই থামেন নি মান্যবর। তিনি বলেছেন, ‘তারা হিন্দুদের পোশাক খুলে হত্যা করেছিল, আর মোদিজি তাদের বোনকে পাঠিয়েছিলেন অনুগ্রহের প্রতিদান দিতে। যেহেতু মোদিজি তাদের পোশাক খুলতে পারেন নি, তাই তিনি তাদের সম্প্রদায়ের একজন বোনকে পাঠিয়েছিলেন এই বার্তা দেওয়ার জন্য যে যদি তুমি আমাদের সম্প্রদায়ের বোনেদের বিধবা করো, তাহলে তোমার সম্প্রদায়ের একজন বোন তোমাকে উলঙ্গ করবে।’

আদালতে ধমক খেয়ে, জনতার চাপে পড়ে মন্ত্রী মান্যবর ক্ষমা চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় হিন্দুত্ববাদীদের অবচেতন মনে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি সঞ্চিত রয়েছে গোপন ঘৃণা।

আর এক কীর্তিমান, বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ রামচন্দ্র জাংরা নিহত পর্যটকদের স্ত্রীদের নিশানা করেছেন। দেবী অহল্যাবাঈ হোলকার জয়ন্তী উপলক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘স্বামীদের জীবনের জন্য আবেদন করার পরিবর্তে তাদের লড়াই করা উচিত ছিল। যদি তারা লড়াই করত তাহলে তাদের নিরীহ স্বামীদের তাদের সামনে গুলি করে হত্যা করা হত না।’

চমৎকার। আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে নারীরা কেমনভাবে লড়বে সে দিকে যদি আলোকপাত করতেন মহামান্য সাংসদ, তাহলে ভালো হত।

জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তর্গত উধমপুরের (পূর্ব) বিধায়ক রনবীর সিং পাঠানিয়া নিশানা করেছেন বায়ুসেনাদের। তিনি বলেছেন, ‘অপারেশন সিঁদুরের সময় কি হয়েছিল সকলে জানেন। হামলার সময় বায়ুসেনারা ঘুমোচ্ছিল। এরা সব অপদার্থ।’

সেনাদের প্রতি এই দলের নেতাদের বিশ্বাস নেই, শ্রদ্ধাও নেই। তাই তো লোকগায়িকা নেহা সিং রাঠোর কর্নেল কুরেশির পক্ষ নিয়ে বলেছেন, ‘এই সব নেতা-মন্ত্রীদের ঘরের কতজন মানুষ আছেন সেনা বাহিনীতে? কি করে তাঁরা বুঝবেন সেনাদের মর্মব্যথা?’

মুসলমান বলে কর্নেল কুরেশির প্রতি ঘৃণা! তাহলে হিন্দু হয়েও যে দেশদ্রোহী তার কি হবে মহাশয়? হ্যাঁ, আমি জ্যোতি মালহোত্রার কথা বলছি।

হরিয়ানার বাসিন্দা অসামান্য সুন্দরী জ্যোতির ইউটিউব, ফেসবুক, ইসট্রাগামে অনুরাগীর সংখ্যা বিপুল। দেশে থেকেই তিনি করে যাচ্ছিলেন গুপ্তচরবৃত্তি। সিঁদুর অপারেশনের সময়ে একের পর এক গোপন তথ্য তিনি পাচার করে যাচ্ছিলেন পাকিস্তানে। তিন তিন বার গেছেন তিনি পাকিস্তানে। ট্রাভেল ভিডিয়ো বানানোর আছিলায়। ভারতের পাক দূতাবাস কর্মী এহসান উর রহিম (দানিশ) এর সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম। আমাদের গোয়েন্দা, আমাদের পুলিশ জানতেও পারেন নি এসব।

নির্দেশ এলো বিশ্বগুরুর : থামাও যুদ্ধ, থামাও

বিশ্বগুরু কে? কেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত। মোদি = ভারত। অতএব আমাদের মোদিই বিশ্বগুরু।

নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে তাঁর অনুরাগীরা বলতে শুরু করেছিলেন যে ভারতের সভ্যতার গভীরতা, সমৃদ্ধ দার্শনিক ঐতিহ্য, স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক অনুশীলন ইত্যাদির সঙ্গে অর্থনৈতিক সাফল্য এবং প্রযুক্তিগত সাফল্যের ফলে ভারত বিশ্বগুরুর মর্যাদা লাভ করতে চলেছে। আর নরেন্দ্র মোদিই তো ভারত। সুতরাং নরেন্দ্র মোদিই বিশ্বগুরু।

জি২০-এর মর্ফ করা ছবিগুলির কথা মনে আছে?

একটি বিশাল ভবনের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানেরা। ফ্রেমের সামনে কে আছেন? আছেন আমাদের নরেন্দ্র মোদি। তাঁর পেছনে আছেন একে একে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি, ফরাসি রাষ্ট্রপতি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ….। বিশ্বগুরুই তো সামনে থাকেন। ভক্তরা বলতে শুরু করলেন, ‘আপনি কি জানেন যে মোদিজি কেবল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বিশটি দেশেরই প্রধানমন্ত্রী।’ আমাদের এই বিশ্বগুরুর কাট-আউট দেখেছিলাম রামমন্দির উদ্বোধনের সময়ে। আগে আগে হাঁটছেন বিশ্বগুরু। বিশাল তাঁর মূর্তি। তাঁর পাশে শিশু রাম। যেন রামচন্দ্রকে চালিত করে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বিশ্বগুরুর ইমেজটাকে উজ্জ্বল করে রাখার জন্যই তিনি বলেছিলেন যে তিনি মাতৃগর্ভজাত নন, ঈশ্বরপ্রেরিত।

বিশ্বগুরুর দাবিতে জল ঢেলেছে ফোর্বস। ইউএস নিউজ ও ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের তথ্য যুগ্মভাবে প্রকাশ করেছে ফোর্বস। ২০২৫ সালে বিশ্বের ক্ষমতাশালী দেশগুলির যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তাতে বিশ্বের প্রথম দশটি দেশের তালিকায় নাম নেই ভারতের। ভারত শুধু দ্বাদশ স্থানাধিকারী দেশ নয়, সংযুক্ত আরব আমির শাহি এবং ইজরায়েলের মতো ছোট দেশের চেয়েও পিছিয়ে আছে ভারত। রিপোর্টে বলা হয়েছে আঞ্চলিক কূটনীতিতে ভারত ব্যাকফুটে আছে। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোদির জমানায় ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান এবং চিনের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। সম্পর্কের অবনতি হয়েছে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের সঙ্গে। অথচ মোদি সরকার কোটি কোটি টাকা বিজ্ঞাপনে খরচ করে মানুষকে বোঝাতে চাইছে যে ভারতের অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে, বৃহৎ সামরিক শক্তি ও বিশ্ব কূটনীতিতে ভারত বেশি প্রভাব বিস্তার করছে।

পহেলগামের যুদ্ধবিরতিতে আরও স্পষ্ট হয়ে গেল বিশ্বগুরুর অবস্থান।

কার আদেশে অকস্মাৎ যুদ্ধবিরতি হল?

আসুন আমরা শুনে নিই আসল বিশ্বগুরুর হুমকির কথা। আমেরিকার হোয়াইট হাউজে সাংবাদিক সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন, ‘আমার প্রশাসন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ণ এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করতে সাহায্য করেছে, যার ফলে প্রচুর পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুটি দেশের মধ্যে বিপজ্জনক সংঘর্ষের অবসান ঘটেছে।’ [‘I think the deal I’m most proud of is the fact that we’re dealing with India, we’re dealing with Pakistan and we are able to stop potentially a nuclear war through trade as opposed through bullets . ….. Normally, they do it through bullets. We do it through trade. So I’am very proud of that. Nobody talks about it but we had a very nasty potential war going on between Pakistan and India, And now, if you look, they ‘re doing fine.’ The Hindu, May 31, 2025]

সাংবাদিক সম্মেলনের আগে ট্রাম্প তাঁর ‘ট্রুথ সোশ্যাল প্লাটফর্মে’ একটি পোস্টে যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব প্রথম গ্রহন করেছিলেন।

তাই স্বঘোষিত বিশ্বগুরুর মুখে কুলুপ।

আর দেরি নয়, কর গো ত্বরা, হাতে হাতে ধরগো

‘ট্রাম্প-অস্বস্তি ঢাকতেই মোদির নয়া ছক’ প্রতিবেদনে সাংবাদিক গৌতম হোড় লিখেছেন, পহেলগাম কাণ্ডের পর বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী জানিয়ে দেন যে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিক, তাঁরা তা সমর্থন করবেন। যুদ্ধ বিরতির পর মোদি সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতের হয়ে কথা বলার জন্য প্রতিনিধিদল পাঠানোর কথা ভাবলেন। সে প্রতিনিধিদলে বিরোধী নেতারাও থাকবেন।

তারপরে যে প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে তা হল বিদেশে প্রতিনিধিদল পাঠানোর দরকার হল কেন? তার কারণ ট্রাম্প-অস্বস্তি। ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন যে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য করতে হলে যুদ্ধবিরতি করতে হবে। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প আরও জানিয়েছেন যে ভারত ও পাকিস্তানকে আলোচনায় বসতে হবে, কাশ্মীর নিয়ে কথা বলতে হবে। সরকার ও সেনার পাশে থেকেও বিরোধীদলনেতা সংসদের অধিবেশন ডেকে এই নিয়ে আলোচনার দাবি জানিয়েছেন। সরকার যতই প্রচার করুক না কেন যে পাকিস্তানই ফোন করে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আবেদন করেছে তবু বিশ্ববাসীর কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য আগেই পৌঁছে গিয়েছিল।

তাই মোদি সরকারকে তড়িঘড়ি বিরোধীদের বলতে হল, আর দেরি নয়, কর গো ত্বরা, হাতে হাতে ধরগো।

২০২৫ সালের ১৭ মে সরকার ঘোষণা করল যে ৫১ জন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ৭টি বহুদলীয় প্রতিনিধিদল মে মাসের শেষ দিকে ৩০টিরও বেশি দেশে গিয়ে পাকিস্তান থেকে উদ্ভূত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান তুলে ধরবে।

কংগ্রেসের শশী থারুরের নেতৃত্বে এক দল যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পানামা, গায়ানা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া। এই দলে আছেন তেজস্বী সূর্য থেকে শুরু করে শিবসেনার মিলিন্দ দেওরা, জে এম এমের সরফরাজ আহমেদ।

বিজেপির রবিশঙ্কর প্রসাদের নেতৃত্বে আর এক দল যাচ্ছেন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং ডেনমার্ক। এই দলে আছেন কংগ্রেসের অমর সিং, শিবসেনার (ইউবিটি) প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী।

ডি এমকের কানিমোঝির নেতৃত্বে এক দল যাচ্ছেন রাশিয়া, স্পেন, গ্রিস, স্লোভেনিয়া, লাটভিয়া। এই দলে আছেন আনন্দ শর্মা ও মনীশ তিওয়ারির মতো প্রবীণ নেতারা।

জনতা দলের (ইউনাইটেড) সঞ্ঝয় কুমার ঝা-এর নেতৃত্বে এক দল যাচ্ছেন জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া। এই দলে আছেন সিপিএইএমের জন ব্রুটাস, প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সলমান খুরসিদ, তৃণমূলের অভিষেক ব্যানার্জী।

শিবসেনার শ্রীকান্ত শিণ্ডের নেতৃত্বে এক দল যাচ্ছেন সংযুক্ত আরব আমিরতাত, লাইবেরিয়া, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সিয়েরা লিওন। এতে আছেন কেরালার আইইউএমএলের ইটি মোহাম্মদ বশির, প্রাক্ত কূটনীতিক সুজন চিনয়।

বিজেপির বৈজয়ন্ত জয় পাণ্ডার নেতৃত্বে এক দল যাচ্ছেন সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, আলজেরিয়া। এই দলে আছেন কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গুলাম নবী আজাদ, এ আই এম আই এমের আসাদউদ্দিন ওয়াইসিও।

প্রধানমন্ত্রী যে বিরোধীদের কণ্ঠে শুধু পাকিস্তানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেতেন, তাঁকেই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারে বিরোধীদের সাহায্য গ্রহণ করতে হল।

সিঁদুর খেলা, খেলার সিঁদুর

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সহকারীরা এবার শুরু করে দিলেন সিঁদুর নিয়ে খেলা। পবিত্রতার চিহ্ন বলে যে সিঁদুরকে নিয়ে তাঁদের উচ্ছ্বাস, শেষ পর্যন্ত তা হল খেলার সিঁদুর। সে খেলা অবশ্যই রাজনীতির খেলা। সেনাবাহিনীর পোশাক পরে ছবি তুললেন তিনি। সামরিক বিমানে উঠে ছবি তুললেন। সেই সব ছবি এবার রাস্তায় শোভা পেতে লাগল। বহুরূপী সাজার দুর্দমনীয় আবেগ তাঁর। কখনও চাওয়ালা সাজেন, কখনও চৌকিদার, কখনও প্রধান সেবক…। দেশের দুর্গম এলাকায় মোতায়েন সেনাদের সঙ্গে তাঁদের পোশাক পরে দীপাবলি উদযাপন করেন। ট্যাঙ্কে চড়েন, সেনার পোশাকে বক্তব্য রাখেন।

অপারেশন সিঁদুরের পরে তিনি দেখা দিলেন সেনানায়ক হয়ে।

এবার যুদ্ধের পোশাকে প্রধানমন্ত্রী। সেই ছবি দেশের কোণায় কোণায়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধানের এই ছবি কি সমস্যার সৃষ্টি করবে না? সেই প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিক সাবা নকভি ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকার এক নিবন্ধে। মোদি কোন জেনারেল নন, তিনি একটা দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, একটি কোয়ালিশন সরকারের প্রধান — ‘So why borrow the optics of the battlefield for a domestic public relations campaign? Why collapse the line between war and vote, between soldier and statesman? For it is ultimately risky for the future of the country when a military operation is linked to political messaging with electoral outcomes in mind.’ (‘Operation Sindoor blurred the lines between security and showbiz’)

এর পরে আবার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর শেষ হয় নি, শুধু স্থগিত আছে’। এই বক্তব্যের পরিণাম কি? সাংবাদিক সাবা নকভির মতে, ‘For this can imply that India is in a suspended warfare and a volatile place with nuclear weapons in the region. Such a statement signals to both the domestic and international constituencies that South Asia is a space where conflict can be resumed and where the decision to strike or stand down may not just be a matter of national security but also political optics’ (পূর্বোক্ত নিবন্ধ)।

তার মানে সিঁদুর নিয়ে রাজনীতি?

রাজস্থানের জনসভা থেকে মোদি বললেন, তাঁর শরীরে রক্ত নয়, গরম সিঁদুর বইছে। হূঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, কেউ সিঁদুর মুছে দিতে এলে তাদেরও মুছে দেওয়া হবে

গুজরাতের দাহোদের এক জনসভায় মোদি জানালেন যে অপারেশন সিঁদুর ভারতীয়দের সংস্কার ও ভাবনার অভিব্যক্তি। তিনি বললেন, ‘জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসবাদীরা যা করেছে, তার পরে কি ভারত চুপ করে থাকতে পারত? যখন কেউ আমাদের বোনেদের সিঁদুর মুছে দিতে আসবে, তখন তাদেরও মুছে যেতে হবে, এটা নিশ্চিত। অপারেশন শুধুই একটা সামরিক অভিযান নয়, এটা ভারতীয়দের সংস্কার, ভাবনার অভিব্যক্তি। যারা সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি মোদির সঙ্গে মোকাবিলা করা কত কঠিন।’

প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দুটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। ১] সামরিক অভিযানকে লোকাচার-সংস্কার- আধ্যাত্মিক ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ২] সামরিক অভিযানের মূল কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে নিজেকে।

পহেলগামে জঙ্গি হানার পরের দিনই প্রধানমন্ত্রী চলে এলেন বিহারে। সে রাজ্যে ভোট সমাগতপ্রায়। ভোট বড় বালাই। আসতেই হবে বিজেপির প্রধান প্রচারককে। রোহতাসের জনসভায় তিনি সন্ত্রাসবাদকে তুলনা করলেন সাপের সঙ্গে। সেই সাপের বিষদাঁত ভেঙে ফেলার উদ্দীপ্ত আহ্বান। আর একটা কথা বললেন তিনি : ‘সীমান্তের ওপার হোক কিংবা ভিতরে, প্রতিটি শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলবে। ’

ভেতরের শত্রু কে বা কারা?

এই প্রধানমন্ত্রীই তো বিরোধীদের কণ্ঠে পাকিস্তানের স্বর শুনতে পান!

সেই বিরোধীরা দেশের বিপদে একজোট হয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, অথচ প্রধানমন্ত্রী বিরোধীশাসিত রাজ্যে গিয়ে তাদের সমালোচনায় মুখর। পশ্চিমবাংলার আলিপুরদুয়ারের সভায় ৩২ মিনিটের ভাষণে ১৮ মিনিট রাজ্য সরকারের সমালোচনা। তার একদিন পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নেতাজি ইণ্ডোরের সভায় প্রকারান্তরে বলে দিলেন যে এই রাজ্য সরকারের মনঃপূত নয় অপারেশন সিঁদুর, তার মানে ….। অথচ এই সরকারের প্রতিনিধি ভারতের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন বিদেশে।

২২ মে থেকে ৩১ মের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী রাজস্থান, গু্জরাট, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গে মোট ৯টি জনসভা করেছেন। অপারেশন সিঁদুরের কথা বলতে গিয়ে তিনি মূলত নিজেদের সাফল্যকে তুলে ধরেছেন, বিরোধীদের সমালোচনা করেছেন, সেনাদের সম্বন্ধে নিজের দলের লোকেদের কুমন্তব্যের ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করেন নি।

এর মধ্যে ২৮মে ‘দৈনিক ভাস্করে’ প্রকাশিত হল একটি খবর। প্রতিবেদনে বলা হল ৯ জুন থেকে ঘরে ঘরে মহিলাদের মধ্যে সিঁদুর বিতরণ করবে বিজেপি। এটা হবে অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য প্রচারের প্রচেষ্টার অঙ্গ।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সেই খবরের প্রতিক্রিয়ায় বলে দিলেন, স্বামীই তার স্ত্রীকে সিঁদুর দেয়। প্রধানমন্ত্রী দেশের সমস্ত বধূকে সিঁদুর দেবার কে? (‘এক দেশ এক দল’, এক দেশ এক নেতা, ‘এক দেশ এক পতি’)। মুখ্যমন্ত্র্রী আরও বললেন, সিঁদুর যদি দিতে হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী আগে তাঁর স্ত্রীকে সিঁদুর দিন।

মুখ্যমন্ত্রীর এই কথার প্রতিক্রিয়ায় কি না জানিনা, সারা দেশে সিঁদুরদানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। তখন তড়িঘড়ি করে বিজেপির আইটি সেল এটাকে ভুয়ো খবর বলে জানাল। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বিজেপির দুই মুখপাত্র কটাক্ষ করতে ছাড়লেন না।

বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য বললেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচিত তাঁর নিজের রাজ্যের খারাপ অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া এবং জাতীয় নিরাপত্তের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে অযৌক্তিক মন্তব্য করা উচিত নয়।’

বিজেপির মুখপাত্র সম্বিত পাত্র বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সকলের সেবক — তিনি কারও বাবার মতো, কারও ভাইএর মতো। সন্দেহ নেই যে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের প্রতি যদি কেউ সবচেয়ে বেশি উপকার করে থাকেন তাহলে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সমস্ত অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে যদি কোনও নেত্রী প্রিয় হন তিনি হলেন মমতা নিজেই।’

কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো, রূপকথা নয় সে নয়

ঘরে ঘরে সিঁদুর বিতরণের কথা শুনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, আগে তো নিজের পত্নীকে সিঁদুর দিন।

পত্নী? প্রধানমন্ত্র্রী নরেন্দ্র মোদির পত্নী?

২০১৪ সালের আগে দেশের মানুষ জানতোই না যে নরেন্দ্র মোদি বিবাহিত। নরেন্দ্রভাইও কোনদিন বলেন নি। ২০০১, ২০০২, ২০০৭, ২০১২ সালে বিধানসভার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ফর্মে স্ত্রীর তথ্যের ঘরটি রেখেছিলেন ফাঁকা। ২০০২ সালে সাংবাদিক দর্শন দেশাই খুঁজে পান যশোদাবেনকে ; তবে তাঁর সঙ্গে সাংবাদিককে কথা বলতে দেওয়া হয় নি। ২০০৯ সালে ‘ওপেন’ পত্রিকার প্রতিনিধি যশোদাবেনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ‘দ্য ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’র প্রতিবেদক যশোদাবেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সে বছর টিভি৯ যশোদাবেনের ভিডিয়ো সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেন

নরেন্দ্র মোদির বিয়ে ও তাঁর পরিত্যক্তা স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে যে সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দিচ্ছি :

1] Abandoned as a child bride, wife of India’s Modi / Annie Gowen / The Washington Post / 25.01,2015

2] The Forgotten Half / Nandini Oza & Kallol Bhattarchya / Manorama online / 22.04.2014

3] Jashoben hopes to get 3rd time lucky with RTI / India Today / 08.05,2015

4] The Emperor Uncrowned / Vinod K Jose / The Caravan / 01.03.2012

5] India elections : Family man? Not Modi / Victor Mallet / Financial Times, London / 10.04.2014

6] Narendra Modi, frontrunner for Indian P.M admits to ‘secret’ wife / Robin Pagnarmenta / The Times, London / 10.04.2014

7] Let Modi change his mindset towards women / S.N.M. Abdi / Gulf News / 19.12.2014

  1. 10 facts to know about Jasodaben, wife of Prime Minister Narendra Modi / Raj Singha / India TV / 25.11.2014

9] Why did Narendra Modi keep his wife secret for almost 50 years? / Adam Taylor/ The Washington Post / 10.04.2014

10] I am Narendra Modi’s Wife / Haima Despande / Open / 11.04.2009

কেন ৫০ বছর ধরে স্ত্রীর পরিচয় গোপন রাখলেন নরেন্দ্র মোদি, সে এক রহস্য। ২০১৪ সালে তিনি বাধ্য হলেন স্ত্রীর পরিচয় দিতে। কেন? তিনি সে বছর লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী ছিলেব ভাদোদরা আসনে। আমেদাবাদের এক নাগরিক নিশান্ত ভার্মা মোদির বিরুদ্ধে আইনি স্ত্রীর বিষয় অস্বীকার করার এবং পূর্ববর্তী নির্বাচনী দলিলগুলিতে ভুয়া তথ্য জমা দেবার জন্য ফৌজদারি অভিযোগ আনেন। এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়।

এই মামলার জন্য বিরোধীরাও সরব হন। চাপে পড়ে মোদি স্বীকার করেন তাঁর স্ত্রীর কথা [ RSS: Jasodaben is my wife, Narendra Modi admits under oath / The Times of India / 10.04.2014 // India election: BJP ‘bachelor’ Modi admits marriage / BBC News / 10.04.2014 // Allahabad HC gives 6 week’s time to P.M Narendra Modi to file statement on election petition / The Times of India / 03.11. 2014 ]

স্ত্রীর কথা চাপে পড়ে স্বীকার করেছেন নরেন্দ্র মোদি,. কিন্তু তার পরেও স্ত্রীর সম্মান দেন নি যশোদাবেনকে। যশোদা স্বামীর কোন অনুষ্ঠানে ডাক পান না, ডাক পান না শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। শাশুড়ি হীরাবেন মারা গেলেন, শেষকৃত্য অনুষ্ঠানেও তাঁকে ডাকা হল না।

অথচ এসব নিয়ে কোন অভিযোগ নেই যশোদাবেনের।

স্বামী তাঁকে ত্যাগ করলেও তিনি ত্যাগ করেন নি স্বামীকে। স্বামীর জন্য মুম্বাই গিয়ে পুজো দেন মহালক্ষ্মী মন্দির ও সিদ্ধিবিনায়ক মন্দিরে। অথচ কোন প্রত্যাশা নেই স্বামীর কাছে। একেই কি বলে অহৈতুকী প্রীতি? একেই কি বলে ত্যাগ করে ভোগ করা?

২০১৫ সালের জুন মাসে মোদির সমর্থকদের আয়োজিত এক রাজনৈতিক কনফারেন্সে বক্তৃতা দেবার জন্য যশোদাবেনের ডাক আসে। এক সপ্তাহব্যাপী এই কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিনে তা বন্ধ করে দেওয়া হয় অমিত শাহ প্রভৃতির নির্দেশে। যশোদাবেন যাতে না অংশগ্রহণ করতে পারেন, তার জন্যই কি এই ব্যবস্থা? না, এ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেন নি যশোদাবেন। দেশের বাইরে থাকা আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ২০১৫ সালে যশোদাবেন পাশপোর্টের আবেদন করেছিলেন। সে আবেদন বাতিল হয়ে যায়। কারণ বিবাহ নিবন্ধনের কাগজ বা স্বামীর স্বাক্ষর ছিল না। যশোদাবেন সে সব কাগজের জন্য স্বামী বা স্বামীর পার্শ্বচরদের কোন অনুরোধ করেন নি।

২০১৪৫ সালের মে মাস থেকে মেহসানা জেলার পুলিশ তাঁকে নিরাপত্তা দিতে শুরু করে। স্পেশাল প্রটেকশন গ্রুপ আইন অনুযায়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী যথাযথ নিরাপত্তার দাবিদার।

এ কি পরিহাস !

স্ত্রীর মর্যাদা যিনি পেলেন না, তাঁর জন্য নিরাপত্তা !

গান্ধীনগরে এর আগে দুবার তিনি আর.টি.আইএর কমিশনারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ব্যাপারটা কি? সদুত্তর মেলে নি। শুধু জানানো হয় এর উত্তর দিতে পারবে স্থানীয় ইনটেলিজেন্স ব্যুরো। আরও অবাক কাণ্ড, উত্তর দেবার সময়ে যশোদাবেনের স্বামী যে নরেন্দ্র মোদি সেকথা উল্লেখ করা হচ্ছে না, লেখা হচ্ছে যশোদাবেন চিমনভাই মোদির কন্যা।

অথচ যশোদাবেন এখনও সিঁদুর পরেন . পরেন মঙ্গলসূত্র।

উপেক্ষিতা এই নারীর কোন অভিযোগ নেই, কোন প্রত্যাশা নেই।

কেউ কেউ তাঁকে গৌতম বুদ্ধের স্ত্রী যশোধরা, তুলসীদাসের স্ত্রী রত্নাবলীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। ধর্মীয় সংগঠনগুলি তাঁকে হনুমানের স্ত্রী শুভার্চলার সঙ্গেও তুলনা করেছেন। মানুষকে দেবী বানানোর চেষ্টা আমাদের দেশে ঐতিহ্যগত।

দেবী নয়, আমরা মানুষ যশোদাবেনের কথা ভাবতে চাই।

গুজরাটের মেহসানা থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার এগিয়ে মেন রাস্তা থেকে বাঁদিকে এগিয়ে পড়বে ব্রাহ্মণওয়াড়া বাজার। সেখান থেকে আর একটু এগিয়ে যশোদাবেনের পৈতৃক বাড়ি। এই বাড়িতে জন্ম যশোদার। এখন সেখানে থাকে তাঁর ছোটভাই। মেহসানার উঞ্ঝায় বড়দাদা অশোকের কাছে থাকেন যশোদা। মাঝে মাঝে চলে আসেন পৈতৃক বাড়িতে।

খাটিয়ায় বসে স্মৃতিচারণা করেন। মনে পড়ে তাঁর বিয়ের কথা। মাত্র পাঁচ বছর ছিল সেই বিবাহিত জীবন। তারপরে চলে যান স্বামী। কেন চলে গেলেন তিনি? কি দোষ তাঁর?

এখনও স্বামীর মঙ্গলকামনায় সিঁদুর পরেন তিনি।

সিঁদুর অপারেশনের পরে তাঁর স্বামীর দল সিঁদুর বিতরণের কথা বলছেন, অথচ তাঁদের কেন মনে আসছে না যশোদাবেনকে সিঁদুরদানের কথা।


আপনার মতামত লিখুন :

One response to “সিঁদুরের ইতিকথা আর কোন এক গাঁয়ের বধূর দারুণ মর্মব্যথা : দিলীপ মজুমদার”

  1. Abhijit Banerjee says:

    দারুন একটি প্রতিবেদন এবং এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন