বলিউডে পা রেখেই একের পর এক ছবি, উল্কার গতিতে উত্থান। অসাধারণ সুন্দরী তো তিনি ছিলেনই, সঙ্গে ‘বাবলি ইমেজ’ নজর কেড়েছিল সকলের। কিন্তু… আচমকাই রুপোলি পর্দার মায়াবী আকাশ থেকে খসে পড়ল সেই উজ্জ্বল নক্ষত্র। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই আচমকা মৃত্যু হয় এই সুপারহিট নায়িকার। তার মৃত্যু নিছকই দুর্ঘটনা না গভীর ষড়যন্ত্র আজও রহস্য থেকে গেল। দিব্যা ভারতীর রহস্যে মোড়া সেই কাহিনী আজকের লেখায়।
দিব্যা ভারতী ১৯৭৪ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী মুম্বাইতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ওম প্রকাশ ভারতী একজন বীমা কর্মকর্তা এবং মা মীতা ভারতী ছিলেন ওম প্রকাশের দ্বিতীয় স্ত্রী। দিব্যা হিন্দি, ইংরেজি এবং মারাঠি ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারতেন। অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু করার সময় নবম শ্রেণী পর্যন্ত মুম্বাইয়ের জুহুতে মানেকজি কুপার হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন।
দিব্যা ভারতীর আহ্লাদী চেহারার জন্য অনেকেই তাঁকে শ্রীদেবীর সঙ্গে তুলনা করতেন। যেসব সিনেমায় শ্রীদেবীর মতো হাই প্রোফাইল স্টারকে নেওয়া সম্ভব হত না, সেগুলিতে দিব্যা ভারতীকে বাছাই করা শুরু হলো। দেখতে সুন্দর, বয়স কম একের পর এক প্রযোজক বারংবার দিব্যার মা-বাবার কাছে আসতো অনুরোধ নিয়ে।
কিন্তু মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ফর্মুলাটা বড়ই অদ্ভুত। দিব্যার ভাগ্যেও যে মসৃণভাবে সুযোগ এসেছিল তেমনটি মোটেও নয়। বাস্তবে যখন তারা রাজি হলেন তখন আর ছবিটা করা হলো না। বারংবার রিজেক্ট হলেন।
১৯৮৮ সাল, ভারতী তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী, তাকে চলচ্চিত্র নির্মাতা নন্দু তোলানি তার চলচ্চিত্র ‘গুনাহোঁ কা দেবতা’র জন্য চুক্তিবদ্ধ করেন। কিন্তু পরে সেটি বাতিল হয়ে যায়। তার জায়গায় সঙ্গীতা বিজলানিকে নেওয়া হয়। কীর্তি কুমার (গোবিন্দার ভাই) একটি ভিডিও লাইব্রেরিতে ভারতীকে লক্ষ্য করেন। তিনি গোবিন্দার বিপরীতে তার ‘রাধা কা সঙ্গম’ সিনেমার জন্য তাকে চুক্তিবদ্ধ করতে আগ্রহী ছিলেন। এই সিনেমার জন্য কয়েক মাস ধরে নাচ এবং অভিনয়ের পাঠ দেওয়ার পর, ভারতীকে বাদ দেওয়া হয় এবং জুহি চাওলাকে তার জায়গায় নেওয়া হয়। অনুমান করা হয়েছিল যে ভারতীর প্রতি কুমারের অধিকারী মনোভাব এবং তার শিশুসুলভ স্বভাবই তার বাদ হওয়ার প্রধান কারণ ছিল।
এরপর দিব্যার ভাগ্যের চাকা ঘুরলো। সুযোগ এলো তেলেগু ইন্ডাস্ট্রি থেকে। তেলুগু চলচ্চিত্র প্রযোজক ডি. রামানাইডু তাকে তার ছেলে দগ্গুবাতি ভেঙ্কটেশের বিপরীতে ‘বাবলি রাজা’ ছবিতে প্রধান চরিত্রের জন্য একটা ফ্রেশ মুখ খুঁজছিলেন। তার দুজন কাস্টিং ডিরেক্টর ছিল বোম্বেতে। সেই সময় কাস্টিং ডিরেক্টরা নিজেদের লোক বিভিন্ন শহরে কলেজ, রাস্তায়, সিনেমা হলে লোক পাঠাতেন কোন সুন্দর মুখ দেখলে তাদের সঙ্গে আলাপ করতে, তাদের ছবি পাঠাতে। এইভাবেই ডি . রামানাইডু খোঁজ পান দিব্যা ভারতীর। সেই শুরু।
দিব্যাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি তার প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য অন্ধ্র প্রদেশে শুটিং শুরু করেন। ছবিটি ১৯৯০ সালের গ্রীষ্মে মুক্তি পায় এবং সুপারহিট হয়। বাবলি রাজা এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আইকনিক তেলুগু সিনেমাগুলির মধ্যে একটি। সাউথ ইন্ডাস্ট্রি পেল এক নতুন ফ্রেশ উজ্জ্বল মুখ।
সেই বছরের শেষের দিকে, ভারতী আনন্দের বিপরীতে একটি তামিল ছবি, নীলা পেন্নায় অভিনয় করেন। যদিও ছবিটি সমালোচনামূলক এবং আর্থিকভাবে ব্যর্থ হয়।
দিব্যা যখন অন্ধ্রপ্রদেশে তার সাফল্য উদযাপন করেছিলেন, তখন বলিউডের শীর্ষস্থানীয় পরিচালকরা তাকে চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ করতে আগ্রহী হলেন। ভারতীর প্রথম হিন্দি ছবি ছিল রাজীব রাইয়ের ১৯৯২ সালের ছবি “বিশ্বাত্মা”। এক সপ্তাহ পরে লরেন্স ডি’সুজার রোমান্টিক নাটক “দিল কা কেয়া কাসুর”, যেখানে তিনি পৃথ্বীর সাথে অভিনয় করেছিলেন, মুক্তি পায়। সিনেমাগুলির গান সুপার হিট হয়। অদ্ভুত কথা কি জানেন? মাত্র ৫০০ টাকা সাইনিং অ্যামাউন্ট ছিল এই ছবিগুলোর। টানাপোড়নের সেই সময় দিব্যা ভারতী নামক এক তরুণীর জীবনে এল এমন দুটি ব্রেক, যা বদলে দিল জীবনের অভিমুখ। দুটি সিনেমা “শোলা অওর শবনম” গোবিন্দার সঙ্গে আর ‘দিওয়ানা’ ঋষি কাপুরের সঙ্গে।১৯৯২ সালের মার্চ মাসে, ডেভিড ধাওয়ানের রোমান্টিক অ্যাকশন ড্রামা ছবি “শোলা অওর শবনম” মুক্তি পায়। এটি সমালোচকদের কাছে জনপ্রিয় ছিল এবং ভারতে বক্স অফিসে হিট হয়।
হিন্দি ছবিতে দিব্যার প্রথম সুপার হিট ছবি রাজ কানওয়ারের ফিল্মফেয়ার পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রেমের গল্প “দিওয়ানা”। সিনেমায় ঋষি কাপুর এবং নবাগত শাহরুখ খান দিব্যার চরিত্রের বিপরীতে দুই নায়ক ছিলেন। দিব্যা ভারতী এবং শাহরুখ খান দুজনকেই গ্রহণ করল বলিউড। ধরে নেয়া হলো নতুন এক জুটির জন্ম হয়েছে। ‘অ্যায়সি দিওয়ানগি…’ বলিপাড়ার বিখ্যাত এই গানটির অমর হয়ে রইলো সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে।
অল্প সময়ের মধ্যেই অগণিত পুরুষ হৃদয়ে ঝড় তুললেন দিব্যা ভারতী। একের পর এক সিনেমায় সাইন করতে শুরু করলেন দিব্যা। সব ঠিকঠাকই চলছিল তাহলে হঠাৎ কেন দিব্যার মনে বাসা বাঁধলো ডিপ্রেশনের?
‘শোলা অউর শবনম’-এর সেটে নায়ক গোবিন্দার সঙ্গে দেখা করতে প্রযোজক সাজিদ নাদিয়াদওয়ালার সঙ্গে আলাপ হয় দিব্যার। সেখান থেকে ভালোলাগা এবং তারপর ১৯৯২ সালের ১০ মে বিয়ে। এর ঠিক এক বছর পরেই ৫ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে মৃত্যু হয় দিব্যার।
তবে কি সাজিদের সঙ্গে বিয়ে সুখের ছিলো না দিব্যার? নিজে পছন্দেই বিয়ে করেছিল দিব্যা। নাকি দিব্যা বুঝতে পারে তাঁকে ঘিরে চক্রান্ত শুরু করা হয়েছে। তার উল্কার মতো উত্থান, তুমুল জনপ্রিয়তা অনেকের কাছেই চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। ‘সওদাগর’ সিনেমা থেকে আচমকাই তাকে বাদ দিয়ে মনীষা কৈরালাকে তার জায়গায় নেওয়া হয়েছিল।
তাই বলে মাদককে আঁকড়ে ধরবে দিব্যা?
৫ এপ্রিল ১৯৯৩। মাদ্রাজ থেকে ফিরে বিউটি পার্লার, সখান থেকে সোজা চলে আসে বান্দ্রায়। বাবা আর ভাই সেখানে অপেক্ষা করছিলো। এখানে একটি নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কিনছে দিব্যা। বুকিং করতে হবে। ‘আন্দোলন’ ছবির শুটিং চলছিল, শুটিং-এর জন্য মরিশাসে যেতে হবে। তার আগেই বুকিং করলে ফিরে এসে হাতে নতুন ফ্ল্যাটের চাবি পাওয়া যাবে। খুউব খুশি দিব্যা। সেলিব্রেট করতে হবে।
সেদিন সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ের আনধেরি পশ্চিমের ভারসোভায় অবস্থিত তুলসী বিল্ডিংয়ে দিব্যার অ্যাপার্টমেন্টে তার পোশাক ডিজাইনার নীতা লুল্লা এবং নীতা লুল্লার স্বামী ড. শ্যাম লুল্লা (যিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) এসেছিলেন। তাঁদের ড্রিংক দিচ্ছিল তার গৃহকর্মী অমৃতা। টিভিতে মুভি চলছে। দিব্যা কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই উঠে গেল ব্যালকনিতে। কয়েক মিনিট পরে একটা আর্তনাদ। ষষ্ঠতলের ব্যালকনি থেকে নিচে পড়ে গেছে দিব্যা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত। হাতে ছিল ড্রিঙ্কস।তবে কি এমন কিছু মেশান হয়েছে ড্রিংসের মধ্যে, যাতে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে দিব্যা?
এর কিছুদিন আগে সোমি আলি জানিয়েছিলে দিব্যা নাকি আন্দোলন সিনেমার সেটে ড্রাগ নিয়েছিলেন মেকআপ ভ্যানে। সেটা কি সত্যি? কিন্তু দিব্যার মা মিতা ভারতি বিশ্বাস করেননা এই কথা। তিনি বলেছিলেন যে সকালে ফ্ল্যাট বুক করে আসে সে কেন আত্মহত্যা করবে? তিনি কোনদিনই দিব্যাকে অস্বাভাবিক দেখেননি, ড্রাগসের তো প্রশ্নই নেই। তাহলে?
তার মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে মাথায় গুরুতর আঘাত এবং প্রচুর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। কেউ জানে না এটা দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা, নাকি খুন? অনেক গবেষণার পর ১৯৯৮ সালে মামলাটি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হিসেবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ক্রাইম ট্রাকের এক সাংবাদিক দিব্যার খুনের রহস্য সম্পর্কে তদন্তের কিছু এক্সক্লুসিভ তথ্য শেয়ার করে ছিলেন। ৫ ই এপ্রিল নীতা লুল্লা দিব্যাকে দিব্যার পরবর্তী সিনেমা আন্দোলনের শুটিংয়ের জন্য পোশাকের নকশা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ফোন করেন। দিব্যা তাকে তার বাড়িতে ডেকে পাঠান। রাত ৯টার দিকে নীতা লুল্লা এবং তার স্বামী আসেন। তারা দিব্যার সাথে ড্রয়িং রুমে বসেন। পোশাক এবং ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করার সময় তারাও পানীয় পান করেন। ভদকা এবং ব্ল্যাক লেবেল। দিব্যা রাম পান করছিলেন। দিব্যার কাজের মেয়ে রান্নাঘরে তাদের খাবার তৈরি করছিল। রাত ১১টার দিকে দিব্যা রান্নাঘরে যায়।
দিব্যার রান্নাঘরের জানালায় কোনও সুরক্ষা লোহার গ্রিল ছিল না। জানালার ধারটি প্রায় ১১ ইঞ্চি চওড়া ছিল। দিব্যা রান্নাঘরের দিকে মুখ করে সেখানে বসার চেষ্টা করে, কিন্তু ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং তুলসী অ্যাপার্টমেন্টের পার্কিং স্পটে পড়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত, সেদিন সেখানে কোনও গাড়ি পার্ক করা ছিল না। দিব্যা সোজা কংক্রিটের মাটিতে পড়ে যায়। তার পিঠে এবং মাথায় আঘাত লাগে। তার কাজের মেয়ে জোরে চিৎকার করে ওঠে। নীতা লুল্লা এবং তার স্বামীকে রান্নাঘরে যাওয়ার সময়, জানালার ধারে বসতে চেষ্টা করার এবং পড়ে যাওয়ার এই সময়কাল ছিলো প্রায় ৩ মিনিট। প্রতিবেশী এবং রক্ষীরাও ঘটনাস্থলে আসেন। তারা তাকে দ্রুত নিকটতম কুপার হাসপাতালে নিয়ে যান। দিব্যা গুরুতর আহত হলেও এখনও শ্বাস নিচ্ছেন। গাড়িতেও তিনি জীবিত ছিলেন। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন…. ভারসোভা পুলিশ স্টেশনে ইন্সপেক্টর জেডি যাদব মামলাটি তদন্ত করে।
দুঃখের বিষয় হল, দিব্যার মৃত্যুর এক মাস পরে দিব্যার কাজের মেয়ে হার্ট অ্যাটাকের কারণে মারা যায়।
সত্য কী? সত্য হল আমরা দৃঢ় প্রমাণ ছাড়া কাউকে অভিযুক্ত করতে পারি না। সকলের দেওয়া সাক্ষাৎকার, ম্যাগাজিনের নিবন্ধ এবং পুলিশি তদন্তের তথ্য একে অপরের সাথে মিলে যায়। অনেক সন্দেহজনক দিক রয়েছে কিন্তু দুঃখের বিষয় হল সত্য…. অনুমান আমাদের কোথাও পৌঁছায় না। তার মৃত্যু রহস্যই থেকে গেল, আর সত্যি হল সিনেমা প্রেমীরা কোনদিনই দিব্যাকে ফিরে পেলো না…।