‘দ্য সার্কেল অব ডেথ’ নামে ইংরেজিতে একটি বাক্য আছে। বাক্যটির সহজ-সাবলীল ও সুন্দর একটি বাংলা অর্থ কী হতে পারে সে বিষয়ে আমি বেশ চিন্তাভাবনা করছিলাম। বেশ কিছু প্রচলিত ও বিখ্যাত অভিধানের গলিঘুঁজি হাতড়েও যখন এর কোনো বাংলা অর্থ পেলাম না, তখন অনেক ভেবেচিন্তে এর একটি অর্থ দাঁড় করালাম। আর সেটি হলো ‘মৃত্যুর পাকদণ্ডী’। আরেকটু সহজ করে বললে বলা যায়, মৃত্যুর পাকচক্র। কিংবা মৃত্যুকূপ। যেখানে মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু ঘুরে ঘুরে মানুষটি পতিত হয় সেই মৃত্যুকূপে। বেশ কয়েক মাস ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক রাষ্ট্রের নিরীহ জনসাধারণের মৃত্যু আমাদের যেন সেই ‘দ্য সার্কেল অব ডেথ’ অর্থাৎ মৃত্যুকূপের কথাই মনে করিয়ে দেয় বারংবার, যা পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বিরাজমান ছিল বেশ কিছু ক্যারেবিয়ান, ল্যাটিন আমেরিকান কিংবা আফ্রিকান দেশে। কিন্তু সময় ও যুগের পালাবদলে সেসব দেশের চালচিত্র এখন বদলে গেছে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ও আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের দেশে এখনো রয়ে গেছে সেই পুরনো সংস্কৃতি। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন, ফুলগাজীতে নির্মমভাবে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা কিংবা মিরপুরের জঘন্য হত্যাকাণ্ড-সহ আরও অন্যান্য নৃশংস মানুষ হত্যার ঘটনা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়। যদিও ঘটনাগুলো স্থান ও সময়ভেদে ভিন্ন হলেও দেশবাসী মনে করে এগুলো সবই একই সূত্রে গাঁথা এখানে একটি কথা বলা বেশ প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি, প্রত্যেক স্বৈরশাসকেরই একটি অন্তিম ও শেষ ইচ্ছা হচ্ছে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা। আর এ জন্যই তারা জনগণের দৃষ্টিকে সব সময় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিতে উদ্ভট ও মর্মান্তিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। এটি অতিপ্রাচীন একটি কৌশল। যেমন রোমান যুগের সম্রাটরা জনগণের দৃষ্টি রাজনীতি ও ক্ষমতার মসনদ থেকে সরিয়ে রাখতে জনগণের জন্য বরাদ্দ করতেন রুটি ও সার্কাস। আর সেই সার্কাস খেলা এক সময় রূপ নেয় বন্দী যোদ্ধার গ্লাডিয়েটর খেলায়। রোমান রাজারা প্রজাদের ব্যস্ত রাখতেন নানাবিধ আমোদ-প্রমোদে। আবার অনেক স্বৈরশাসক বেছে নিতেন ভিন্ন কোনো কৌশল। যেমন তারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেন লেখক, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের মতবাদ ও দর্শনকে। রাজনীতি বিশ্লেষক ও দার্শনিকরা মনে করেন ইতিহাসের এটা একটা প্যাটার্ন যা পুনরাবৃত্তি হতে থাকে বার বার। দার্শনিক হেগেলের মতে সব বড় ঘটনাই পৃথিবীতে নিদেনপক্ষে দুইবার সংঘটিত হয়। কার্ল মার্কস অবশ্য হেগেলেরই এই দর্শনটিকে সমর্থন করে আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, প্রথমবারের পুনরাবৃত্তি হয় মর্মান্তিক এবং পরের বার সেটির হয় প্রচণ্ড বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তি ও পৃথিবীর মানুষের জন্য একটি প্রহসনমূলক ঘটনা। প্রহসনমূলক এই জন্য যে, তারা আগের ঘটনা থেকে কিছুই শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি।
এ বিষয়গুলো নিয়ে পরে অবশ্য আলোচনা করা যাবে। এখন একটু অন্য প্রসঙ্গে দু’চার কথা বলি। জনৈক পাঠক একদিন আমাকে বললেন, এই যে আপনারা পত্রিকায় ক্রমাগত লিখে চলেছেন কিংবা টক-শোগুলোতে নানা বিষয়ে বক্তব্য রেখেই যাচ্ছেন, তাতে লাভ কী? কেউ তো আপনাদের কথা শুনছে না। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সরকার। আমি বললাম, আমাদের কথা যদি রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা না শোনেন তাহলে আমরা কিইবা করতে পারি? আমাদের লেখার মাধ্যমে আমরা শুধু সরকারকে সতর্ক ও দেশের জনগণকে সচেতন করতে পারি মাত্র। এখানে আমি ছোট্ট একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। পাঠকদের বিষয়টি জানা আছে কিনা জানি না। ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল রাতে সেই সময়ের পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক জাহাজ টাইটানিক হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে গিয়ে প্রাণহানি ঘটে দুই সহস্রাধিক মানুষের। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, ভুবনখ্যাত সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি সেদিন ঘটতই না যদি জাহাজের ক্যাপ্টেন স্মিথ সামান্যতমও সতর্ক হতেন। কারণ জাহাজের গতিপথে হিমশৈলের সম্ভাব্য উপস্থিতির কথা টাইটানিকের ক্যাপ্টেন স্মিথ খুব ভালো করেই জানতেন। আনুমানিক রাত ১০টা থেকেই আটলান্টিকে চলমান অন্যান্য জাহাজ থেকে একের পর এক সতর্কবার্তা পাচ্ছিলেন তিনি, যাতে করে অন্যান্য জাহাজের মতো টাইটানিকও এই হিমশৈলীবহুল এলাকাটি যেন ধীরে-সুস্থে ও সতর্কতার সঙ্গে পার হতে পারে। হিমতুষারের শেষ সতর্কবাণী টাইটানিক পায় আনুমানিক রাত ১টায় ক্যালিফোর্নিয়ান জাহাজের ক্যাপ্টেন স্টানলি লর্ডের কাছ থেকে। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পর ঘুরেফিরে একটি প্রশ্ন বার বার এসেছে। সাগরের মাঝখানে বরফের পুরু পুরু স্তূপ আছে জেনেও ক্যাপ্টেন স্মিথ জাহাজের গতিপথ কমালেন না কেন? এর উত্তর তিনি নিজেই মৃত্যুর বেশ কিছুকাল আগে একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে দিয়েছিলেন। ‘আমি এমন কোনো পরিস্থিতির কথা স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারি না, যেখানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও আধুনিক জাহাজ টাইটানিক ডুবে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে।’ অর্থাৎ জাহাজ পরিচালক ক্যাপ্টেন স্মিথ অতিমাত্রায় আত্দবিশ্বাসী ছিলেন বলেই পরপর সাত সাতটি সতর্কবাণীর কোনো পাত্তা না দিয়ে অসংখ্য নিরীহ লোকের জীবনহানি ঘটানোর কারণ হয়ে রইলেন ইতিহাসে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে_ ‘পাপ ছাড়ে না বাপকে’
তার দুয়েকজন সতীর্থ তার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বললেন, ক্যাপ্টেন স্মিথ জাহাজটি কিন্তু চালিয়েছিলেন নিয়ম অনুযায়ীই। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের প্রচলিত নৌ আইন অনুযায়ী। সে সময়ের নৌ আইনে লেখা ছিল ‘ওইসব বরফ অধ্যুষিত অঞ্চলে খুব সতর্ক দৃষ্টি রেখে জাহাজ চালানো যেতে পারে গতি না কমিয়েই।’আইনের ফাঁক গলে যদিও ক্যাপ্টেন স্মিথ পার পেলেন কিন্তু তিনি পার পেলেন না ইতিহাস থেকে। টাইটানিক জাহাজটি ডুবে যাওয়ার পর মনে হয় এ পর্যন্ত শত-সহস কলাম, প্রবন্ধ কিংবা নিবন্ধ লেখা হয়েছে। লেখা হয়েছে প্রায় ২ শতাধিক বই। সর্বত্র ক্যাপ্টেন স্মিথকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে। ইতিহাসে তিনি স্থান পেয়েছেন কালের এক খলনায়ক কিংবা ভিলেন হিসেবে।
আমরা সব সময়ই রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য লিখি। এক সময় দেশের জনগণ সজাগ ও সচেতন হলে সরকারও বাধ্য হবে জনগণের কথামতো দেশ পরিচালনা করতে। বিশেষ করে সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এভাবেই জনসচেতনতা গড়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে সরকার ও রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা সাধারণত লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শগুলো আমলে নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।
আরেকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি : আমার এই দৃষ্টান্তটিও টাইটানিককে ঘিরেই। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সংবাদপত্রগুলোর আর্কাইভগুলো ঘাঁটলেই চোখে পড়বে সেই সময়ের পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়েছিল শত-সহস সংবাদ, কলাম প্রবন্ধ কিংবা উপ-সম্পাদকীয়। কিন্তু সব জিনিসেরই একটি পরিসমাপ্তি আছে। আর টাইটানিকের উত্তেজনাও অনেকটা কমে আসে ১৯১২ সালের মে মাস নাগাদ। যখন এক সময় খবরের কাগজের লেখক ও প্রাবন্ধিকদের দম ফুরিয়ে এলো তখন হাতে কলম তুলে নিলেন কিছু প্রথিতযশা সাহিত্যিক। হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন এটি তারা চিন্তাও করতে পারলেন না। বিখ্যাত নোবেল জয়ী সাহিত্যিক ও নাট্যকার জর্জ বার্নার্ডশ ‘ডেইলি নিউজ এন্ড লিডার’ নামক একটি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেন। ছাপার অক্ষরে সেটি প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালের ১৪ মে। এর ফলে সে যুগের আরেক দিকপাল সাহিত্যিক ও বিশ্ববিখ্যাত চরিত্র শার্লক হোমসের জন্মদাতা আর্থার কনান ডয়েলের সঙ্গে লেগে যায় কলমযুদ্ধ। বার্নার্ডশ তার লিখিত প্রবন্ধটির নাম দিয়েছিলেন_ ‘কিছু অকথিত নীতিকথা’। তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের খবরের কাগজ ও জনসাধারণকে ট্র্যাজেডির সঠিক কারণ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য দোষারোপ করলেন। তাদের দু’জনের মধ্যকার সেই বাগ্যুদ্ধ দেখার বিষয়ই ছিল বটে। বার্নার্ডশ ও ডয়েল একজন আরেকজনকে এই বলে দোষারোপ করতে থাকেন যে, দু’জনের কারও লেখাতেই নাকি সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দোষগুলো পর্যাপ্ত রূঢ়, কঠোর ও কঠিন ভাষায় উঠে আসেনি। তাদের মধ্যে এই বাগ্যুদ্ধ চলল বেশ কিছুদিন ধরে। উপভোগ্যময় এই তর্কযুদ্ধ থেকে ইংল্যান্ডের জনগণও বুঝতে পারলেন যে, সরকার ও বিশেষ মহলের ভুলগুলো আসলে কি ও কোথায় হয়েছে। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয় ২ মে ১৯১২ সালে। কিন্তু অনুসন্ধান কাজ এগুতে থাকে ঢিমেতালে। ব্রিটিশ সরকার যখন উপলব্ধি করে যে, লেখক-সাহিত্যিকদের লিখনীর মাধ্যমে যে জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে এবং যেভাবে জনউষ্মা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে জনগণ, সরকারের কোনো গাফিলতিই সহ্য করবে না। জনগণের চাপের মুখে অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ১৯১২ সালের ৩০ জুলাই অনুসন্ধান রিপোর্টটি প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। আর সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে নৌ আইনের ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন ঘটে। আরেকটি ঘটনা পাঠকদের সামনে ছোট্ট করে উপস্থাপন করতে চাই। আর সেটি হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল এবং রাশিয়ার হুমকির মুখে সেটি মার্কিনীরা তা প্রত্যাহার করে নেয়। রাশিয়ার হুমকি হয়তোবা অন্যতম কারণ ছিল। কিন্তু শুধু হুমকিটি একমাত্র কারণ নয়। সে সময় আমেরিকায় বিখ্যাত কালজয়ী কবি এলেন গিন্সবার্গের নেতৃত্বে একদল লেখক-সাহিত্যিক সোচ্চার ও প্রতিবাদী কণ্ঠে, কঠোর সমালোচনা করেছিলেন মার্কিন ভূমিকার। আর সেটিও একটি কারণ ছিল সপ্তম নৌবহর প্রত্যাহার করে নেওয়ার। শুধু এলেন গিন্সবার্গের মতো কবি-সাহিত্যিকরাই লিখতে পারেন এমন কবিতা — ‘‘America go and fuck with your atom bomb”। আমরা এ ধরনের কবিতা লিখলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আমাদের ক’মাসের জেল-জরিমানা হতো কে জানে? এবার বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যায়। ৫ জানুয়ারি একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে নির্বাচন সম্পর্কে দেশবাসী নিশ্চয়ই অবগত আছেন এবং এ নিয়ে আমি আর কোনো কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আমার ভয় হয়, বর্তমান সরকার যেভাবে ক্ষমতায় আছে পাঁচ, দশ কিংবা একযুগ পরে হলেও যদি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে তাহলে বিএনপিও হয়তো আওয়ামী লীগের পদাঙ্কই অনুসরণ করে ২০-২৫ বছরেও ক্ষমতা ছাড়বে না। আর ক্ষমতায় যে কিভাবে আঁকড়ে থাকতে হয় বিএনপিকে সেটা আওয়ামী লীগ ভালো করেই শিখিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কেন গণতন্ত্রের প্রতি এতটা উদাসীন আচরণ করছে। আমাকে যদি কেউ এ প্রশ্ন করে তাহলে আমি বলব দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের দূরদৃষ্টির অভাব। আজ যদি তারা এটা মনে করে যে, সুষ্ঠু ও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না দিয়ে তারা লাভবান হয়েছে আমি মনে করি তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আসলে লাভের লাভ কিছুই হবে না। আওয়ামী লীগ আজ যে দৃষ্টান্ত রেখে যাবে পরবর্তী সরকার হয়তো নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সেটিই অনুসরণ করবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বাংলাদেশের কেউই এটা বুঝতে চায় না যে, পৃথিবীর কোনো স্বৈরশাসকই আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি এবং পারবেও না। এখানে আমি তারই একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। দৃষ্টান্তটি অবশ্য আমাদের বড় দুই দলের উদ্দেশ্যেই। আমি আজ এমন এক স্বৈরশাসকের কাহিনী শুনাচ্ছি, যিনি আমেরিকা মহাদেশের ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ডোমেনিক্যান রিপাবলিক নামক একটি দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। নাম রাফায়েল লিওনাইডাস ত্রোহিও (rafael leónidas trujillo molina)। সংক্ষেপে ডোমেনিকার জনগণ তাকে ডাকত জেনারেল ত্রোহিও নামে ডাকতো। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯১ সালে এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ১৯৩০ সালে। জেনারেল ত্রোহিও শুধু ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্তই নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কিন্তু এরপরের প্রায় ২০-২২ বছর ১৯৬১ সালে আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি অনির্বাচিত ও স্বৈরতান্ত্রিকভাবেই দেশ শাসন করেছিলেন।
তার দেশ চালানোর পদ্ধতিটি এতটাই অদ্ভুত ছিল যে, পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয় জেনারেল ত্রোহিও’র রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশলগুলো। কারণ জেনারেল ত্রোহিও ক্ষমতায় থাকার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি করতে প্রস্তুত ছিলেন না। যেমন : তার বিরুদ্ধে যদি কেউ বিদ্রোহ করত অমনি তাকে ধরে এনে গুম কিংবা খুন করে দেওয়া হতো। তার ২২ বছর শাসনামলে শুধু সরকারি হিসাব মতেই তার হাতে খুন হয়েছিল ৫০ হাজারের অধিক নিরীহ মানুষ। অন্যদিকে যদি কোনো সংবাদপত্র তার বিরুদ্ধে কিছু লিখত তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে সেই সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হতো। কোথাও দুর্ভিক্ষ হচ্ছে, মানুষ খেতে পাচ্ছে না অমনি সরকারি খাদ্যগুদাম খুলে দাও যাতে মানুষ বিদ্রোহ না করে। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি তার ক্ষমতা ছাড়বেন না কিংবা নির্বাচন ও গণতন্ত্র দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেমন — আমেরিকা, স্পেন, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া-সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ যখন ডোমেনিক্যান দেশটিতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্রের জন্য চাপ দিতে থাকে। তখন তিনি স্পেনের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কো, আর্জেন্টিনার পেরন ও নিকারাগুয়ার সমোজাদের মতো মানুষকে অনেক মূল্যবান উপঢৌকন পাঠিয়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলও হন। তার বিরুদ্ধে আমেরিকার অনেক সিনেটর যখন মানবাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ তুলেন তখন নাকি তিনি তার বিশেষ দূত মারফত সেই সিনেটরদের উৎকোচ হিসেবে শত-সহস্র একর ইক্ষু খেত দিতে চেয়েছিলেন। পক্ষান্তরে ডোমেনিক্যান জনগণ কায়মনোবাক্যে চাচ্ছিলেন একটি গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন। ডোমেনিক্যার আপামর জনগণ যখন উত্তাল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন কি মর্মান্তিকভাবে সেই বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল তার ইতিহাস পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে বলে একটা কথা আছে — অবশেষে জনগণকে কিছুই করতে হয়নি। জেনারেল ত্রোহিও ও তার কাছের সাঙ্গোপাঙ্গরা গড়ে তুলেছিলেন দুর্নীতি ও অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল সম্পদের পাহাড়। আর তার ভাগবোটোয়ারা নিয়ে তৈরি হলো ব্যাপক দ্বন্দ্ব। তার অতি কাছের কয়েকজন যেমন — জেনারেল ডিয়াস, জেনারেল লা মাজা প্রমুখ ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ১৯৬১ সালের ৩০ মে গুপ্তঘাতকের গুলির আঘাতে নির্মমভাবে নিহত হলেন ত্রোহিও। শুধু ক্যারিবিয়ান অঞ্চলটিতেই নয় — জেনারেল ত্রোহিও’র স্বৈরশাসনের ইতিহাস আমেরিকার দুই মহাদেশেই ব্যাপকভাবে বিদিত ও সেই সঙ্গে মারাত্দকভাবে ঘৃণিত।
লেখক : গল্পকার ও বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী