শনিবার | ২৬শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | রাত ৩:৪৬
Logo
এই মুহূর্তে ::
বাবু-ইংরেজি আর সাহেবি বাংলা : মাহবুব আলম সিন্ধুসভ্যতার ফলক ও সিলে হরিণের শিং-বিশিষ্ট ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি : অসিত দাস বৈশাখ মাসে কৃষ্ণপক্ষে শ্রীশ্রীবরুথিনী একাদশীর ব্রতকথা মাহাত্ম্য : রিঙ্কি সামন্ত সিন্ধুসভ্যতার লিপি যে প্রোটোদ্রাবিড়ীয়, তার অকাট্য প্রমাণ : অসিত দাস বাঙালির মায়াকাজল সোনার কেল্লা : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী ট্যাটু এখন ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ : রিঙ্কি সামন্ত ফের আমেদাবাদে হিন্দুত্ববাদীদের অন্য ধর্মের উপর হামলা : তপন মল্লিক চৌধুরী লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য ও তাঁর চিঠি : দিলীপ মজুমদার নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ : শিবরাম চক্রবর্তী নববর্ষ গ্রাম থেকে নগরে : শিহাব শাহরিয়ার ফিরে আসছে কলের গান : ফজলুল কবির সিন্ধুসভ্যতার ফলকে খোদিত ইউনিকর্ন আসলে একশৃঙ্গ হরিণ : অসিত দাস একটু রসুন, রসুনের কথা শুনুন : রিঙ্কি সামন্ত ১২ বছর পর আরামবাগে শোলার মালা পরিয়ে বন্ধুত্বের সয়লা উৎসব জমজমাট : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কোনিয়াকদের সঙ্গে দু’দিন : নন্দিনী অধিকারী স্বচ্ছ মসলিনের অধরা ব্যুৎপত্তি : অসিত দাস বাড়বে গরম, চোখের নানান সমস্যা থেকে সাবধান : ডা. তনুশ্রী চক্রবর্তী আঠালো মাটি ফুঁড়ে জন্মানো শৈশব : আনন্দগোপাল হালদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত ওয়াকফ হিংসার জের কি মুর্শিদাবাদেই থেমে গিয়েছে : তপন মল্লিক চৌধুরী এক বাগদি মেয়ের লড়াই : দিলীপ মজুমদার এই সেনসরশিপের পিছনে কি মতাদর্শ থাকতে পারে : কল্পনা পাণ্ডে শিব কম্যুনিস্ট, বিষ্ণু ক্যাপিটেলিস্ট : জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গায়ন’ থেকেই গাজন শব্দের সৃষ্টি : অসিত দাস কালাপুষ্প : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হোক বাঙালি-অস্মিতার প্রচারযাত্রা : দিলীপ মজুমদার মাইহার ঘরানার সম্রাট আলি আকবর খান (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত পেজফোর-এর নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা ১৪৩২ প্রকাশিত হল সিন্ধিভাষায় দ্রাবিড় শব্দের ব্যবহার : অসিত দাস সিন্ধুসভ্যতার জীবজগতের গতিপ্রকৃতির মোটিফ : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

আড্ডার স্বদেশ বিদেশ, কালচারটা পুরনো হলেও এখনও বেশ শক্তপোক্ত : রিঙ্কি সামন্ত

রিঙ্কি সামন্ত / ৪৬৮ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

মাছ ভাত রসগোল্লা আর আড্ডা… এই চারটি জিনিসের ব্যাপারে বাঙ্গালি জনপ্রিয়। ডায়েট কন্ট্রোল বাঙালি করতেই পারে কিন্ত আড্ডার আমেজ বাঙালির কখনো পাল্টায় না। সামাজিক রাজনৈতিক পেশাগত এমনকি ধর্মীয় কারণেও একত্রিত হলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে স্বল্প অবসরে আড্ডা জমানো চাই। তবে আড্ডাবাজ বলে বদনাম দিলে চলবে না, বাঙালির অধিকাংশ আড্ডাই সৃজনশীল চিন্তার উৎস। আড্ডাই হল এমন এক জায়গা যেখানে দর্শন, রাজনীতি থেকে শুরু করে খেলাধুলা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সামাজিক, কাজকর্ম সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয়।

অতএব বাঙালি যেখানেই আছে, সেখানেই আড্ডার আসর জমাবে বলে ধরে নেওয়া যায়। কখনো চায়ের ভাঁড়ে তুফান তুলে কিংবা রোয়াকে বসে কিংবা পাড়ার মোড়ে, বাসে ট্রামে ট্রেনে যেখানে হোক অনায়াসে বাঙালি আড্ডাখানা বসাতে পারে। আজ লেখার আড্ডায় তারই কিছু গল্প….

আড্ডখানা বলতেই প্রথমেই যার নাম আসে সেটা হল ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা।’ কলকাতার কফি হাউজ হলো সৃষ্টিশীল মানুষের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। বিখ্যাত কবি, লেখক, চিত্রশিল্পীরা কফি হাউসে আগেও আড্ডা দিতেন আজও দেন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ও শান্তিনিকেতন ছিলো আড্ডার জন্য বিখ্যাত। কবি লেখক ভক্তদের নিয়ে নিয়মিত আড্ডা দিতেন রবীন্দ্রনাথ। নজরুল আড্ডা দিতেন ঘুরে ঘুরে একেক দিন এক এক জায়গায়। কবি সুকুমার রায়ের মনডা ক্লাব, রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রা বা তার আগের সঙ্গীত সমাজ থেকে তাদের আড্ডা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। বিচিত্রায় কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও অংশগ্রহণ করতেন বলে জানা যায়।

শুধু পুরুষ নয়, উনিশ শতকে পুরনো দিনের মেয়েদের আড্ডা কেমন ছিল তা জানা যায় বঙ্কিমচন্দ্রের সমস্ত সামাজিক উপন্যাসে। দুপুরে বিরাট খাটে একান্নবর্তী পরিবারের বড় গিন্নি মেজগিন্নি সেজগিন্নি ছোটগিন্নিরা একত্রিত হয়ে খোস মেজাজে গল্প-সল্প করতেন। সঙ্গে থাকতো পান সুপুরি তাসের প্যাকেট সেলাইয়ের সরঞ্জাম।

বাড়ির শিল্প অনুরাগী পুরুষদের খোলামেলা সংস্পর্শে এসে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে শুরু হয়েছিল শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা। ‘ঠাকুরবাড়ি অন্দরমহলে’-র লেখিকা চিত্রা দেব বলেন, ‘ঠাকুরবাড়ির এই অলসবিলাসের আড্ডা কিন্তু ব্যতিক্রম হয়ে রইল। গ্রাম বাংলার প্রকৃত জীবনের নারী সমাজের আড্ডা তখনো চলেছে একেবারে সনাতন বঙ্কিম উপন্যাসের ছ’কে।’ বিকাল বেলায় নাপতানি আসতো বাড়ির মেয়েদের চুল বাঁধতে, আলতা পড়াতে — তখনো মেয়েরা এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে আড্ডা মারতে শেখেনি। নাপতানি আর দাসীদের মুখে শুনে তারা অন্যের বাড়ির হাড়ির খবর জানতেন। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেলে সন্ধ্যা দেবার আগে আড্ডা শেষ হতো।

কলেজ স্ট্রিটের এক বিখ্যাত প্রকাশনার ঘরে তখন জমিয়ে বসতো আড্ডার আসর। সেখানে নিয়মিত থাকতেন গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সুমথনাথ ঘোষ, প্রমথনাথ বিশী, কালিদাস রায় ও সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মতো দিকপালেরা। আর আলোচনার সঙ্গে মুখ না চললে তো ব্যাপারটা ঠিক জমে না। তাই খবরের কাগজে ঢালা হত মুড়ি আর ডালমুট। সুনীতি বাবু মজা করে এই আড্ডার আসরের নামই দিয়ে বসলেন ‘মুড়ি ক্লাব।’

মোহনবাগানিদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত হলো ক্লাবের লন আর সেখানে রাত আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত ডিমের ডেভিল সহযোগে চলত বিকেলের আড্ডা। এছাড়া আড্ডায় নিয়মিত বিখ্যাত ছিল দিলীপ ধরের ঘুগনি। দু-ডেকচি ঘুগনি আর আলুর দম দিয়ে বিকালের চারটে বাজতে না বাজতেই দিলীপ বাবু গ্যালারির নিচে হাজির। সন্ধে ছটায় তলানিও পাওয়া যেত না। সেকালে বেঞ্চের উপর বসেই ফুটবলের নানান বিষয়ে আড্ডা দিতেন শৈলেন মান্না, উমাপতি কুমাররা ।

লিন্ডসে স্ট্রিট যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে ঝুলন সেনগুপ্তের এক চিলতে ছোট্ট দর্জির দোকানে আড্ডা জমাতেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় সুব্রত ভট্টাচার্য, গৌতম সরকাররা। আর ইস্টবেঙ্গলী কর্তাদের এমনই আড্ডার আসর ছিল হাইকোর্ট পাড়ার একটি রেস্তোরায়। স্ট্যান্ড রোডে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকের শাখার কাছে একটি বটগাছ ছিল। তার তলাতেই আড্ডা দিতেন ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, সুব্রত ভট্টাচার্য্য, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরজিৎ সেনগুপ্তরা। তবে মোহন-ইস্ট খেলার আগে তাদের টিকিও পাওয়া যেত না কারণ অবশ্যই – ভক্তরা, দেখা হলেই আসবে টিকিটের আবদার।

বাংলাদেশের আড্ডার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনও খুব বিখ্যাত। ১৯৫২ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন। তৎকালীন সৃজনশীল কবি শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী ছাত্রদলের আড্ডার জায়গা শুধু নয়, বড় বড় সিদ্ধান্ত আন্দোলন সব কিছুই এই মধুর ক্যান্টিনকে ঘিরে। এক কথায় বলা যায় স্বাধীনতার পরবর্তীকালে মধুর ক্যান্টিন ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আঁতুড়ঘর।

কবি গালিবের আড্ডার কথা তো অনেকেরই জানা। গালিব বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াকে মনে করতেন “আত্মার খোরাক”। কবি ও ভারতবর্ষের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারে গালিব ও সভাকবি-সহ যে আড্ডা জমতো তা সাহিত্যের ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

শুধু বাঙালি নয়, আড্ডা প্রবণ জাতি হিসেবে গ্রিকদেরও নাম আছে। আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে মহাজ্ঞানী সক্রেটিস তার শিষ্যদের নিয়ে কোন এক জলপাই গাছের নিচে আড্ডা দিতেন। মনে করা হয় সক্রেটিস ছিলেন আড্ডার আদি পিতা। তার আড্ডায় জন্ম হয়েছিল দার্শনিক প্লেটোর। প্লেটো, দিদো এবং উৎসাহী যুবকেরা এইসব আড্ডায় শামিল হতো। পবিত্রতা কাকে বলে, জ্ঞান কি ,মানুষের মূল কাজ কি, ঈশ্বরের ধারণা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চলতো তর্ক বা আড্ডা। পরে প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল, অ্যারিস্টটলের শিষ্য দ্বিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার পর্যন্ত এই আড্ডার অংশীদার ছিলেন। জেলের মধ্যে আড্ডা দিতে দিতেই হেমলকের বিষে সক্রেটিসের শরীর পাথর হয়ে যায়। গ্রিকেদের আড্ডা কিন্তু এখনো থেমে নেই। গ্রিসের কবি ও সাহিত্যিকরা এখনো আড্ডা দেন বিভিন্ন ক্যাফেতে।

মিশরের নাগিব মাহফুজ তো আড্ডা দেওয়ার জন্যই বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে পর্যন্ত ক্যাফেতে আড্ডা দিতেন এবং সেটি এখনও ক্যাফের মালিক সংরক্ষণ করে রেখেছেন। বিখ্যাত তাত্ত্বিক লেখক সেরগেই সুইস বোর্হেস অন্ধ হওয়ার পরও পায়ে হেঁটে আড্ডা দিতে যেতেন একটি নির্দিষ্ট ক্যাফেতে।

লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ছিলেন একজন নামকরা আড্ডাবাজ। তিনি নিয়মিত কলম্বিয়াতে একটি নির্দিষ্ট হস্টেলে তার পুরনো বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতেন। বিশ-শতকের বিখ্যাত ফরাসি লেখক, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন। আড্ডা থেকে বাড়ি ফেরার পথের নির্জনতা তাকে দিয়েছে অনেক অমর পংক্তি।

আড্ডা গল্পগুজব পিএনপিসি চ্যাটিং সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এসএমএস… কলিযুগে বহু নতুন অবতারের আবির্ভাব হয়েছে। তবে বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম সময় কাটানোর মাধ্যম সেই আড্ডাই। আমাদের আড্ডার কালচারটা পুরনো হলেও বেশ শক্তপোক্ত সময় যাঁতাকলে পড়ে হয়তো একটু টাল খেয়েছে বা মোচকেছে কিন্তু এই আড্ডা শেষ হওয়ার নয়। বাঙালি যতদিন বেঁচে থাকবে বাঙ্গালীদের সৃজনশীল আড্ডাও ততদিন বেঁচে থাকবে।।

তথ্য সূত্র: ‘ঠাকুরবাড়ি অন্দরমহলে’ — চিত্রা দেব, কালীপদ চক্রবর্তি, কলকাতার আড্ডা — সমরেন্দ্র দাস ও অন্যান্য।


আপনার মতামত লিখুন :

6 responses to “আড্ডার স্বদেশ বিদেশ, কালচারটা পুরনো হলেও এখনও বেশ শক্তপোক্ত : রিঙ্কি সামন্ত”

  1. Amar Nath Banerjee says:

    বাড়ির বাইরে বিরাট রোয়াক ছিল। সেখানেই আড্ডা চলতো।

  2. শুভাশিস ঘোষ says:

    বাহ! খুব ভালো লাগল। চমৎকার লেখা।

  3. মনোজ ভট্টাচার্য্য says:

    খুব খুশি হলাম আপনাদের আড্ডার কলমে আড্ডা দিতে পেরে এবং সমৃদ্ধও হলাম। আগামীদিনের আরও , আশায় রইলাম।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন