মহাশক্তির রূপ দেবী কালিকা বিশ্বপ্রসবিনী। তন্ত্র সাধনার প্রধান দেবী। তন্ত্র ও পুরাণে দেবী কালিকার একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। ধর্ম রক্ষা ও অসুরদের সংহারের জন্য মা কালীর আগমন এই ধরাধামে। বহুরূপে নানান মন্দিরে পূজিতা হন দেবী।
দক্ষিণাকালী রূপে মা পূজিতা হন পাণ্ডুয়ার সিমলাগড় কালীবাড়িতে।
প্রায় আটশো বছর আগের কথা। হরিহরপুরে তালপাতার ছাউনি ঘেরা এক মাটির মন্দির ছিলো শ্মশানে । সেখানে স্থাপিত ছিলো এক অখ্যাত মৃন্ময়ী কালিমূর্তি। শ্মশানে থাকার জন্য লোকে বলতো শ্মশানে কালী। পাশে ছিলো একটি পুকুর। এক কাপালিক এখানে তন্ত্র সাধনা করতেন পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে।
কালের চক্রে পরিবর্তন হতে থাকে সবকিছুরই। হরিহরপুরের নাম পাল্টে হয় সিমলাগড়, তালপাতার কুটিরের মৃন্ময়ী মূর্তি পরিবর্তিত হয়ে যায় হয় পাকা মন্দিরের কষ্টি পাথরের মূর্তিতে।
শের শাহ বাংলা থেকে নিজের মাতৃভূমি আফগানিস্তান পর্যন্ত তৈরি করলেন ভারতের দীর্ঘতম সড়ক-ই-আজম বা বাদশাহী সড়ক—গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। জঙ্গলে ঘেরা শ্মশানের চেহারা পাল্টে তৈরি হয় জনবসতি। শ্মশান সরে যায় দূরে।
হুগলী জেলা একসময় ছিলো ডাকাতের জন্য কুখ্যাত।
গঙ্গা নদীর ধারে থাকার দরুণ নৌকা নিয়ে ডাকাতি হওয়ার সুযোগ ছিলো। “মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কানে গোঁজা জবা ফুল … হা রে রে রে ডাকাত এলো রে তেড়ে”… বঙ্কিমচন্দ্রের সেই কালাদিঘির ডাকাতদের গল্প মনে করিয়ে দেয় বলাগড়ের ডাকাতদের কথা। ঊনবিংশ শতকের প্রথমের দিকে বিশ্বনাথ রায় নামে এক ব্যক্তি নৌ ডাকাতির জন্য “বিশে ডাকাত” নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ডাকাত হলেও বিশ্বনাথ বাবু ছিলেন রীতিমতো সুপুরুষ। শোনা যায়, সেইসময় নদীমাতৃক বঙ্গে তার গতিবিধি ছিলো সর্বত্র। বিশে ডাকাতের নাম শুনলে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ভয়ে কাঁপতে থাকতো। ডাকাতি করার আগেই খবর দিতেন। এইসব নিয়ে নানা গল্পও প্রচলিত আছে।
অত্যাচারী জমিদারদের শায়েস্তা করতে তিনি ডাকাত দল তৈরি করে ডাকাতি করতেন। তাকে ধরার জন্য ইংরেজরা নানা ধরনের ফাঁদ পেতেছিল কিন্তু তাৎক্ষণিক বুদ্ধির কৌশলে ডাকাত রয়ে যায় অধরা।
অবশেষে ১৮১৮ সালে ডাকাতি করার সময় পুলিশের জালে ধরা পরে যায় বিশে ডাকাত। হুগলী জেলায় তার ফাঁসি হয়। ১৮১৯ সালে ‘সমাচার দর্পণ’-এ এই বিষয়ে এক বিশাল খবর প্রকাশিত হয়।
শোনা যায়, বিশে ডাকাত সিমলাগড় কালীবাড়িতে মায়ের পুজো দিয়ে রওনা হতো ডাকাতি করতে। সেই সময় নরবলিও দেওয়া হতো। ডাকাতদের পুজো করার জন্য “ডাকাত কালী” নামেও পরিচিত হয়ে ওঠে মা কালী এখানে। বিশে ডাকাতের সময় মায়ের ভোগের ছাগ মাংস রান্না করা হতো পিয়াঁজ, রসুন ব্যতীত গোলমরিচ আর ঘি দিয়ে। গ্রামের বাসিন্দাদের পাত পেরে খাওয়াতেন বিশে ডাকাত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে পরিবর্তন হতে থাকে পরিস্থিতি। সৈন্য চলাচল বাড়তে শুরু করার ফলে এলাকার সাধারণ মানুষজন মন্দিরে পুজো দেওয়া শুরু করে। ভক্ত সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মন্দিরের সংস্কার শুরু হয়। লক্ষণ ভট্টাচার্যের আদি পুরুষের সময় থেকে সিমলাগড় কালীবাড়িতে পুজো শুরু হয়। এই পরিবারের এক তান্ত্রিক একবার তন্ত্রসাধনা করতে এসে নরমুন্ড দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকেই নরবলি বন্ধ হয়ে যায়, ছাগ বলি চালু থাকে। আজো নাট মন্দিরে রাখা হাড়িকাঠ সেই প্রমাণের দলিল।
কালী পুজোয় মাছ-সহ ১০৮ রকমের ভোগ দেওয়া হয়। দীপান্বিতা অমাবস্যায় বিশেষ পুজো হয়। পয়লা বৈশাখে প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে। প্রতিবছর কালীপুজোর আগে পঞ্চমুন্ডির আসনে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণাকালী মূর্তি রং করা হয়। স্থানীয় মানুষজন বিশ্বাস করেন মন্দিরের মধ্যে গাছে সুতো, মাটির মূর্তি বেঁধে মানত করলে মনস্কাম পূর্ন হয়। নিত্য পুজো ছাড়াও মাকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করতে আসেন অনেকেই। উপনয়ন, নতুন গাড়ীর পুজো ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিত্য এখানে হয়ে থাকে। নানান অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী এখানকার সেবাইতগণ।
কলকাতা থেকে বর্ধমান যাওয়ার সড়কপথে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি দর্শন করে গেছেন মা’কে। সত্যজিৎ রায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। দিনবদলের সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে সিমলাগড়ের আশপাশ। রাস্তার একধারে মন্দির অপরদিকে সারি দেওয়া পুজোর সামগ্রী কেনার দোকান। দুবেলা মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে ভক্তদের সমাগমে।
আমরা সহজ পথে চলার চেষ্টা করি। ভক্তির পথ তাই বিশ্বাসের পথ, সমর্পণের পথ।পাণ্ডুয়ার জি টি রোডের ধার ঘেঁষে বহুপ্রাচীন এই কালীমন্দির দর্শন আপনাকে এক দিব্যি শান্তির পরশ অনুভব করাবে।।
“—সত্য তুমি মৃত্যুরূপা কালী সুখ বনমালী তোমার মায়ার ছায়া।/করালিনী কর মর্মচ্ছেদ, হোক মায়াভেদ, সুখ স্বপ্নে দেহে দয়া।।”
তথ্যসূত্র : হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গ সমাজ—সুধীর কুমার মিত্র এবং সম্পর্কিত অন্যান্য বই।
Joy MA kali
Simlagor bohubar jawa hoyeche bote.ekhon ei itihas sonar por aro besi kore valolaga toiri holo.besh sihoron jagche.🙏
জয়মা। খুব ভালো। কয়েক বার মাকে দর্শন করেছি।
লেখনী থেকেই মায়ের দর্শন পেলাম, ভীষণ ভালো লাগলো।
সকলকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ🌹🌹🌹🌹
নমস্কার,
আমার নাম রাজাবালা, আমি হুগলি জেলার পান্ডুয়া তে বসবাস করি, আমি কল্যাণী ইউনিভার্সিটি তে পড়ে আমার একটি রিসার্চ পেপার আছে যেখানে আমি সিমলাগড় কালী মন্দির নিয়ে লিখতে আছে, আমার সেই বিষয় জানার জন্য আপনার এই পেজটি আমি পেয়েছি গুগল থেকে আমি আরো কিছু বইয়ের খোঁজ করছি আপনি যদি একটু বলে দেন আমার খুব ভালো হতো।
অসাধারণ একটি তথ্যসমৃদ্ধ রচনা। সত্যি নিজের জেলা সম্পর্কে জানতে পেরে আমি সমৃদ্ধ হলাম আপনার লেখায়। যেমন আপনি সুন্দর তেমনি আপনার লেখা সুন্দর। আরো এই ধরনের লেখা পড়তে চাই।
অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা। আপনার লেখায় নিজের জেলা সম্পর্কে জানতে পেরে নিজেকে সমৃদ্ধ মনে হচ্ছে। আপনার মতন আপনার লেখাও খুব খুব সুন্দর। এই রকম লেখা আরো চাই।🙏🙏🙏☺️☺️☺️
অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা। আপনার লেখায় নিজের জেলা সম্পর্কে জানতে পেরে খুব ভালো লাগলো। আপনার মতন আপনার লেখাও খুব খুব সুন্দর। এই রকম লেখা আরো চাই।🙏🙏🙏☺️☺️☺️