প্রায় একশ ঢেঁকিতে পাড় পড়ার শব্দ ধুপধাপ ধুপধাপ। এপাড়া ওপাড়ার লোক অতিষ্ঠ। তাদের বুকেই যেন আঘাত করছে একশ ঢেঁকির মুষল। কান-মাথা ঝনঝন। সাধের দিবানিদ্রা গেছে। কথা কয়ে সুখ নেই! মেয়েরা আবার ঢেঁকিশালে গান ধরেছে, “ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে, আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া’।
গঙ্গার উপকূলে এই ছোট্ট জনপদ কালনা। এখানে মানুষ একসময় নিত্যানন্দ প্রভুর নাম সংকীর্তনে প্রেমাবেশে ভেসে যেত। তারও আগে পুরনো মসজিদে ঈদের নমাজ আদা করতে কত লোকের ভিড় দেখেছে! কোলাহল সহ্য করেছে। কিন্তু সারাদিন এমন পিলে চমকানো, বুক ধড়ফড়ে আওয়াজে তাদের প্রাণ আগে ওষ্ঠাগত হয় নি।
“এই বাঙাল তারানাথ কি শুরু করেছে! ব্যবসার নামে যা খুশি করবে! এর একটা বিহিত করা দরকার!” চন্ডীমন্ডপে বুড়ো মাতব্বররা লাঠি ঠুকে ঠুকে বলল।
চাটুজ্যেদের বাড়িতে এই ঢেঁকির আওয়াজ তেমন পৌঁছয় না। তাদের বাড়ির ছেলেপুলেরাও বাচস্পতির টোলে পড়তে যায়। বড় চাটুজ্যে হাত কচলে বললে, “এজ্ঞে, বাচস্পতি মশাই টোলের পড়ুয়াদের নিখরচায় বিদ্যাদান, থাকা খাওয়ার জন্যেই তো এই সব ব্যবসা শুরু করেছেন। ওঁর কথা আমাদের একটু ভাবা কর্তব্য।”
“ছাড়ো তো চাটুজ্যেমশায়, তুমি আর ভালোমানুষি দেখিও না। বাঙাল ভটচাজ্জির ধানভানার ব্যবসা আমরা ঘুচিয়ে ছাড়ব।”
চন্ডীমন্ডপের মাতব্বররা হৈ হৈ করে সদলবলে বাচস্পতির অট্টালিকার সামনে উপস্থিত হ’ল। হেঁটো ধুতি, নিরাবরণ ঊর্ধাঙ্গে সাদা ধপধপে পৈতে দেখে নিঃসন্দেহে তারাপদ বাচস্পতিকে বামুন বলে চেনা যায়! তবে তাঁর কাজ কারবার ঠিক বামুনোচিত নয়! বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তখন তিনি মুটেকে নির্দেশ দিচ্ছেন,
“ভোলা, কাপড়ের গাঁঠরিগুলো ভালো করে দড়ি দিয়ে বাঁধ বাবা! খানাখন্দভরা মেঠো পথ পেরিয়ে কোলকেতা যেতে যেতে সব যে ছিটকে ছিটকে পড়বে।” অম্বিকাকালনায় বোনা তাঁর কাপড়ের ব্যবসা ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে কোলকাতা থেকে মির্জাপুর, কানপুর, মথুরা, কাশী গোয়ালিয়রে। বড়বাজারে তাঁর কাপড়ের দোকান, মেদিনীপুরের রাধানগরে কাপড়ের কুঠি।
প্রখর বৈষয়িক বুদ্ধিধর তারানাথ বাচস্পতি প্রতিবেশীদের চটালেন না। ঢেঁকিশাল বন্ধ না করে লোকালয় থেকে সেটিকে দূরে নিয়ে গেলেন।
বিদ্যা এবং বাণিজ্যকে একই সঙ্গে নিজ পুরুষকারে সসম্মানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তারানাথের পূর্বপুরুষ রামরাম তর্কসিদ্ধান্তকে বরিশাল জেলা থেকে বর্ধমানাধিপতি তিলক চন্দ্র কালনায় নিয়ে এলেন। ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি দিয়ে মানুষটিকে প্রতিষ্ঠিত করলেন কালনায়। এঁর পরিবারে বংশানুক্রমে বিদ্বান মানুষ জন্মাল। তবু নামের আগে বাঙাল বিশেষণটি ঘুচল না!
তারানাথ ছ’বছর বয়সে ভট্টিকাব্য পড়ছেন,
“অথ স বল্কদুকূলকুথাদিভিঃ
পরিগতোজ্জ্বল দুদ্ধৃতবালধিঃ
উদপতোদ্ধিবমাকুললোচনৈ
নৃরিপুভিঃ সভয়ৈরভিবোচিত্তঃ”
শিশুর সারল্যে তাঁর ভালো লাগছে হনুমানের লম্ফঝম্ফ, লঙ্কাদহন। বাবা কালিদাস সার্বভৌমের সঙ্গে তর্জমা করছেন, “অনন্তর বল্কল, দুকূল, কুশ বেষ্টিত পবনপুত্র লাফ দিয়া উঠিলেন। তাঁহার পুচ্ছটি ঊর্দ্ধমুখ, তাহাতে আগুন জ্বলিতেছে। নরশত্রু রাক্ষসরা ভীত আকুল হইয়া তাঁহার প্রতি নির্নিমেষ দৃষ্টিপাত করিয়া আছে।”
আঠেরো বছর বয়সে কালনার তর্কালোচনায় যোগ দিয়েছেন তারানাথ। তা দেখে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক রামকমল সেন ঐ উজ্জ্বল কিশোরটির বাবাকে বললেন ,
— ছেলেকে সংস্কৃত কালেজে ভর্তি করিয়ে দিন পন্ডিত প্রবর।
— ছেলে কোলকেতা গেলে নাস্তিক বা খ্রীষ্টান হয়ে যাবে না তো!
— আমি তো কোলকাতায় থেকেও ঘোর আস্তিক ও হিন্দু। বাবা হয়ে ছেলের পথ এভাবে রোধ করবেন না!
এরপর কালনার বাঙাল তারানাথ ভটচাজ্জির যাত্রাপথে অজস্র তারার স্ফূরণ। সংস্কৃতের অলঙ্কার, বেদান্ত, কাব্যশাস্ত্রে গভীর থেকে গভীরতর খোঁজ। বারাণসীর পাঠে মিলল ন্যায় শাস্ত্র, ব্যাকরণ, গণিতশাস্ত্রে অধিকার।
পান্ডিত্যের স্বীকৃতি পাচ্ছেন এশিয়াটিক সোসাইটির মহাভারত পুনর্মুদ্রণের কাজে। তাঁর ‘বাচস্পত্যাভিধান’ সঙ্কলন প্রশংসিত হচ্ছে গুণীজনের দরবারে। কাশীর পণ্ডিতেরাও তাঁকে ভূষিত করছেন, ‘পাণিনির এক জন অবতার।’
সংস্কৃত কলেজে পড়াকালীন তারানাথের জহুরীর চোখ খুঁজে পেল এক অমূল্য রত্ন। কলেজের কনিষ্ঠ ছাত্রটিকে তিনি বললেন, “কালেজ ছুটির পর ঈশ্বর আমার ঠনঠনিয়ার বাসায় এসো। আমরা একসঙ্গে পড়ব সাহিত্য দর্পণ। আলোচনা করব ন্যায় শাস্ত্র, অলংকার। আচ্ছা, সামনে মাসে একটি বিতর্ক সভা আছে। আমি সেখানে আমন্ত্রিত। তোমার ওপর থাকবে সভা সঞ্চালনার ভার। মীমাংসার দায়িত্ব।”
বাধ্য অনুজের মত প্রতিভাবান কিশোর ঈশ্বরচন্দ্র ঘাড় নেড়ে বললেন, “যে আজ্ঞে”।
প্রজ্ঞা একে অন্যকে আলো দেখায়। সেই আলোর সংস্পর্শ পেতে ঈশ্বরচন্দ্র এবার প্রবল শীতে পায়ে হেঁটে চলেছেন কোলকাতা থেকে কালনা। ততদিনে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক। ফিরিয়ে দিয়েছেন বেশি মাইনের সংস্কৃত কলেজের প্রথম শ্রেণীর অধ্যাপনার পদ। কলেজের অধ্যক্ষ মার্শেল সাহেবকে বলেছেন, “এ পদের উপযুক্ত একমাত্র তারানাথ বাচস্পতি মহাশয়। তিনি আমার চেয়েও ঢের বেশি পন্ডিত। সর্ববিদ্যাবিশারদ।অদ্বিতীয় বৈয়াকরণিক।”
তারানাথ তখন কালনায় কাঠ, কাপড়, শাল, দুধ-ঘি, কাপড়, স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবসা করছেন। সঙ্গে চলেছে চতুষ্পাঠীতে তাঁর অবৈতনিক শিক্ষাদান পর্ব। আচার্য তারানাথের কাঁধেই বিপুল ছাত্রসমাজের ভরণপোষণের দায়।
কালনায় পৌঁছে বিদ্যাসাগর শুনতে পেলেন দূর থেকে ভেসে আসছে চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের সন্নিবদ্ধ কণ্ঠস্বর,
“ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ….”
তারানাথ পন্ডিত ঈশোপনিদের শ্লোকের ব্যাখা করছেন, “ব্রহ্মান্ডে যাহা কিছু অনিত্য বস্তু আছে এসমস্তই পরমেশ্বরের দ্বারা আদরণীয়….”
— আরে ঈশ্বর যে! কি সংবাদ! এসো এসো। তোমার মত উজ্জ্বল রত্নকে পরিচয় করিয়ে দিই আমার ছাত্রদের সঙ্গে।
— নমস্কার আচার্যদেব! সে সব হবে’খন। আপনাকে যে আমি কোলকেতায় নিয়ে যেতে এসেছি।
— কেন, কি ব্যাপার!
— সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকের ভার নিতে হবে আপনাকে। কথা দিন।
গুণীর মান গুণীই রাখে। তারা নাথ বাচস্পতির উন্নত শিরোভূষণে আরো একটি রত্ন খচিত হল। তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দিলেন। তারানাথের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি সাগর পেরিয়ে পৌঁছল ইংল্যান্ডে।
প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে সংস্কৃত করে। পন্ডিত তারানাথ দু-বাহু বিস্তৃত করে বিদ্যাসাগরের পাশে নারীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ আন্দোলনে অগ্রসর হলেন।
কলকাতায় ‘ফ্রি সংস্কৃত কলেজ’ তৈরি হল তারানাথের উদ্যোগে। ভারতীয় উপমহাদেশের নানা প্রান্ত থেকে পড়ুয়ারা এলেন সেখানে সংস্কৃত শিখতে।
শুধু পাণ্ডিত্য বা ব্যবসায় সাফল্য নয়,তারা নাথের হাতে প্রাণ পেত পাখোয়াজ। সুরসিক মানুষটি রন্ধনে, কবিগান, আখড়াই সঙ্গীত রচনাতেও পটু ছিলেন।
এই সক্রিয় প্রতিভাধর মানুষটিরও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন তিনি। ফলে তাঁদের নিবিড় সখ্যতায় ছেদ পড়েছিল। এই বন্ধুবিচ্ছেদ যেন সেই সময়েরই এক আখ্যান। ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়েই যে সমাজের অগ্রগতি!
শেষ জীবনে কাশীবাসী হলেন তারানাথ। সুযোগ্য পুত্র পন্ডিত জীবানন্দের মধ্যেও বংশের বিদ্যাচর্চার ধারাটি প্রবহমান ছিল। তারানাথ বাচস্পতির শেষ কীর্তি ‘শব্দস্তোম মহানিধি’ পৃথিবীর সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ এখনো মান্যতা দিয়ে চলেছে। তিনি চিরভাস্বর হয়ে রয়েছেন তাঁর এই উজ্জ্বল কীর্তির পাতায় পাতায়।
তথ্যঋণ : পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘোষ।