হাতির পিঠে চলেছেন হিমাদ্রি পন্ডিত। গোমন্তকের ঘন অরণ্যের পথ ধরে। জঙ্গলের পথে হাতি নিজেই তার চলার পথ বানিয়ে নিচ্ছে। হাতির দুলকি চাল হিমাদ্রি যতটা উপভোগ করছেন, ততটাই মুগ্ধ হচ্ছেন এই মনোরম প্রকৃতির শোভায়। সদ্য বর্ষাকাল নিবৃত্ত হয়েছে। শরতের প্রকৃতি যেন মালিন্যহীন। হাসিখুশি, নির্ভার মেঘেরা ছোটাছুটি করছে নীল আকাশ জুড়ে। সহ্যাদ্রি পর্বতমালা সবুজের নতুন ওড়না গায়ে সেজে উঠেছে। পাহাড়ের গা থেকে কত ছোটো বড় ঝর্ণার আনন্দধারা! একটা পাখি নিরন্তর ডেকে চলেছে মিষ্টি সুরে। কোন পাখি! কি তার নাম! হিমাদ্রি তাঁর মাহুতকে জিজ্ঞেস করলেন। সে ঘাড় নাড়ল। তারও জানা নেই।
হিমাদ্রি বা হেমান্তপদ যাদব সাম্রাজ্যের শ্রীকরণাধীপ বা প্রধান অমাত্য পদের গুরুভার বহন করলেও তিনি যে আসলে শিল্পী। তাঁর কবি মনে কল্পনার চোরাস্রোতের আনাগোনা। তিনি যতটাই সফল লেখক, কবি, প্রশাসনিক কাজে ততটাই দক্ষ। রাজ্যের মানুষ আদর করে তাঁকে পন্ডিত বলে ডাকে।
যাদবরাজ রামচন্দ্রের তিনি দক্ষিণ হস্ত। রাজ্যের শাসন-বিচার-প্রজাকল্যাণ সমস্ত কাজেই তিনি হেমান্তপদের পরামর্শ ছাড়া চলেন না। তবে আজকাল তিনি বনাঞ্চলে উপজাতিদের সংঘর্ষ নিয়ে বড়ই চিন্তিত। যেটুকু সংবাদ তাঁর কানে আসছে, তা বড় সংকটজনক। রাজধানী দেবগিরি থেকে সে সমস্যার সমাধান অসম্ভব। গোমন্তকের গহন বনে গিয়ে এ সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন। এখন কি উপায়! করণাধীপ হিমাদ্রি বুদ্ধিমান। তাঁকে কি দায়িত্ব দেওয়া যায়!
অনেক ভাবনাচিন্তার পর রামচন্দ্র মহাঅমাত্যকে খোদ নির্দেশ দিয়ে বললেন, “হে শ্রীকরণাধীপ! তাম্বদি সূরলার উপজাতি সংঘর্ষ নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত। আপনি নিজে ঐ স্থানে গিয়ে ঐ সমস্যার সমাধান করে আসুন। তবে একলা যাবেন না। ঐ ঘন জঙ্গলে ভয়ঙ্কর পশু আর আদিম উপজাতিরা বসবাস করে। তাই অস্ত্রশস্ত্র, সেনা, যথেষ্ট খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হবেন।”
রাজ আজ্ঞা অমান্য করা যায় না। হিমাদ্রি পন্ডিত বললেন, “নিশ্চিন্ত থাকুন মহারাজ। আপনি যে আদেশ দিয়েছেন, আমি যথাযথ তা পালন করব। তাম্বদি সূরলার সমস্যার সমাধান না করে আমি রাজধানীতে ফিরছি না।”
মহামাত্য কি মনে মনে খুশি হলেন! রাজ কার্যের দায়িত্বভার থেকে তাঁর মন যে মাঝেমাঝে ছুটি চায়! তিনি প্রকৃতিপ্রেমিক। প্রকৃতির নিবিড় আশ্রয়ে তিনি নিশ্চিন্তে লেখালেখি, বিদ্যার্জনের কাজে মন দিতে পারেন।
পন্ডিতপ্রবর হিমাদ্রি রচনার সংখ্যা বড় কম নয়! তিনি লিখেছেন চতুর্বর্গ চিন্তামণি, অষ্টাঙ্গ হৃদয়ম্, হেমাদপন্থী ভাকরের মত বিখ্যাত গ্রন্থ। সাহিত্য, ধর্ম, আয়ুর্বেদ, প্রশাসন কত বিষয়ে তাঁর অনুরাগ! তিনি মারাঠী ভাষার জন্যে মোদী লিপি সৃষ্টি করেছেন। নতুন কবিদের রচনায় তাঁর ভারি উৎসাহ। মনোযোগ দিয়ে তাদের কবিতা পড়েন। এই তো সেদিন তিনি নবীন কবি ব্যোপদেবের কাব্যগ্রন্থ পড়ে তাঁকে পিঠ চাপড়ে বললেন, “হে বৎস্য, তোমার ভাবখানি তো বড় চমৎকার! উপমা, অলংকার প্রয়োগেও তোমার কল্পনার প্রশংসা করতে হয়। তবে ছন্দের প্রতি তোমাকে যে আরো মনোনিবেশ করতে হবে। অনুষ্টুপ ছন্দের প্রতিটি পংক্তিতে আটটি অক্ষরের সমাবেশ হয়, সে কথা তোমায় ভুললে চলবে না!”
পথ চলতে চলতে মাঝেমাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন হিমাদ্রি। কিন্তু কেন? রাজ্যের অন্যত্র সব কুশল মঙ্গল। তবু কিসের চিন্তা! শ্রীকরণাধীপের চিন্তার জালের মতই হঠাৎ শরতের আকাশে বাদল মেঘের অন্ধকার। সে অন্ধকারের ছায়ায় গভীর অরণ্য আরো রহস্যময় হয়ে উঠল। তিনি যেন অনুভব করলেন গাছপালার গভীর অন্তরাল থেকে কয়েক জোড়া চোখ তাঁকে অনুসরণ করছে। মহা অমাত্য নিঃশব্দে তাকালেন তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর শৈলেন্দ্রের পানে। তুখোড় প্রহরী শৈলেন্দ্র সম্ভবতঃ সন্দেহ করেছিল। সে তার তূনীরে হাত রাখতেই ইশারায় তাকে নিবৃত্ত করলেন বিচক্ষণ মহা অমাত্য। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ক্ষমতা আর বলপ্রয়োগ করে এখানকার উপজাতি সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি ইঙ্গিতে সব অনুচরদের থামতে বললেন। প্রধানরক্ষীকে আদেশ দিলেন,
— শৈলেন্দ্র আজ এখানেই শিবির ফেলা যাক। দিন শেষ হয়ে আসছে। আকাশেও মেঘের ঘনঘটা। নিকটেই বোধহয় কোনো নদী আছে বা ঝর্ণা।আমাদের জলের প্রয়োজন মিটে যাবে। তুমি জলের শব্দ শুনতে পাচ্ছ শৈলেন্দ্র?
— হ্যাঁ মহা অমাত্য শুনতে পাচ্ছি। আমি এখানেই দ্রুত দুটি শিবির তৈরি করার ব্যবস্থা করছি।
অতি সত্ত্বর জঙ্গল পরিষ্কার করে শিবির ফেলা হল। রাতের প্রহরে মশাল জ্বালিয়ে পালাবদল করে রক্ষীরা পাহারা দিল শিবির।
প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম ভাঙে হিমাদ্রি পন্ডিতের। শিবির থেকে বেরিয়ে জলের আওয়াজ লক্ষ্য করে তিনি একলাই এগিয়ে চললেন। তখন আকাশে সূর্যোদয়ের লাল আভা। পাখিদের কলকাকলি।
হেমাদপন্ত দেবাদিদেবের পরম ভক্ত। সকালে স্নান সেরে, কপালে রক্তচন্দনের ত্রিপুন্ড তিলক করে তিনি মহাদেবের স্তব করেন। তারপরে অন্যান্য কাজ।
স্নান সেরে পবিত্র হবেন বলেই একটু এগোতেই তিনি দেখলেন, কি আশ্চর্য এ তো একটি নদী! এটিই কি সেই সূরলা নদী! তবে তো আমার অনুমান অভ্রান্ত। ঠিক গন্তব্যেই পৌঁছে গেছি আমি! মহা অমাত্য মনে মনে ভাবলেন। স্বচ্ছ, নির্মল নদীর জল। সে জলে বনের ছায়া পড়ে স্বচ্ছতোয়া নদী আরও মোহময়ী হয়েছে।
নদীতে স্নান সেরে ওঁ নাগেন্দ্রহারায় ত্রিলোচনায় ভস্মাঙ্গরাগায় মহেশ্বরায় মন্ত্র জপ করতে করতে জল ছেড়ে উঠতেই হেমাদপন্ত দেখলেন একদল উপজাতি মানুষ তাঁকে ঘিরে ধরেছে। কূটনীতিক মহা অমাত্য এক মুহুর্ত দেরী করলেন না। অতি বিনয় সহকারে জোড়করে তাদের নমস্কার জানিয়ে তিনি বললেন,
— “হে অরণ্যচারীর দল! আমি দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রের প্রতিনিধি হয়ে আপনাদের কাছে এসেছি। আমার নাম হেমাদপন্ত। আমি আপনাদের শত্রু নয়, বন্ধু। আপনাদের যা যা সমস্যা আছে খুলে বলুন। আমি যতদূর সম্ভব সমাধান করার চেষ্টা করব। আপনাদের দুই দলপতির সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। আপনারাই বলুন, কোথায় কখন সাক্ষাৎ হবে।”
হিমাদ্রি পন্ডিতের সুমিষ্ট, নাগরিক বচনে অতি বড় শত্রুও বিগলিত হয়! এরা তো সহজ, সরল বনচারী।
দুই বিরোধী দলপতি তাদের দলবল সঙ্গে নিয়ে শ্রীকরণাধীপ হিমাদ্রির সঙ্গে দেখা করতে এল। বুদ্ধিমান মন্ত্রীটি দলপতিদের অভিবাদন করলেন। তাদের নানা শস্য, প্রচুর বস্ত্রাদি, মিষ্টান্ন উপহার দিলেন। উপঢৌকন, উপহারে কে না প্রসন্ন হয়! মহামাত্য শুনেছিলেন এদের খাদ্যের অনটন প্রধান এক সমস্যা। এছাড়াও স্থানাধিকার নিয়ে বিরোধ। সূরলা নদীর পাড়ে একটি বৃহৎ শিবলিঙ্গ আছে। ভগবানের অধিকার নিয়েও তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব।
হেমাদপন্ত অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে তাদের সমস্যা শুনলেন। তারপর এক এক করে তার সমাধানের পথ দেখালেন। দুই যুযুধান জাতির সীমানা বেঁধে দিলেন সূরলা নদীর দুই পারে। কেউ কারো সীমানা লঙ্ঘন করতে পারবে না। খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি তাঁর লোক লস্করকে নির্দেশ দিলেন, “কাল থেকেই তোমরা এদের শস্য উৎপাদন শিখিয়ে দেবে। এই পরিশ্রমী মানুষদের এরপর থেকে খাদ্যের অনটন আর থাকবে না।
সহজ কথায় দলপতিদের তিনি বোঝালেন, “দেবাদিদেব আমাদের সকলের পিতা। তাঁকে নিয়ে এমন বিরোধ, ভাগাভাগি চলে না। তাঁর আরাধনায় আমাদের সবার অধিকার। আপনারা সকলে শিবলিঙ্গের পূজার্চনা করবেন”।
সমস্যার খানিক সমাধান হল। শিল্পী হিমাদ্রি মনে মনে বহুদিন ধরে একটি লালিত ইচ্ছা রূপ দেবার চেষ্টা করলেন। তিনি আজকাল সামান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে পাথরে ফুল ফোটান। মূর্তি গড়েন। ভাবলেন, এখানে এই সুন্দর প্রকৃতির মাঝে দেবাদিদেবের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করলে কেমন হয়!
কর্মোদ্যোগী হেমাদপন্ত দুই দলের কিছু মানুষকে নেমে পড়লেন কাজে। কালো কঠিন আগ্নেয় শিলাকে ধীরে ধীরে খোদাই করলেন। একটি পাথরের গর্ভে আরেকটি পাথর জুড়ে গড়ে উঠল একটি ছোটো সুন্দর দেবালয়। মন্দিরের গায়ে খোদিত হল বিভিন্ন অলঙ্করণ। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত হল সেই শিবলিঙ্গ, যাঁকে নিয়ে বিরোধ ছিল দুই উপজাতির। সূর্যের প্রথম কিরণে পূর্বমুখী এই মন্দিরটি প্রতিদিন অভিষিক্ত হল। সবাই ধন্য ধন্য করে উঠল। শান্তি ফিরে এল অরণ্যে।
এবার তাঁদের ফিরে যাবার পালা। মহাঅমাত্য সবার কাছে বিদায় নেবার আগে দেবালয়ের সেবার কাজে নিযুক্ত করে গেলেন আনি নামে একটি তরুণীকে। মালু নামে একটি তরুণ রইলো মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের কাজে।
প্রাকৃতিক সুরক্ষায় ঢাকা এই মন্দির সকলের অগোচরে কেবলমাত্র বনচারীদের আরাধনাস্থল হয়ে রয়ে গেল। যদিও মন্দিরের এই নির্মাণ শৈলী বিখ্যাত হল হেমাদপন্থী নামে। শিল্পী হিমাদ্রির নির্দেশনায় যাদব রাজ্যে গড়ে উঠল আরো কত হেমাদপন্থী দেবালয়।
বিচক্ষণ প্রধান অমাত্য কিন্তু মালু আর আনির যৌবনের গান শুনতে পাননি। দুই বিরোধী দলের তরুণ-তরুণীর প্রণয়সংবাদে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠল। সংঘর্ষে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল দুই উপজাতি। কেউ কেউ অবশ্য পালিয়ে বাঁচল। তারা জানত তাম্বদি সূরলা মন্দিরের গর্ভগৃহে এক নাগরাজ প্রতিদিন সেবা করে দেবাদিদেবের। গভীর অরণ্য, সহ্যাদি পর্বত, সূরলা নদী পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছিল এই মন্দির কে। বিধর্মীরা তাই স্পর্শ করতে পারেনি এই স্থাপত্যকলাকে। সৃষ্টি আর ধ্বংসলীলার সাক্ষী হয়ে যুগযুগ ধরে প্রকৃতির আলিঙ্গনে রয়ে গেলেন নীলকন্ঠ পরমেশ্বর।
শেষে এসে চমকে উঠলাম। অসাধারণ ছবি ও লেখা।
খুব খুশি হলাম। সুপ্রভাত ❤️
অসাধারণ লাগলো।এ কি তোমার ই কল্পনা প্রসূত না এর মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক সত্য ও লুকিয়ে আছে?সাথের ছবিগুলোর তো কোনো তুলনা ই নেই! তুমি তো একাধারে লেখিকা আবার ছবি তোলার পাকা কারিগর! কুর্ণিশ জানাই তোমায়!!
তোমার ভালো লাগায় খুব খুশি হলাম দিদি। একমাত্র হিমাদ্রি চরিত্রটি সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য পেয়েছি। বাকিটা আমার কল্পনা ।
অপূর্ব, যেন ওই সময় কে চোখের সামনে দেখলাম। এর কি ঐতিহাসিক সত্যতা আছে, নাকি সম্পূর্ণই কল্পনা প্রসূত? যদিও হেমাদ পন্থী কিছু মন্দির মহারাষ্ট্রে আছে বলে শুনেছি।
আপনার ভালোলাগা বিশেষ প্রাপ্তি আমার।
হেমাদপন্ত চরিত্রটি সম্পর্কে সামান্য তথ্য পেয়েছি । মন্দিরটি হেমাদপন্থী শৈলীর। বাকি কল্পনা।
কি অপূর্ব লেখা। মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। তোমার কলমের অসাধারণ মুন্সীয়ানাকে কুর্নিশ জানাই।
তোমার ভালোলাগায় প্রাণিত হই। ভালোবাসা জেনো♥️