এক সময় কলকাতার ভীমচন্দ্র নাগের মিষ্টির দোকানের খুবই নামডাক ছিল মিষ্টি প্রেমীদের কাছে। সময়টা ব্রিটিশ আমল। শোনা যায়, তাঁর দোকানের সন্দেশের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখপাধ্যায় ছাড়াও জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তিত্ব। বাঙালি মনিষী ছাড়াও বাঙালি নয় এমনকি বহু সাহেবরাও আসতেন ভীম নাগের দোকানে। তখন লর্ড ক্যানিং ছিলেন গর্ভনর জেনারেল। তিনি ছিলেন শেষ গর্ভনর জেনারেল, আর প্রথম ভাইসরয়। তাঁর পত্নী ছিলেন লেডি শার্লোট ক্যানিং। লেডি ক্যানিং কলকাতায় আসার পর তাঁর জন্য ভীমচন্দ্র নাগ এই মিষ্টি তৈরি করেন। মতান্তরে লেডি ক্যানিং এর জন্মদিনের এই মিষ্ট বানিয়ে উপহার পাঠান। তবে এটা নিশ্চিত এই মিষ্টি লেডি ক্যানিং-এর উদ্দেশে তেরি করেন প্রখ্যাত হালুইকর ভীম নাগ।
কথিত লেডি ক্যানিং তাঁর জন্মদিনে ভীম নাগকে এমন কিছু মিষ্টি তৈরি করার জন্য আবদার জানান যার স্বাদ আগে কেউ কোনোদিন পায়নি। এরপর ভীম নাগ যে বিশেষ ধরনের মিষ্টিটি তৈরি করেছিলেন তার স্বাদ লেডি ক্যানিংকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে আত্মতৃপ্ত লাটসাহেব ভীম নাগকে তুলে দেন দু-হাত ভরা উপহার। সেই থেকেই বাজারে এই বিশেষ ধরনের মিষ্টির নামকরণ লেডি ক্যানিংয়ের নামানুসারে হয় লেডিকেনি। লেডি ক্যানিংয়ের নাম যে এই মিষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেকথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন।
লেডিকেনির মত আরেকটা মিষ্টি বাংলায় অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয় ছিল। পান্তুয়া। শুদ্ধ বাংলায় পানিতোয়া। উপকরণ ছিল রাঙালু। কিন্তু পান্তুয়ার সঙ্গে লেডিকেনির তফাৎ ছিল। দুটোই ছানা আর খোয়াক্ষীর মিশিয়ে তৈরি হয়। কিন্তু লেডিকেনিতে ছানার ভাগ থাকে বেশি, আর পান্তুয়াতে খোয়াক্ষীর বেশি। কলকাতার বাইরে রানাঘাটের লেডিকেনি বিখ্যাত। কিন্তু এখন সেই আসল লেডিকেনি অনেক মিষ্টির দোকানেই আর পাওয়া যায় না। তার জায়গা নিয়েছে গোলাপজাম।
লেডিকেনি শুকনো মিষ্টি নয়, বরং রসগোল্লার মতোই রসে ডোবানো। তবে গুলাবজামের মতো ঘন হলদেটে রস নয়, রসগোল্লার মতো পাতলা আর কম মিষ্টির রসে ডোবানো। লেডিকেনির ভেতরে একটা গহ্বর থাকে, যাতে থাকে কিছুটা রস আর একটা এলাচ। এখন উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার হাতে গোনা কয়েকটা দোকান ছাড়া আর কোথাওই আদি-অকৃত্রিম লেডিকেনি পাওয়া যায় না। আবার লেডি ক্যানিং এর কথায় ফিরে আসি।
ক্যানিংয়ের বিবাহিত জীবন নিয়েও আলোচনা কম হত না। বিশেষ করে লেডি ক্যানিং হয়ে উঠলেন জনপ্রিয় এক চরিত্র। হাজার হোক, ভাইসরয়ের স্ত্রী বলে কথা। তাছাড়া তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর দারুণ সহানুভূতিশীল ছিলেন। অসাধারণ সুন্দরী লেডি ক্যানিং দক্ষ চিত্রশিল্পীও ছিলেন। ফুল ও গাছের প্রতি ছিল ভালোবাসা। ব্যারাকপুরের বাড়িতে তাঁর নিজের হাতে তইরি করা বাগান ছিল দেখবার মত।
লর্ড ক্যানিং-এর ভারতবাসের শেষদিকে ওঁকে খুব দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তখন কাজের চাপ ছিল অনেক! তিনি যখন তরাই অঞ্চলে কাজে ব্যস্ত সেই সময় স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্য ওঁর স্ত্রী ছিলেন দার্জিলিঙে, ওখানেই জাঙ্গল ফিভার বা ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। দ্রুত ওঁকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় কলকাতায়, কিন্তু অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে। অবশেষে ১৮৬১-র নভেম্বরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাজভবনে। লেডির প্রিয় জায়গা ছিল ব্যারাকপুরে গঙ্গার তীর। ওঁর ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে সেই গঙ্গাতীরে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ওঁকে সমাধিস্থ করা হয়। এখন সেখানে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল।
১৮০০ সালে লর্ড ওয়েলেসলি এই জায়গায় ব্যারাকপুর পার্ক নির্মাণে উদ্যোগী হন। পরে লেডির সমাধির করুণ দশা দেখে তার উপরে একটি ছাউনি তৈরি করে দেওয়া হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্য, রঙিন পাথরের কারুকাজ করা সেই সমাধি সংরক্ষণ করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এরপর কলকাতার সেন্ট জন’স চার্চে সমাধিটি স্থানান্তরিত করা হয়। তারপর লর্ড ক্যানিংও ফিরে গেলেন স্বভূমিতে। লেডি ক্যানিংয়ের মৃত্যুর পর কলকাতায় বেশ কিছুদিন তাঁকে নিয়ে চর্চা হয়। কথিত তাঁর স্মৃতির উদ্যেশ্যে কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টি ব্যবসায়ী ভীমচন্দ্র নাগ লেডি ক্যানিং-এর নামের নতুন মিষ্টি বাঙালি ও ইংরেজদের মুখে মুখে বাংলা হয়ে গিয়েছিল, নতুন মিষ্টি লেডি ক্যানিং চলতি কথায় হয়ে উঠল লেডিকেনি। এইভাবে ভারতের প্রথম ভাইসরয়পত্নীর নাম থেকে গেল বাংলার মিষ্টির মধ্যে। প্রায় সব সরকারি অনুষ্ঠানে একবাক্যে জায়গা পেতে লাগলো লেডিকেনি। শুধু পুজোয় প্রসাদ হিসেবে লেডিকেনি ও রসগোল্লার মতোই জনপ্রিয় হয়ে গেল সেকালে।
আজও চিনির রসে ভেজানো লেডিকেনি সমান প্রিয় রসনা বিলাসীদের কাছে।
মনোজিৎকুমার দাস, প্রাবন্ধিক, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ