ছোট্ট মেয়েটি কোনও দিন কারও চোখের দিকে তাকায়নি। এইটাই তো মেয়ের একমাত্র রোগ ছিল। এ রোগ কেমন করে সারবে? আসলে সে অন্যমনস্ক থাকত। এই কথাটাই কেউ বোঝেনি কোনও দিন। তার মন পড়ে থাকত কোথায় কে জানে! বিস্ফারিত চোখে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে কিছু ভাবত কী ভাবত না, কে জানে! ছোটদের মনের নাগাল পাওয়া কি অত সোজা? তখন মেয়ের বয়সটাই বা কত কে জানে আট না বারো না পনেরো?
মেয়ে শুধু অন্যমনস্ক নয়, ছিল ভিতুও। মায়ের চোখের দিকে তাকালে ভয় করত তার। মায়ের রুদ্র রূপের ভ্রূকুটি দেখে সে ভয় পেয়েছে কত বার। রবীন্দ্রসংগীত গাইতে না পারলে চড় থাপ্পড়! মা বলে, ‘‘এই! অচেইনাকেই ভই কি আমাররর ওরেরর এ রকম করে বলছিস কেন রে? ইংরেজ নাকি তুই? বাংলা জানিস না? ঠিক করে গা,’’ বলেই এক গাঁট্টা। স্কুলের পড়া না বলতে পারলে সরু ছড়ির দু’এক ঘা! পড়া না করতে পারলে দোষ কি তার? স্কুলের টিচাররা পড়া মুখস্থ চায়। হিষ্ট্রি, জিওগ্রাফি চ্যাপ্টারের পর চ্যাপ্টার মুখস্থ বলতে হবে, এক একটা প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করতে হবে। মুখস্থ বিদ্যাটাই ছিল তাদের কাছে আসল শিক্ষা। অত মুখস্থ করা যায়? তাই মার খেতে হত বেচারিকে। সরু ছড়ির দু’এক ঘা! এক বার মেয়ে নামতা মুখস্থ বলতে পারেনি, তাই তার হাত পা জানলার গরাদের সঙ্গে বেঁধে সেই সরু ছড়ির প্রহার পেতে হয়েছে পিঠে। পরে অবিশ্যি তার মা পিঠে মলম মাখিয়ে দিয়েছে।
মেয়ের বাবা ছিল নির্বিকার প্রকৃতির মানুষ। গল্প লিখতে ভালবাসত। মেয়েকে নিয়ে ঝুটঝামেলায় বিশেষ জড়াতে চাইত না। পারতও না বেচারি। মায়ের দাপটেই সংসার তাজা থাকত। বাবার রোজগার কম ছিল। অত কম রোজগারে কী করে সংসার চালাত সেটাই রহস্য। বোধহয় বাঁচবার সাধ ছিল ষোলো আনা। আর ওই রোজগারেই কিন্তু ভাত ডাল দিত গরম গরম। সেই ডালের কী স্বাদ! বাবা ‘আঃ’ বলে খুশি হয়ে খেয়ে অফিস চলে যেত। বাবাকে ঠিক ‘নির্বিকার’ বলাটা বোধহয় ভুল হবে, কারণ মেয়ে এক বার এক অপরাধ করেছিল পাশের বাড়ির আমের ডালা থেকে আম চুরি করে খেয়েছিল। মা তাকে অন্ধকার ভাঁড়ার ঘরে সারা দিন বন্ধ করে রেখেছিল। একটু পরে বাবা কেমন করে সেই ভাঁড়ার ঘরের ভাঙা জানলা আর একটু আলগা করে দিয়ে মেয়েকে চুপি চুপি দশ পয়সার আইসক্রিম খাইয়েছিল। তার পর সেই জানলা দিয়ে এক এক করে ঢুকেছিল ‘রামদানা লইয়া’, ‘গঠিয়া’ আর ‘ললিপপ’ সব দশ দশ পয়সার! কী সুন্দর সবুজ রং ছিল সেই ললিপপের।
বাবা মাঝে মাঝে বলত, ‘‘এত ভিতু কেন রে তুই? রোজ এক গেলাস করে জল খাবি সকালবেলা খালি পেটে আর ভয়কে বলবি, যাঃ পালা! আমি টিপু সুলতান, মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছি।’’ ধ্যাৎ, তাই কি হয়? অমন বললেই কি আর ভয় পালায়?
মেয়েটি কিন্তু আসলে ভিতু ছিল না। তার এক বন্ধু ছিল, নাম খুন্নিবুড়ি। কী বিকট তার চেহারা। উস্কোখুস্কো চুল, শণের মতো, কালো মুখ, সাদা সাদা দাঁত আর পা দুটো ছিল উল্্টো দিকে। এমন ভূতের মতো চেহারা কিন্তু একা মেয়েই দেখতে পেত। আর কেউ পেত না। মায়ের ভয় করত। ‘‘এই অন্ধকারে কার সঙ্গে কথা বলছিস রে?’’ মেয়ে বলত, ‘‘ও তো খুন্নিবুড়ি, রোজ আমার সঙ্গে গল্প করে। আমি ঘুমিয়ে পড়ব। খুন্নি আছে, তুমি ভয় পেও না।’’ মা চিন্তিত হয়ে চলে যেত। মাঝে মাঝে ‘রাম রাম’-ও বলত। কিন্তু খুন্নিবুড়ি থাকলে মেয়ে অন্ধকারকে মোটেই ভয় পেত না। চোখে চোখ মিলিয়ে কত কথা বলত।
মেয়ের আর খুন্নিবুড়ির এক অদ্ভুত জগৎ ছিল যেখানে আর কেউ যেতেই পারত না। তারা দু’জনে মিলে মাঝে মাঝে এক জঙ্গলে চলে যেত, গাছের পাতা খেয়ে থাকত। সেই জঙ্গলে কাঠকুটো আর পাতা দিয়ে ঘর বানিয়েছিল তারা। সেখানে খুন্নিবুড়ির এক দিদিও আসত, নাম বনবুড়ি। মেয়ে বনবুড়িকে খুব শাসন করত। লেখাপড়া শেখাত।
খুন্নিবুড়ির তো ছেঁড়া শাড়িতে চলে যেত। আর মেয়ের জামা মিলত, বছরে একটাই। তাও এক এক বছর নতুন জামার বদলে স্কুল ইউনিফর্ম হবে কি না তাই নিয়ে মেয়ে একটু চিন্তিত থাকত।—‘‘খুন্নি, এ বছর বোধহয় পুজোর নতুন জামা হল না রে।’’ খুন্নি বলত, ‘‘তুঁই আঁমাঁর ছেঁড়াঁ শাঁড়িটাঁ নিঁবিঁ?’’ মেয়ে নিজেই খুন্নির গলা নকল করে বলত। তার পর নিজেরই গায়ে এক চিমটি! ‘‘খুন্নি, তোর শাড়ি পরে আমি ঠাকুর দেখতে যাব?’’ মা আড়াল থেকে দেখত, শুনত আর ভাবত, মেয়েটা কি সত্যি কিছু দ্যাখে?
মেয়ে খুন্নিবুড়িকে যতই দুঃখ কষ্টের কথা বলুক না কেন, মা বাবাকে কিন্তু বলত না কিছুই। কিছু চাইতও না। এখনকার বাচ্চারা মা বাবাদের কাছে কত কিছু চায়, কত কিছু পেয়ে যায়। কিন্তু সেই মেয়ে তার মা-বাবার কাছে কোনও দিন কিছু চায়নি একটা পুতুলও না। বাঃ! চাইলেই কি তারা এনে দিতে পারত? টাকা লাগে না? টাকা কোথায়? নতুন জামা বা স্কুলের টিউনিক দর্জিকে দিয়ে সেলাই করাবার ক্ষমতা ছিল না তাদের। মা একটা পুরনো নড়বড়ে সেলাইকলে নিজেই সেলাই করে দিত ও সব। মেয়ে সেই সেলাই করা জামা পরে, ভারী খুশি হয়ে, দৌড়ে গিয়ে খুন্নিবুড়িকে দেখাত। ‘‘খুন্নি, নতুন জামাটা কেমন হয়েছে রে? তুই না বড্ড বাজে কথা বলিস, কোথায় ঝুল বড় দেখলি? হাতায় কী সুন্দর ফ্রিল দিয়েছে মা। তুই পারিস এ রকম ফ্রিল দিয়ে জামা করতে?’’ চলল বচসা খুন্নির সঙ্গে, মান অভিমান, শাসন, আড়ি আর ভাব করা।
ওদের যতই অভাব থাকুক না কেন বাবা কিন্তু মেয়েকে মাসের গোড়ায় দুটি করে টাকা দিত। অনেক কষ্টে, তার প্রায় শূন্য পকেট থেকে বেরোত সেই টাকা। তা থেকে একটি করে টাকা একটা খালি পাউডারের কৌটোতে সে জমাত আর একটা টাকা দিয়ে পাঁচ পয়সা, দশ পয়সার আইসক্রিম, হজমি, চকলেট সে নিজে খেত আর খাওয়াত— না খুন্নিবুড়িকে নয়, খুন্নি তো পাতা খেয়ে থাকত— এক শীর্ণকায়, ছেঁড়া জামা পরা রিকশাওয়ালাকে।
মেয়ে বুঝত না, সে কেন রোজ ওই রিকশাওয়ালার কাছে এক গাল হাসি নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে যায়। তার গায়ে কী গন্ধ! বাঃ, গন্ধ তো হবেই! তার যে বাড়ি ছিল না, মা ছিল না, বাবা ছিল না। কে তাকে গায়ে মাখার সাবান কিনে দেবে? তার কিচ্ছু ছিল না। শুধু ছিল দুটো চোখ, যা দিয়ে ঠিকরে ঠিকরে হাসি ঝরে পড়ত, যখনই সে মেয়ের দিকে তাকাত। রিকশাওয়ালার নাম ছিল ভুল্ওয়া। নামের মতোই ভুলো মন ছিল তার। স্কুলে নিয়ে যেত মেয়েকে, কিন্তু মাঝে মাঝে ভুল করে একটা পার্কে চলে যেত। পার্কে দোলনা, সি-স আর স্লাইড ছিল, আর ছিল অনেক ফুল— গোলাপ, প্যাঞ্জি, গাঁদা, কৃস্যানথিমাম! মেয়েকে দোলনায় বসাত ভুল্ওয়া। তার পর কত গল্প করত তারা। খুন্নির কথা একমাত্র ভুল্ওয়া-ই বুঝত, আর কেউ বুঝত না। ‘‘হাঁ, হাঁ দিদি, তহার খুন্নিবুঢ়ি বহুৎ অচ্ছি হ্যয়। পরি জ্যসি হ্যয় না’’ মেয়ে এই কথা শুনে খুব হাসত। ‘‘নহি ভুল্ওয়া, খুন্নিবুড়ি কালি হ্যয়, লম্বে লম্বে বাল হ্যয়, মুহ টেঢ়া হ্যয়। বিলকুল পরি জ্যসি নহি হ্যয়। লেকিন বহুৎ অচ্ছি হ্যয়।’’ ভুল্ওয়া বুঝতে না পারলেও ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলত, ‘‘হাঁ, হাঁ বহুৎ অচ্ছি হ্যয়, তোকা পয়ার করত হ্যঁয় না?’’
ভুল্ওয়াকেও শাসন করত মেয়ে। বইখাতা বের করে পড়া শেখাত। ভুল্ওয়া খ্যাক খ্যাক করে হাসত। মেয়ে বলে, ‘‘বোলো এ বি সি, বোলো।’’ ভুল্ওয়া বলে, ‘এ বি ছি’। মেয়ে বলে, ‘ছি নহি, সি’। ভুল্ওয়া বলে, ‘‘অরে দিদি, হমসে ছি উ বোলে ন বনি।’’ তার পর মেয়ে তার টিফিন বের করে অর্ধেক ভুল্ওয়াকে খাওয়ায় আর অর্ধেক নিজে খায়। ভুলওয়া বলে, ‘‘দিদি, আসমান মে উও জো উড়ৎ হ্যয়, উও চিড়িয়া হ্যয় কা?’’ মেয়ে বলে, ‘‘ধৎ ভুল্ওয়া! তুম কুছ নহি জান্তে। উও ত হওয়াই জহাজ হ্যয়। উসমে আদমি ব্যঠা হ্যয়।’’ তখন ভুল্ওয়া চোখ গোল গোল করে বলে, ‘‘অরে দিদি, আদমি কো ডর নহি লাগত হ্যয় কা?’’ মেয়ে খিল খিল করে হাসে।
কিন্তু রাত হলে মেয়ে ভয়ের কথা ভাবে। আচ্ছা, অত উঁচুতে গেলে ভয় করে না? পাখিরা কি ভয় পায়? মেয়ের বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। রাতে সে স্বপ্ন দেখে— তার মা নেই, বাবা নেই।
পর দিন সকালে মা দেখল মেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে। মা জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কী হয়েছে রে তোর? কাঁদতে বসলি কেন সক্কালবেলা? পেট ব্যথা করছে?’’ মেয়ে শুধু ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলল, আর কিছুই বলতে পারল না। ওটাই তো ওর রোগ, ভাল করে বুঝিয়ে কিচ্ছু বলতে পারে না। বাবা এসে বলল, ‘‘আহা, ওর শরীরটা বোধহয় খারাপ। আজ ওকে স্কুলে নাই বা পাঠালে।’’ মা মুখ ভেংচে মেয়েকে বলল, ‘‘ওরে আমার ছিঁচকাঁদুনি নেচে নেচে আয়, দুল দেব, বালা দেব, সোনার নূপুর পায়,’’ বলেই মাথায় চটাং করে দিল এক চাটি। মেয়ে আড় চোখে মায়ের দিকে তাকাল। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। মা বলল, ‘‘যাঃ, তোর আজ ছুটি!— ওহ! হাসি দেখ মেয়ের। ওমনি পেটের ব্যথা সেরে গেল না? যাঃ দূর হ!’’
মেয়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেল ভুল্ওয়ার কাছে। ভুল্ওয়া তখন তার ঝুপড়িতে বসে ঢুলছিল। মেয়েকে দেখেই সে সজাগ হয়ে গেল, ‘‘অরে দিদি, ইস্কুল নহি হ্যয় কা?’’ মেয়ে বলল, ‘‘নহি। অচ্ছা ভুল্ওয়া, মেরে মা-বাবা মর্ যায়েঙ্গে কয়া?’’ ভুল্ওয়া সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘অরে নহি দিদি নহি, কব্ভি নহি মরেংগে।’’ মেয়ে নিশ্চিন্ত হল। হাতেই গলে যাওয়া চকলেটের অর্ধেকটা সে ভুল্ওয়াকে দিয়েছিল। ভুল্ওয়া চেটে চেটে সেই চকলেট খেয়েছিল।
মেয়ের জীবনে ‘স্কুল’ নামের যে জায়গাটা ছিল সেখানে সাদা ‘রোব’ পরা ‘মাদার’রা ঘুরে বেড়াত। ইংরেজ মাদার, জর্মন মাদার। হোমড়াই-চোমড়াই মাদারদের গর্জনে যেন পৃথিবী কাঁপত। স্কুল ‘করিডরে’ এক ফোঁটা কালি ফেলেছ কী মরেছ। সারা দিন একটা পাথর আর জল দিয়ে ঘষে ঘষে কালির দাগ তুলতে হত যতক্ষণ না মেঝে চকচক করে। অনেক নির্লজ্জ মেয়ে ছিল যারা পড়ায় ফাঁকি দেবে বলে ইচ্ছে করে কালি ফেলে দিত। কিন্তু এই মেয়ে যে ভিতু আর লাজুক! বলাই বাহুল্য, মেয়ের হাত থেকে প্রায়ই সব কিছু পড়ে যেত। বই-খাতা, পেন্সিল, কলমের কালি! ওমনি মাদার ‘সান্টাক্লস্’ এসে মেয়ের গলায় একটা ‘বোর্ড’ ঝুলিয়ে দিত, তাতে লেখা, ‘আই অ্যাম আ ক্লামজি ফুল’। তার পর এক ঘণ্টা ধরে ছোট ছোট হাত দিয়ে পাথর ঘষা, মেঝে পরিষ্কার করা, আর সবচেয়ে লজ্জা, একদল দস্যি মেয়ের হাসির খোরাক হওয়া।
সান্টাক্লসের আসল নাম ছিল ‘স্টানিস্লস’। কিন্তু তাকে সবাই কেন সান্টাক্লস্ বলে ডাকত সেটাই রহস্যের। সে মোটেই সান্টাক্লসের মতো গোলগাল, হাসিখুশি ছিল না। শুকনো কাঠের মতো রোগা আর খুব লম্বা ছিল সান্টা। মেয়েদের দেখলেই তার মুখ ভেটকে যেত। ‘গুড মর্নিং মাদর’ বললে কোনও উত্তর দিত না। ‘নেচার স্টাডি’র নাম করে মেয়েদের দিয়ে মাটি কোপাত আর কথায় কথায় শাস্তি দিত। মেয়ের কাছে সান্টা ছিল ‘যমরাজ’। ভুলেও তার মুখের দিকে তাকাত না কোনও দিন।
স্কুলে দু’এক জন বন্ধু ছিল মেয়ের। কিন্তু একদল দস্যি মেয়ের একটা গুণ্ডা-বাহিনী ছিল, যারা দুর্বল কাউকে পেলেই ধেয়ে আসত তার দিকে। সব জায়গাতেই তো এ রকম থাকে, তাই না? তা মেয়ের যা দু’এক জন বন্ধু, মেয়ের বিপদের সময় তারাও কিন্তু সেই গুণ্ডা-বাহিনীতে যোগ দিত। বাঃ, ওদের ভয় করত না? গুণ্ডাদের কথা না শুনলে যদি তারা মারে? তাই মেয়ের কাছে বন্ধু থাকাও যা, না থাকাও তাই। আর মেয়ের যে দোষ একটাই— সে অন্যমনস্ক! গুণ্ডারা ভাবত মেয়ে খুব ভিতু নেড়ি কুকুরের মতো। মেয়েকে মজা দেখাবার জন্য ফন্দি আঁটত তারা। একটা ‘লিডর’ গোছের হুমদো মুখওয়ালা মেয়ে, নিজের মুখটা মেয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বলত, ‘‘এই! দেখ মেরি আঁখোঁ মে, নহি তো কম্পস্ ভোঁক দুংগি।’’ সকলের কী হাসি। কিন্তু মেয়ের দোষ সে কিছুতেই চোখের দিকে তাকাবে না। মেয়ে এক জন মাদারকে খুব ভালবাসত— ‘মাদার এলিজাবেথ’। তার ছিল মিষ্টি হাসি আর একটা সুন্দর বাঁশি। কী মধুর সুর বেরোত সেই বাঁশি দিয়ে। ‘বিঠোভেন’, ‘শপাঁ’ বাজাতেন মাদার এলিজাবেথ। মেয়ে এক বার লুকিয়ে লুকিয়ে সেই বাঁশির গায়ে হাত বুলিয়েছিল। বাঁশিতে ঠোঁট দিয়ে ফুঁ দেবে, এই তার সাধ।
তার পর মেয়ের বড় হতে হতে হঠাৎ ভুল্ওয়া গেল হারিয়ে। এক দিন সে এল না। মেয়ে তাকে কত খুঁজল, কত কাঁদল। বাবাও খুঁজতে গেল, কিন্তু পেল না। তার নামই কেউ শোনেনি কোনও দিন। আর মেয়ের জীবন থেকে ক্রমে ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে গেল খুন্নিবুড়ির মুখ। মা আর ভয় পায় না। বাবা মাকে বুঝিয়েছিল, ‘‘ইট ওয়জ জাস্ট আ ফিগমেন্ট অফ হার ইম্যাজিনেশন।’’
মেয়ে কিন্তু খুন্নিকে ভোলেনি, ভুল্ওয়াকেও না। মেয়ে স্কুল ফাইনালে অমন নম্বর পেয়েছিল কী করে সে নিজেও বোঝেনি। ‘ফাইভ পয়েন্টস’, ‘স্টার মার্কস’! বোধহয় ভুল্ওয়ার জন্য। ‘‘দিদি, মন লগায়কে পঢ়ো, সবেরে জলদি জলদি উঠো, হাঁ? স্কুল পহুঁচায় দেবে। তুহার খাতির চাক্লেট লাউবে।’’ মেয়ে বলল, ‘‘জরুর লানা, ভুল না নহি।’’
‘‘হাঁ হাঁ দিদি, জরুর লাউবে,’’ আশ্বাস দিয়েছিল ভুল্ওয়া।
মেয়ে বড় হচ্ছে, তাই মা-বাবা বাদ্যি বাজিয়ে তার জন্যে রাজপুত্র আনতে চায়। মেয়ে বুঝল তার জায়গা বদলের সময় হয়েছে। সেই রাতে সে স্বপ্ন দেখল, কে যেন অন্ধকার থেকে ছুটে আসছে। কী সুন্দর তার মুখ। হঠাৎ সে একটা পরিকে কোথা থেকে তুলে নিল। পরি হাসছে কিন্তু তার ডানা ছিঁড়ে গেছে। হঠাৎ দুটো ডানাই খসে পড়ল, পরির মুখ আর দেখা গেল না। শোনা গেল দূর থেকে কান্না ভেসে আসছে আর এক বাঁশির সুরে আকাশ-বাতাস ভরে যাচ্ছে। কী করুণ সেই বাঁশির সুর, কী তীব্র। কান যেন ফেটে যায়। কান্নার আওয়াজ বাড়তে থাকে। কে কাঁদছে? মেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল। শরীর থরথর করে কাঁপছে। বাঁশির সুর যেন এখনও শুনতে পাচ্ছে। মেয়ে দেখল তার দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছে। মেয়ে ভাবে, সে কেন স্বপ্ন দেখল?— কিন্তু সে তো আর এক গল্প!
এই বার গল্পের শেষ। মেয়ে এক দিন বাবার ঘরে ঢুকে বই ঘাঁটছে, হঠাৎ সে দেখতে পেল তাকের এক কোণে একটা বাঁশি রাখা আছে। মেয়ে বাঁশিটা নিয়ে ছুটে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ বাঁশিটা…’? বাবা বলল, ‘‘এ হে হে! ভুল্ওয়া তোর জন্য মেলা থেকে এনেছিল, আমি ভুলেই গেছি দিতে।’’
মেয়ে আনন্দে পাগল হয়ে গেল। তার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল সে স্বতন্ত্র। এত ভালবাসা যাকে ঘিরে থাকে সে তো স্বতন্ত্রই! মেয়ে বুঝতে পারল মাদার সান্টাক্লস, গুণ্ডা বাহিনীরা কষ্টে থাকে তো, তাই কষ্ট দেয়। কিন্তু সে কাউকে কষ্ট দেবে না। কারও চোখ এড়িয়ে যাবে না। তার হাতে রয়েছে তার জাদুকাঠি তার স্বপ্নের বাঁশি! গল্প শেষ। এতক্ষণ মেয়ের নাম বলা হয়নি। এ তো তোমার আমার গল্প! তাই মেয়ের নাম তোমারই নাম।
সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ ফাল্গুন ১৪১৩ রবিবার ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭