১৮৯০-এর জানুয়ারিতে স্বামী বিবেকানন্দ গাজীপুর এলেন ধর্মের আকর্ষণে–পাওহারী বাবার সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশে। শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোভাবের পর স্বামী বিবেকানন্দ যেন বেশ কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। অন্তরে অনুভব করেন এক অতৃপ্তি জনিত অস্থিরতা। কোথায় গেলে, কার কাছে গেলে এই অস্থিরতার উপশম পাবেন সেই আশায় তিনি নানা তীর্থস্থান ভ্রমন করতে লাগলেন। অবশেষে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে তিনি গাজীপুরে পাওহারী বাবার আশ্রমে এলেন এবং এখানে এসে এই মহাত্মার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হলেন। ‘পওয়ারী’ কথার অর্থ বায়ু সেবনকারী। অর্থ পবন-আহারি, অর্থাৎ যিনি পবন বা বাতাস খেয়েই বেঁচে থাকেন। বারাণসী জেলার গুজী নামক স্থানের নিকটবর্তী এক গ্রামে ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন এই মহাত্মা।
পাওহারী বাবার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, পরম বৈষ্ণবোচিত আচরণ, অনাবিল চরিত্র মাধুর্য, সাধন শক্তি ও মধুর কণ্ঠস্বরে স্বামী বিবেকানন্দ আপ্লুত হয়ে পরলেন। তাঁর মনে উদয় হলো নতুন আশার আলো।
স্বামীজি নিজের ভাষায় তার অভিজ্ঞতার কথা শোনা যাক —’ইনি অতি মহাপুরুষ— বিচিত্র ব্যাপার এবং এই নাস্তিকতার দিনে ভক্তি ও যোগের অত্যাশ্চর্য অদ্ভুত নিদর্শন। আমি ইহার শরণাগত হইয়াছি। আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন। যা সকলের ভাগ্যে ঘটে না।’ (বিবেক সমগ্র প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ২২৪, রিফ্লেক্ট)
গাজীপুরে এসে প্রথমেই স্বামী বিবেকানন্দ উঠেছিলেন তার বাল্যবন্ধু ডন সোসাইটি খ্যাত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বাড়িতে। কিছুদিন পরে তিনি আশ্রয় নেন গগনচন্দ্র রায়ের গৃহে। গগন বাবুর বাড়িতে প্রতি রবিবার বসতো ধর্মসভা। সেখানে রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক সংগীতেরও আয়োজন করা হতো। গগন বাবুই স্বামীজির সঙ্গে পাওহারী বাবার সাক্ষাৎকার করিয়ে দেন। প্রায় তিন মাসকাল গাজীপুরে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এই পর্বে তার লেখা ২২টি চিঠি সংকলিত হয়েছে ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা’র ষষ্ঠ খন্ডে। এখানেই রয়েছে গগনচন্দ্রের প্রসঙ্গ।
শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত বলরাম বসুকে ৩০ জানুয়ারির এক পত্রে বিবেকানন্দ লিখলেন, — ‘… গগনচন্দ্র রায় নামক একটি বাবু আফিম বিভাগের Head (বড়বাবু) তিনি যৎপরোনাস্তি ভদ্র পরোপকারী ও Social (মিশুক)।’ ….’তুমি যদি গাজীপুর আইস, গোরাবাজারের সতীশবাবু অথবা গগনবাবুর নিকট আসিলেই আমার সন্ধান পাইবে।’
পাওহারী বাবা রামকৃষ্ণদেব কে জানতেন। তিনি তার যোগ্য শিষ্য বিবেকানন্দকে কাছে পেয়ে স্বভাবতই আনন্দিত হয়ে ওঠেন। উভয়ের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্কের স্থাপনা হল। স্বামীজি পাওহারী বাবার বাণীতে এমনই গুণমুগ্ধ হয়ে উঠলেন যে, তার চরণোশ্রিত হয়ে যোগ সাধনায় দীক্ষা নিতে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। পাওহারী বাবাও স্বামীজির প্রার্থনা শুনে যোগ দীক্ষা দিতে রাজি হলেন।
কথিত আছে, দীক্ষাদানের আগের দিন রাতে ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা। গুরু শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের কথা মনে হতেই স্বামীজি মাটিতে উঠে বসলেন। হঠাৎ অন্ধকার ঘর এক দিব্য আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো। দেবমানব রামকৃষ্ণ যেন করুণ দৃষ্টিতে তাঁকে ভর্ৎসনা জানাচ্ছেন। স্বামীজী বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। পরের দিন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। তিনি অনুভব করলেন করুণাময় গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ অসীম কৃপা গভীর ভালোবাসা তাকে বিপথগামী হতে বাধা দিচ্ছে। তিনি কৃতকর্মের জন্য তীব্র অন্তর্দাহ অনুভব করলেন। গুরুচরনে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। শেষপর্যন্ত পাওহারি বাবার কাছে স্বামীজিরার যোগ দীক্ষা হয়নি। তিনি গাজীপুর ত্যাগ করেন।
ভগিনী নিবেদিতা বলেছেন যে স্বামীজি গুরু হিসাবে পাওহারী বাবাকে শ্রীরামকৃষ্ণের পরেই স্থান দিতেন। বিবেকানন্দ একবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাবাজি! আপনি অসাধারণ যোগবলের অধিকারী। তবে কেন আপনি লোকালয়ে অবতীর্ণ হয়ে মানব কল্যাণে নিযুক্ত হননা?’ পাওহারী বাবা তাঁর স্বাভাবিক বিনয় ও রসিকতার সহিত স্বামীজীকে এক হাসির গল্প বললেন —
একবার এই দুষ্ট লোক একটি অপরাধমূলক কাজ করে ধরা পড়ে গেলে সকলে মিলে তাকে জোর করে তার নাক কেটে দেয়। লোকটা লজ্জায় লোকালয় ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। বনে একটা বাঘের চামড়া আসনে বসে চোখ বুজে সাধুর মতো ধ্যান করে। আস্তে আস্তে লোকেরা এই অদ্ভুত দর্শন সাধুকে দেখতে ভিড় জমায়। দর্শন করতে এসে তারা তাকে প্রণামী দিত। অরণ্যবাসে এত সহজে জীবিকানির্বাহের উপায় পেয়ে মৌনীবাবা খুব খুশিতে দিন যাপন করতে শুরু করেন।
একবার এক যুবক তার বিশেষ ভক্ত হয়ে উঠল সেই সাধুর কাছে দীক্ষা নিতে চাইলে কিছুতেই সাধু তাকে নিরাশ করতে পারলেন না। শেষে বলল কাল সকালে তোমাকে দীক্ষা দেবো। সঙ্গে একটা ধারালো ক্ষুর নিয়ে আসবে।
পরের দিন সকালে যুবক স্নান সেরে ক্ষুর নিয়ে সাধুর কাছে এলো, সাধু তাকে গভীর জঙ্গলে গিয়ে একঘায়ে তার নাক কেটে ফেলে দিল। তারপর যুবকটাকে বলল, শোনো একদিন আমিও এইভাবে দীক্ষা নিয়েছিলাম তুমি এইভাবে অন্যদের দীক্ষা দিও। কিছুদিন চুপ থেকে নাক কাটা তরুনও অন্যদের নাক কেটে দীক্ষা দিতে থাকে এইভাবে নাক কাটা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। গোটা দুনিয়ায় সেই নাককাটা সম্প্রদায় ছড়িয়ে পরে।
গল্প শেষ করে পাওহারি বাবা স্বামীজিকে বলেন, ‘তুমি কি এই দাস কে এমন এক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করতে বলছো? তুমি কি মনে কর স্থূল দেহ দ্বারাই কেবল অপরের উপকার করা সম্ভব! শরীর নিরপেক্ষ একটি মন তার চারিদিকের অসংখ্য মানব মনকে প্রভাবিত করতে পারে। মহাত্মা পাওহারী বাবার মহানুভবতার পরিচয় পেয়ে স্বামীজি আর কথা বাড়ালেন না।
পাওহারি বাবা সাক্ষাৎভাবে উপদেশ দিতে পারতেন না; কারণ তাহলে তাকে আচার্যের পদ গ্রহণ করতে হতো এবং অপরের অপেক্ষা আচার্যকে উচ্চতর আসনে বসতে হতো, যেটিতে তিনি মোটেও রাজি হতেন না।
কিন্তু একবার তাঁর হৃদয়-প্রস্রবণ খুলে গেলে তা হতে অনন্ত জ্ঞানবারি উৎসারিত হতো, তবুও তাঁর উত্তরগুলি সর্বদা সাক্ষাৎভাবে না হয়ে পরোক্ষভাবে হতো।
পাওহারী বাবার কাছে যে প্রত্যাশা নিয়ে বিবেকানন্দ গাজীপুর এসেছিলেন, সে বিষয়ে ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে তাঁকে ফিরতে হয়েছিল বটে কিন্তু দুজন মহান মানুষের গাজীপুরে সাক্ষাৎকার বাঙালির সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
একেবারেই অজানা তথ্য জানা গেলো। ধন্যবাদ।
থ্যাংক ইউ ❤️
তোমার পরিশ্রমের ফল সব পাঠককে ঋদ্ধ করে, এ পরমপ্রাপ্তি, ধন্য হোলাম।
আনন্দিত হইলাম 😊❤️