স্বামী বিবেকানন্দ পরিব্রাজকরূপে মঠ ত্যাগ করেন ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। পাঁচ বছর ধরে এই ধর্মীয় পরিব্রাজক জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গী ছিল একটি কমণ্ডলু, লাঠি এবং তার প্রিয় দুটি গ্রন্থ ভগবতগীতা ও ঈশানুসরণ। ভিক্ষোপজীবী হয়ে সারা ভারত পদব্রজেই পর্যটন করেন। এই স্বাধীনভাবে পর্যটনে প্রত্যেক শিক্ষাকেন্দ্র দর্শন করেন এবং বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সুপরিচিত হন। ভারতমাতার দরিদ্রনারায়ণের সুখ-দুঃখের বারোমাস্যার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়নে স্বামীজীর জীবনের শ্রেষ্ঠ কয়েক বছর কাটে পরিব্রজ্যায়। সমাজ পরিবর্তনে তাগিদে অবহিত হতে চেয়েছেন তাই দেশের ক্ষমতাবানদের চিন্তাধারা ও জীবনধারা সম্বন্ধে জানতে চেয়েছেন। সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্টের প্রতি সহানুভূতি তাঁকে জাতির উন্নতিকল্পে আত্মনিয়োগ করতে অনুপ্রাণিত করেছে।
বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার সময় বহু মানুষ তাঁর সান্নিধ্য পান, নানান ঘটনার সাক্ষী থাকেন তাঁর ভক্তরা। কত অনায়াসে যে কোন জিনিস ত্যাগ করে দিতে পারতেন স্বামীজি। তার কয়েকটির উল্লেখ করি —
১৮৯০ সালে স্বামী অখণ্ডানন্দকে সঙ্গে নিয়ে কুমায়ুনের পথে পথে বেরিয়ে পড়েন পরিব্রাজক বিবেকানন্দ জ্ঞানের খোঁজে। নবীন সন্ন্যাসী হাতে দন্ড, কমন্ডলু নিয়ে পায়ে হেঁটে কাঠগোদাম থেকে নৈনিতাল হয়ে চলেছে আলমোড়া। পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে মাধুকরি করে ক্ষুধা তৃষ্ণা নিবারণ করছেন। যাত্রার তৃতীয় দিনে পথে কাকরিঘাটে এক নির্জরনীর ধারে অশ্বত্থ গাছের ছায়াতলে বিশ্রাম নিতে বসে ধ্যানমগ্ন হলেন। সম্বিত ফিরে আসতে স্থির কন্ঠে বললেন, ‘দেখ গঙ্গাধর, আজ আমার জীবনের পরমলগ্ন। অনুপরমানুর মধ্যে সারা ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিফলন দর্শন লাভ ঘটল আজ এইমাত্র আমার!’
এরপর শুরু হলো আবার পথচলা। সেদিন সারাদিন কোন ভিক্ষা মেলেনি। অভুক্ত শরীরে দুর্গম চড়াই উতরাই পথে আলমোড়া পৌঁছনোর কিছু আগে স্বামীজি ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে অবসন্ন দেহে প্রায় সংজ্ঞাশূন্য হয়ে পথের ধারে ধুলোয় শয্যা নিলেন। পাশেই ছিলো এক মুসলিম কবরখানা। অখন্ডানন্দ ছুটে যান জলের সন্ধানে। কাছেই পর্ণকুঠির থেকে বেরিয়ে আসেন এক মুসলিম ফকির, হাতে তার একফালি শশা। স্বামীজিকে খেতে দিলেন সেই একফালি শশা।
স্বামীজির তখন এমনই দুর্বল অবস্থা যে হাতে তুলে শশাটি খাওয়ারও সামর্থ্য নেই।ফকিরকে বললেন তিনি যেন তাকে খাইয়ে দেন। হিন্দু সন্ন্যাসী দেখে কুণ্ঠিত ফকির বল্লেন, ‘আমি যে মুসলিম।’
স্বামীজি মৃদু স্বরে বলে উঠলেন ‘মানুষ মাত্রই তো আমরা সবার ভাই।’
এর সাত বছর পর ১৮৯৭ সালে আবার কুমায়ুন হিমালয়ে ফিরে আসেন স্বামীজি। তখন আর তিনি অজ্ঞাতনামা সন্ন্যাসী নন, বিশ্ববরেণ্য ভুবনজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ। দেশের যেখানেই তিনি যান প্রাণঢালা সংবর্ধনা পান। আলমোড়ায় সেদিন তেমনি এক সংবর্ধনায় স্বামীজি উপস্থিত হয়ে হঠাৎই দেখতে পান সেই মুসলিম কবরখানার ফকিরকে।বিবেকানন্দ তাকে ডেকে এনে নিজের পাশে বসে সবাইকে আবেগময় কন্ঠে বলেন, ‘ইনি প্রকৃতই আমার প্রাণদাতা। সাত বছর আগে সেদিন আমার সেই মুমূর্ষ অবস্থায় জীবন রক্ষা না করলে আজ আমার এই সংবর্ধনা লাভ হতো না তাই আজকের মূল সন্মান এঁরই প্রাপ্য।’
ফকির অবশ্য স্বামীজিকে চিনতে পারেননি কিন্তু স্বামীজি তাকে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন।কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায়, জীবন রক্ষাকারী ফকিরকে বক্ষে টেনে নিয়ে উপহার দিলেন কিছু টাকা।
স্বামীজি বলতেন ‘রমতা সাধু বহতা পানি’। অর্থাৎ সাধু যদি প্রবাহমান নদীর মত অবিরাম চলতে থাকেন তবে সেই স্রোতস্বীনিতে ময়লার নোংরা জমে না, সাধুর জীবন থাকে নিষ্কলুষ পবিত্র। কত তীর্থে কতভাবে বিরাজিত থেকে ভগবান ভক্তের পূজা গ্রহণ করছেন, কৃপা বিতরণ করছেন। আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক বেঁচে থাকা ও চেনা পরিসরের বাইরেও গভীর আনন্দপূর্ণ অতীন্দ্রিয়ভূমির অস্তিত্ব আছে যেখানে প্রবেশ করতে গেলে দরকার অনুভবযোগ্য অধ্যত্মদর্শন৷ স্বামীজির জীবন থেকে আমরা সেই সদর্থক পথে চলতে পারি। সেখানে রয়েছে জীবনের আলো ও আনন্দের শিখা।
পরিব্রাজক স্বামীজি বেঙ্গালুরুতে মহীশূর রাজ্যের দেওয়ান স্যার কে শেষাদ্রি আইয়ারের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ১৮৯২ সালে তিনি মহীশুরের রাজা শ্রী চামারাজেন্দ্র ওয়াদিয়ারের রাজপ্রাসাদে অবস্থান করেন। মহীশূর মহারাজের রাজকীয় আতিথ্য ছেড়ে যখন তিনি বিদায় নিতে যান, তখন মহারাজ বিনীত অনুরোধ করেন কিছু মূল্যবান উপহার নিতে।স্বামীজি জানান সন্ন্যাসীর পক্ষে কোন জিনিসই গ্রহণীয় নয়। তবুও মহারাজ আন্তরিকভাবে কোন একটি উপহার গ্রহণের জন্য পীড়াপিড়ি করতে থাকেন। অগত্য স্বামীজি বলেন, ‘আচ্ছা মহারাজ, আমাকে যদি একান্তই একটা কিছু নিতে হয় তবে ধাতু সম্পর্কহীন একটি হুঁকো দিন। ওটা আমার কিছু কাজে লাগবে।’
মহীশূর মহারাজ তখন কারুকার্য খচিত রোজ উড (কারো কারো মতে চন্দন কাঠের) নির্মিত একটি অপূর্ব হুঁকো উপহার দেন স্বামীজিকে।
কিছুদিন পরে স্বামীজি আসেন মাদ্রাজ বা আজকের চেন্নাইয়ে। সেখানকার সহকারী অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল মন্মথনাথ ভট্টাচার্যের বাড়িতে থাকতে একদিন স্বামীজী লক্ষ্য করেন মহীশূর মহারাজের প্রদত্ত রোজ উডের হুঁকোটির দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে মন্মথনাথের পাচক। বিবেকানন্দ মধুর কন্ঠে একদিন পাচকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কি এটা চাই?’
হ্যাঁ বলো তো দূরের কথা, থতমত খেয়ে পাচক কোনো উত্তরই দিতে পারল না। মুহূর্তের মধ্যে স্বামীজি তার শখের সযত্নে রাখা নিজের হুঁকোটি পাচকের হাতে তুলে দিলেন। পাচক তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না এও সম্ভব! কিন্তু একটু পরেই তার চেহারা কৃতজ্ঞতা ছাপ জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠলো।
একবার আলোয়ার থেকে বান্দিকুই স্টেশন হয়ে ট্রেনে জয়পুর গিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। সেখানে তিন চার দিন সংসারচন্দ্র সেনের বাড়িতে ছিলেন। দেহ সেবামায়, প্রাণ আনন্দময়, মন গানময় স্বামীজীর উপস্থিতি মানেই অনবদ্য গানের আসর। সেই বাড়ির চারচালার মত ঘরের বৈঠকখানায় বসতো গানের আসর। স্বামীজির সঙ্গে তার ঝরাতেই থাকতো গানের খাতা প্রথমে তিনি গাইলেন গিরিশ ঘোষের বুদ্ধচরিত-এর ‘জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই’, ‘এলো কৃষ্ণ এলো ওই বাজালো বাঁশরী’, ‘যাব কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে’, প্রভৃতি গানের সকলকে গীতসুধারসে আপ্লুত করে বিদায় বেলায় গানের খাতাটি উপহার দিয়ে গেলেন সেই বাড়ির ছোট মেয়ে জ্যোতির্ময়ী দেবীকে। উপহারটি ছিল অত্যন্ত মূল্যবান কেননা সেই খাতায় ছিল বিবেকানন্দের নিজের লেখাও বেশ কয়েকটি গান।
আমরা ত্যাগ বলতে যে ধারণা করি স্বামীজি তার বহু ঊর্ধ্বে ছিলেন। তার মনটি ছিল অতি সূক্ষ্ম ভাবগ্রাহী যন্ত্রের মত তার কোন বস্তুর প্রতি অপরের মনে ছায়াপাত হলে তা তিনি কাছে রাখা কষ্টকর মনে করতেন। “যে বীর, সে-ই ত্যাগ করতে পারে”; স্বামীজি শিখিয়েছিলেন নিঃস্বার্থ সেবায় চারিত্রিক উন্নতি সর্বশ্রেষ্ঠ সোপান। এর সঙ্গে বলেছিলেন, ত্যাগ, স্বার্থপরতা বিসর্জন এবং কর্মফলে অনাসক্তির কথা। এই সেবা ও ত্যাগই আমাদের জাতীয় আদর্শ। স্বামীজির ১৬২ তম জন্মদিবসে সেই পথকে চলুন আমরাও অনুসরণ করি।
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার : স্মৃতির আলোয় স্বামীজি–সম্পাদক স্বামী পূর্ণাত্মনন্দ, পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়,উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য।