“সুও দুও ভাসে, টাকা কড়ি আসে”, উত্তেজনায় রিনির রিনরিনে গলা উচ্চগ্রামে। রিনি চেঁচাচ্ছে আর ছড়ার তালে তালে ট্যাঙ ট্যাঙ কাঁসর বাজাচ্ছে। আজ গঙ্গায় সুওদুওর নৌকাভাসান। রিনির ছোটকার দুহাতে দুটো খেলনার নৌকা। শান্তিমাসির হাতেও তাই।
শীতের দুপুরের রোদ্দুরে ছেঁড়া চটের ওপর আরামে কুন্ডলী পাকিয়ে ভুলোটা রোজ ঝিমোয়। কাঁসর আর রিনির মিলিত চিৎকারে সে চমকে উঠল। তারপর কানটান নেড়ে রিনির পেছু পেছু ল্যাজ নাড়তে নাড়তে চলল।
শম্পা মায়ের সঙ্গে ছাদে বসে নতুন বইয়ে মলাট দিচ্ছিল। রিনির চেঁচামেচি শুনে ছাদের পাঁচিল থেকে গলা বাড়িয়ে রিনিকে জিজ্ঞেস করল,
— কোথায যাচ্ছিস রে রিনি?
— গঙ্গায়। সুও দুও ভাসাতে। তুই যাবি? আয় না। খুব মজা হবে।
সারা দুপুর ধরে ছোটকা আর ঠাম্মির সঙ্গে রিনি সুও দুও সাজিয়েছে। অজিত কাকা বাজার থেকে খুঁজে খুঁজে এনে দিয়েছে জোড়া সাদা সীম, জোড়া কুল, জোড়া কড়াইশুঁটি।
— ঠাম্মি এমন জোড়ায় জোড়ায় কেন সব?
— একটা বর আর একটা বৌয়ের। এরা কখনো আলাদা থাকতে পারে!
— কাঠিতে কড়ি কেন গুঁজলে ঠাম্মি? — অনেকদিন আগে যখন টাকা পয়সা চালু হয়নি, তখন তো কড়ি দিয়েই লোকে জিনিস কিনত।
— আর এই সুও দুও নৌকাপুজো!
— সে অনেককাল আগের কথা। আমাদের বাড়ির কর্তারা বড় বড় নৌকা করে কোন দূর দেশে বাণিজ্য করতে যেত। তাদের মঙ্গলের জন্যে এই ব্রত।
— কোন দেশে যেত ঠাম্মি ?
— সে কতকাল আগে! আমি কি ছাই অত জানি!
বাণিজ্য সফরে সপ্তগ্রামের বণিকরা একসময় তরী ভাসাত মলয়াদেশ, শ্যাম দেশ, সিংহল পাটন আরো কোন দূরদুরান্তে! সেকালের সেই সময়ে সৌদামিনী নামে এক সুন্দরী বধূ তার তরুণ স্বামীর মুখে সেই সব দেশের নাম শোনে। তার মনেও অপার জিজ্ঞাসা। অগাধ কৌতুহল। সংশয়।
জলের কি অমোঘ টান! সাগরের ঘুর্ণিপাকে সওদাগর ভেসে চলে তার বাণিজ্য পোতে। ভুলে যায় ঘরগেরস্তি, সুন্দরী স্ত্রীর প্রেমময় আলিঙ্গন।
ষোড়শী সৌদামিনীর বুক কাঁপে। রাতের নিভৃত শয্যায় স্বামীর কন্ঠলগ্ন হয়ে সে বলে, “সব ধনরত্ন কি সাগরের গভ্ভে! ড্যাঙায় কি বেসাতি হয় না আপনাদের”।
তরুণ স্বামীটি হেসে বলে, “সাত পুরুষ ধরে দেশেবিদেশের বন্দরে বন্দরে আমরা সওদাগরি করি। আমাদের কি ঘরে বসে থাকলে চলে সদু!”
সৌদামিনী বোঝে জলের সঙ্গেই তার সোয়ামীর প্রেমপীরীতি। ঢেউয়ের দাপট, ঝড়ঝঞ্ঝার মোকাবিলা, নতুন দেশ দেখার রোমাঞ্চের কাছে তার শরীরের আকর্ষণ নেহাতই ফ্যালনা।
প্রতিদিন তার শরীরে হলুদচন্দনের রূপটান, বেগমফাঁস খোঁপার মালতীমালা, চোখের কাজল, নুপূরের নিক্কণ, চুড়ির কিঙ্কিনী সব মিথ্যে হয়ে যায়।
বেনের পো ঘরের আরামে হাঁফিয়ে ওঠে। বাপ-ভাইয়ের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে। তাদের চোখে যে নীল সায়রের ঘোর!
ডাক পড়ে হারু ছুতোরের। সে দলবল নিয়ে এসে পুরনো ডিঙা মেরামত করে। নতুন ডিঙা সাজায়। কাঁঠাল, শাল, পিয়াল গাছের কাঠে গড়ে ওঠে নতুন হংসবাহিনী নাও। ছেনি হাতুড়ির ছন্দে ছন্দে নৌকার গায়ে ফুল ফোটে। হাঁসের পাখায় রঙ লাগে। নৌকার তলদেশে পড়ে লাক্ষার প্রলেপ। সাদা পালে শিল্পী আঁকে সূর্য, চন্দ্র, দেবদেবী, মেঘ, ডানামেলা পরী। গাঁ- গেরামের ধার ঘেঁষে দত্তদের সপ্তডিঙা ভেসে যায়। ঘোমটা টানা বৌ কাজ ভুলে, আদুল গায়ের বালক খেলা ফেলে হাঁ করে তাকিয়ে দেখে এমন নৌবহরের দিকে। মাঝিরা দাঁড় টানে সারিগান গেয়ে।
নৌকাযাত্রার আগে ভারি ব্যস্ততা বণিক মহল্লায়। নৌকায় চড়ে বিদেশে পাড়ি দেবে অবলা হরিণের পাল, ঝোঁটনবাঁধা নোটন নোটন পায়রা। গৌড়ের গুড়ের নাগড়ি, কুঁচফল, পাটের বালাপোশ, উলুঘাসের শীতলপাটি, রান্নার হলুদ, আয়ুর্বেদের অব্যর্থ ওষুধ আমলকি, হরিতকি, বহেরার ভারে ভারে ভ’রে ওঠে নৌকার খোল।
সৌদামিনীর শাশুড়ি খবর পাঠায় দৈবজ্ঞ গণক ঠাকুরকে,
— দ্যাকো তো ঠাকুর, বাপবেটায় আবার ভাসবে সমুদ্দুরে। তুমি গুণেগেঁথে শুভদিন দ্যাখো। আমি গৃহ দেবতার পুজো সাজাই। মকরবাহিনীকে পেসন্ন করি।”
গণকঠকুরটি নাকে নস্য ঠুসে মেঝেতে আঁক কাটে। পুঁথি খোলে। গ্রহতারা হাতড়ায়। তারপর মাথা নেড়ে বলে, — আশেপাশে সব দিনে যাত্রা নাস্তি। ত্র্যহস্পর্শ। কোনো শুভ লক্ষণ নেই। একমাত্র আগামী কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ তিথি শুভদিন মা ঠাকরুণ। সেদিন নদীতে যখন জোয়ার আসবে, দু্গ্গা দুগ্গা বলে তরতর করে পাল তুলে কর্তাদের ডিঙি ভাসাতে বোলো।
— তাই হবে ঠাকুর। তবে প্রতিবারের মত এবারও নৌকা যাত্রার আগে গ্রহশান্তির জন্যে হোমযজ্ঞ করতে ভুলোনিকো।
— নিশ্চিন্তে থেকো মাঠাকরুণ। যজমানের কল্যাণই আমার কল্যাণ।
সিধে আর দক্ষিণা নিয়ে গণকঠাকুর বিদায় নেন।
সৌদামিনী চোখের জলে সোয়ামীর ধুতি, পিরান, চাদর, পাগড়ি, আঙরাখা, ভোটকম্বল, গামছা গোছ করে। মুক্তোর মালা, হাতের বালা, কানের কুন্ডল চন্দন কাঠের কৌটোয় সাজিয়ে রাখে। গন্ধতেল, কাঁকই, নিম আর বাবলা দাঁতন, মুখশুদ্ধি, মৃগনাভি সুগন্ধি দিতে ভোলে না। কবিরাজের কাছ থেকে আনা জ্বরজারি, অম্ল, শূলবেদনার শিকড়বাকড় ওষুধ যত্নে সঙ্গে দেয়।
সৌদামিনী শুনতে পায় শাউড়ির হাঁকডাক। ভাঁড়ার থেকে তিনি মশলা পাতি বে’র করে পাঁচুর মাকে বকাবকি করছেন,” হ্যাঁ লা কানের মাতা খেয়েছিস নাকি! কখন থেকে বলছি মধু নাছদুয়ারে দাঁইড়ে আছে। ওর হাতে এগুলো দিয়ে আয়।”
নৌকার রান্নার পাচককে সাবধান করছেন, “কর্তার বয়স হচ্ছে। মাঝেমদ্যে শূলবেদনায় ভোগেন। তুমি ওঁনার খাবারপথ্যির দিকে বিশেষ নজর রেখো। ছেলেদের আমার দুধদই, পরমান্ন দিয়ে নাড়ি কাটা। সেকতা ভুলোনিকো।
পাচকঠাকুর হাত কচলে, পেন্নাম ঠুকে বলে, “এজ্ঞে কত্তামা”।
বাণিজ্য যাত্রার আগে এত তোড়জোড়, ব্যস্ততায় সৌদামিনীর পতিদেবতাটির মন হাওয়া লাগা পালের মতই উড়ুউড়ু, উদাসীন।
কি আছে সেই দূরের অজানা দেশে! ঝিনুকের মালা, শঙ্খবলয় পরা মেয়েরা কতটা সুন্দর! সৌদামিনীর বুক কাঁপে।
গেলবার বেনের পো সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে এল, যেন রাজ্য জয় করেছে। লাভের অন্ত নেই! নৌকা ভরে যত নিয়ে গিয়েছিল, ফিরে এল তার দ্বিগুণ। মুক্তামণিমানিক্য, পলা, শঙ্খের গহনা, কর্পূর, লবঙ্গ, জিরা, কুঙ্কুম, কস্তুরী, গন্ধচুয়া, সৈন্ধব লবণ আরো কত কি।
সোয়ামীর সোহাগে আদরে উপহারের ঘটায় সৌদামিনীর জীবনে তখন হাজার তারার আলো। সারারাত কেটে যায় কত গল্পে! দেশদেশান্তরের অজানা কাহিনীতে, সাগরের লহরে লহরে কত রহস্য! নদীর বাঁকে, নোঙরফেলা সমুদ্দুরের বন্দরে মানুষগুলোর কথা সৌদামিনী অবাক হয়ে শোনে। উত্তেজনায় তার মুখে কথা সরে না। ইচ্ছে করে মাথা থেকে একটানে ঘোমটাটা খুলে ফেলে সেও ভেসে পড়ে স্বামীর সঙ্গে ঢেউয়ের তরঙ্গে।
কিন্তু হায়, তার পায়ে যে নুপূরের বেড়ি! দু-হাতের মকরমুখো বালায় কয়েদীর শৃঙ্খল। বারো হাত কাপড়েও তার কাছা হয় না! নারীত্বের বন্ধনে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা !
কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদের সকাল থেকে দত্তদের বাড়িতে বড় হাঁকাহাঁকি। হৈ চৈ। ঠাকুরঘরে মঙ্গলারতি। বরুণ দেবতার পুজো। প্রদীপের উত্তাপ। চোখের জল, মায়ের আশিস, শঙ্খ আর ঊলূধ্বনিকে পিছনে ফেলে রাজনগর ঘাট থেকে সপ্তডিঙা ছাড়ল। যাবার কালে মা বলল, “যাই বলতে নেই বাবা, বলো আসি”।
পূব দক্ষিণ খোলা লতাপাতা আঁকা ঘরে, নক্সাকাটা পালঙ্কে এরপর সৌদামিনীর কিবা দিন, কিংবা রাত্রি! দুধননীতে অরুচি। সিন্দুকভরা অলঙ্কার, পেটিভরা রেশমশাড়ি অযত্নে পড়ে থাকে। ননদ শুধোয়, বৌদিদি বিন্তি খেলবে?
“ভালো লাগছে না রে”
সূয্যি পাটে নামলে শান্তিঝি বলে, “এসো বৌমণি, মাথা বেঁধে দিই।”
একঢাল কালো চুল এলোপাকে জড়িয়ে চরম উদাসীনতায় বিরহিনী বলে, “আজ থাক”।
খাঁচা খুলে সবুজ টিয়াকে মুক্তি দিয়ে সৌদামিনী বলে, তোরাই বা কেন আমার মত বন্দি থাকবি! যা উড়ে যা, যেখানে মন চায়!”
পৌষ মাসের সন্ধ্যেয় জানলা দিয়ে কনকনে উত্তুরে হাওয়া এসে হাড় কাঁপিয়ে দেয়। সৌদামিনী বাইরে তাকিয়ে দেখে। তার জীবনের মতই পৌষের কুয়াশায় নদীর চরাচর ঝাপসা।
বিবর্ণ জীবনের রঙ ফিকে হতে হতে একদিন এক রঙিন স্বপ্ন দেখে সৌদামিনী। সে ভেসে চলেছে ময়ূরপঙ্খী নাওয়ে। মাথায় তার উষ্ণীষ, কপালে শ্বেত চন্দনের তিলক। মোহানা পেরিয়ে সাগরের পথে সে দেখছে সবুজ গ্রাম, ছোটো কুটির, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, হলুদ সর্ষের খেত। কোথাও বা ঘন জঙ্গল, অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা ভীরু হরিণের পাল। আকাশের বুকে মালার মত ভেসে যাচ্ছে বকের পাঁতি। আকাশের রঙ ধার করে নীলাম্বরী শাড়ির মত জলের রঙ কখনো নীল। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে লাল, সোনালী, কমলা রঙের খেলা জলের স্রোতে। রাতে চাঁদের আলোয় চিকমিক করে কালো জল। সাগরে পড়তেই প্রবল স্রোতে দুলছে তার নৌকা। নোনা জলের ছিটে পড়ছে তার চোখে মুখে। সমুদ্দুর এবার আছড়ে পড়ল তটভূমিতে। সেখানে ফেনায় ফেনা, ঝিনুকের মেলা!
স্বপ্ন ভেঙে যায় সৌদামিনীর।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। খাস দাসী শান্তিকে বলে, যা তো বাগান থেকে এখুনি কলার পেটো নিয়ে আয়। ঘরে দোর দেয় সে। আহার ফিরিয়ে দেয়। বলে, জ্বর এসেছে। পেটো কেটে নৌকা বানায়। সিঁদুর, কাজল, হলুদ ফোঁটায় সেজে ওঠে দুটি নৌকা। তাতে লাগে রেশম কাপড়ের ছোটো ছোটো পাল। একটির নাম সুও। অপরটির নাম দুও।
শান্তি বলে ,
— বৌমণি তোমার সোনার খাটে গা, আর রূপোর খাটে পা! তোমার নৌকো দুও হতে যাবে কোন দুঃখুতে!
— ও তুই বুঝবি না। দুও আমার দুঃখ দিনের গান। সুও আমার কল্পনার সুখপাখি। প্রদীপ জ্বালিয়ে আজ সুও দুও ভাসিয়ে দেব নদীতে। দেখব, কে যেতে আর কে হারে! বল না শান্তি, আমার সুওদুও কেউ কি ভেসে যেতে পারবে না কোন দূরের অজানা দ্বীপে, দ্বীপান্তরে! সেখানে এক নতুন রাজ্য। শঙ্খের রাজপ্রাসাদে ঝিনুকের কারুকাজ। সেখানে থাকে রাজা -রাণী-রাজকন্যে-রাজপুত্তুর।
হাসি, গান, আলোয় আলো চারিধার!
যা শান্তি রাজনগরের ঘাটে ভাসিয়ে আয় আমার সুওদুওকে। আমি এই খিড়কি থেকে দেখব, আমার সুওদূও ভেসে চলেছে। কোনো এক নাম না জানা রূপকথার দেশে!”
পৌষ সংক্রান্তিতে সৌদামিনীর স্বপ্ন নিয়ে সুওদুওরা এখনো ভাসে।
সৌদামিনীর সে স্বপ্নডিঙায় একালের রিনিরা আশার প্রদীপ জ্বালে। ইচ্ছের পাল তোলে। উদ্যমের হাওয়া লেগে সে সুওদুও তরতর করে এগিয়ে যায়…