জয়সোয়ালদের কোঠিতে দেওয়ালির ঝাড়াইসাফাই শুরু হয়েছে। কোঠির গায়ে বর্ষা তার ছাপ ছেড়ে গেছে। বাড়ির ছোটো নাতি পাপ্পু বায়না ধরল, “ছ্যাতলা পড়া দেওয়ালে রঙবিরঙী আলোর ঝালর খুব খারাপ দেখাবে। পোতাই করাও না পাপা”।
পাপ্পুর কথায় বাইরের দেওয়ালটুকু নমো নমো করে রঙ করা। এইসব কাজের সঙ্গে ধারাবিবরণীর মত চলছে লছমীবহুর খ্যানখেনে গলায় চিৎকার।
রান্নাঘরে মহারাজকে গিয়ে একবার ধমকে এল, “কাল দাল-সবজি সবমে ইতনা নমক কিঁউ ডালে থে! জানো না আমি রোজ বি, পির গোলি খাই! মারোগে কেয়া মুঝকো! আজ বুঝেশুনে রান্নায় নুন দেবে।”
বেচারী বুড়ো পাচকটি লছমীভাবীর চিল্লমচিল্লিকে খুব ভয় পায়। হাত কচলে সে শুধু বলল, “জী ভাবী।” মনেমনে ভাবল, এত চেঁচালে বিপি বাড়বে বৈ কমবে না!
কাপড়কাচার বাঙালি মেয়ে কাবেরীকে যেই না লছমী বলেছে, “কাপড়ে ময়লা থাকলে এমাসের অর্ধেক পয়সা আমি কেটে নেব!”
সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিনী তড়পে উঠল, “আমি এক্ষুনি কাজ ছেড়ে দেব তোমাদের। আমার সব হিসেব মিটিয়ে দাও। দেখি রোজ রোজ কাঁড়ি কাঁড়ি কাপড় ধোওয়ার লোক কোথাও পাও তুমি! সব বাড়িতে মেশিন হয়ে গেছে! এই কিপটে মেড়োরাই হাতে এখনো কাপড় কাচাবে!”
ব্যস আর যায় কোথায়! লছমীবহুর হোমে যেন ঘিয়ের আহুতি পড়ল। মেজাজ সপ্তমে তার। গলার আওয়াজ তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর।
“কি বললি তুই! আমরা মেড়ো! জাত তুলে কথা বলিস। তোরা কি! শালা মছ্ছীখোর বঙ্গালী! দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে। একটা পয়সাও পাবি না।” প্রতিবেশীদের কান ঝালাপালা করে সারা সকাল চলতে থাকল লক্ষ্মীর পাঁচালি।
বুড়ি শাশুড়ি ভাবে, কি কুক্ষণেই না কর্তা ছেলের জন্যে এই কুলক্ষণীকে পছন্দ করেছিল!
বিনীত তখন জোয়ান হয়েছে। বাপের সঙ্গে কারোবার সামলাচ্ছে। গদ্দী থেকে এসে বিনীতের পাপা একদিন বলল, “বিনীত কি মাম্মী, এবার ছেলের তো বিয়েশাদীর ব্যবস্থা করতে হয়! একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা আমাদের পালটি ঘর। বড়াবাজারে এদের মশলার পাইকারি দুকান। তারাও নাকি রাজস্থানের নাগোর জেলার। লেড়কি কা ফোটু দেখি হমনে। নাম ভি লছমী। মেয়ে সাক্ষাৎ লছমীর মত সুন্দর — সুশীল। বিয়ের কথাবার্তা বলি!
বিনীতের পাপাজীর ওপর কোনোদিনই কথা বলেনি বিমলা। সদলবলে একদিন মেয়ে দেখে এল। লছমী সত্যিই সুন্দর। গোরীচিট্টি। ঘিউ-মাক্ষন খাওয়া গোল গোল কোমল হাত পা। নাকনক্সা ভি খাপসুরৎ। না লম্বা না বেঁটে। রোগাও নয় মোটাও নয়। বিনীতের পাশে বেশ মানাবে!
হৈ হৈ করে বিনীত ব্যান্ডবাজা বাজিয়ে, ঘোড়ীতে চেপে বিয়ে করতে গেল। নয়ীবহু যখন ঘরে এল, সব রিস্তেদারেরা বলল, এ তো নামে লছমী, রূপেও তাই!
প্রথম প্রথম ঘোমটা টানা বহু চুপচাপই থাকত। এক দুবছর পর লছমী রূপ বদলে কালীমাতার মত ভয়ঙ্কর হয়ে গেল!
বিনীতকে সন্দেহ থেকে শুরু। সেখান থেকেই খিটপিট। বিনীতের অবশ্য একটু ছুঁকছুঁকানি রোগ আছে, সে কথা অস্বীকার করতে পারে না বিমলা।
কিন্তু একি! বন্ধঘরের ঝগড়া একসময় বাইরে বেরিয়ে এসে সব যেন বেপর্দা হয়ে গেল। শ্বশুর ছাড়া কাউকে রেয়াৎ করত না লছমী। তা সে শ্বশুর ও একদিন স্বর্গ গেল।
বড়া পরিবার জয়সোয়ালদের। কাপড়ের ব্যবসা সব একসঙ্গে। একতলায় ভাসুররা থাকত। তিনতলায় দেবরকা ফ্যামিলি। দুসরে মঞ্জিল পর বিমলার পরিবার। খানাপিনা সব আলাদা। তবু লছমীর সহ্য হল না। ছোটোমোটো কারণে ঝগড়া করে ওদের তাড়াল। এখন ওদের সব ঘর তালাবন্ধ। বাড়ি শুনশান। খালি লছমীর চিৎকারে বাড়ি যেন থরথরিয়ে কাঁপে।
তিন পুরুষের কাপড়ের কারোবার জয়সোয়ালদের। কবে বিনীতের পরদাদা মুলুক থেকে এসে কোলকাত্তার বড়া বাজারে ধান্দা শুরু করেছিল! রাজস্থানের নাগোর জেলায় এখনো তাদের কুলদেবী ভবানী মাতার মন্দির আছে। বিয়েশাদীর পর সেখানে গিয়ে মাথা ঠেকিয়ে আসে জয়সোয়ালরা।
বাড়িতে তখন কত লোক! পরপর সব ছেলেপুলেদের বিয়ে হল। হাসি-মজাক, ব্যান্ডবাজা বরাত। বাড়ির মেয়ে-বৌদের গদ্দী থেকেই বারো মাসের পরনের শাড়ি আসত। রঙবেরঙের শাড়ি যখন ধুয়ে ছাদ থেকে মেলে দেওয়া হত, জয়সোয়াল কোঠিতে যেন তখন ইন্দ্রধনুষের ছটা! সে সবকথা ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিমলা।
পালাপার্বণে এখনো যে তারা আসে না তা নয়, তবে ঐ পর্যন্তই। তারা আসার আগে একপ্রস্থ ঝগড়া করে লছমী। চলে যাবার পর আবার আরেক দফা।
পাড়ার লোক অবাক হয়ে ভাবে, এই তো বুড়ি শাশুমাকে শয়তানী ডোকরী বলে কথা শোনাচ্ছিল লছমী। বিনীত কে বলছিল শয়তান কা ঔলাদ। ছেলেদের শূয়ার কা বাচ্ছা! আরো সব বাছা বাছা খিস্তির তুবড়ি! শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। লছমীর সঙ্গে তারস্বরে চেঁচাচ্ছিল বাপ-বেটা বিনীত আর মন্টু। মিনমিন করছিল শাশুড়ি বিমলা। ওমা, তারপরেই হাততালির ছন্দে ছন্দে “হ্যাপী বার্থডে টু ইউ”। কখনো বা সমবেত ভজন “জয় জগদীশ হরে”। এ বাড়ি না আজব চিড়িয়াখানা!
লছমীর ঝগড়ার এখন নতুন ইস্যু। বরকে বলে “অন্য ধান্দা করো। এখন কজন শাড়ি পরে! আমিই তো শাড়ি ছেড়ে শালোয়ার ধরেছি। তোমার ঐ সুরাতের সস্তা, সিন্থেটিক ছাপা শাড়ি আর চলবে না। নিজের অন্য ব্যবসা শুরু করো”।
বিনীতও বোঝে সে কথা। সত্যিই ব্যবসায় কবে থেকে মন্দা চলছে। কিন্তু আলাদা হব বললেই তো আলাদা হওয়া যায় না! বড় ছেলে মন্টু আর ছোটো ছেলে পাপ্পু এসব ধান্দায় যাবে না। একা এখন পুঁজি লাগিয়ে কতটা কি করা যাবে! দেখা যাক, এবার দীপাবলি তে লছমীগণেশ যদি কৃপা করে! তবে লছমীদেবী কৃপা করবে কোন দুঃখে! ঘরেই যে অলক্ষ্মীর বাস! দিনরাত অশান্তির মহলে দেবী কি প্রসন্ন হয়? লছমী আসার পর থেকেই যেন বাড়িতে অলক্ষ্মীর প্রবেশ!
দীপাবলির সকাল থেকে সকলের মাথা খেয়ে লছমী পুজোর যোগাড় করল। রঙ্গোলী বানালো। ধানের ওপর কলস বসিয়ে তাতে ধনতেরসের দিন কিনে আনা চাঁদির সিক্কা রাখল। লক্ষ্মীগণেশের পটে মালা পরালো। সিঁদুর গোলা দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে সদর দরজার বাইরে, ঠাকুরঘরের দেওয়ালে লিখল “শুভ লাভ”। ষোড়শ উপাচারে পুজো সাজিয়ে তালি বাজিয়ে সবাই আরতি গাইল, ওঁ জয় লক্ষ্মী মাতা, মাঈয়া জয় লক্ষ্মী মাতা….”।
জয়সোয়ালদের ছোটো নাতি পাপ্পু পুজোয় বিশেষ ধ্যান দিতে পারছিল না। ওর মন পড়ে ছিল দালানের থামের খাঁজে লুকিয়ে বসে থাকা একটা ছোটিসি উল্লুর ওপর। বেচারী কোথা থেকে তাড়া খেয়ে সকাল থেকে এখানে লুকিয়ে বসে আছে কে জানে! বাড়ির আর কারো চোখে পড়েনি। বঙ্গালীরা বলে, উল্লু নাকি লছমীজীকা বাহন। অথচ ঠাকুর ঘরের লক্ষ্মী মাতার ছবির পেছনে দুটো সফেদ হাতি শূঁড় দিয়ে ধনবৃষ্টি করে। কোথাও কোনো উল্লুর চিহ্ন নেই। দাদি ছোটবেলায় গজলক্ষ্মীর কাহানি শোনাত। আজকের দিনে দাদি ঐটাকে দেখলে নির্ঘাত বলবে অপশগুন।ওটাকে এক্ষুণি বিদেয় কর।
পাপ্পু জানে তাদের ফ্যামিলির বিজনেস এখন পড়তির দিকে। ইদানিং মা লুকিয়ে লুকিয়ে অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছে। লেডিস ব্যাগ, ইমিটেশন জুয়েলারি আরো সব কি কি। ব্যবসা চললে কি মায়ের মাথা একটু ঠাণ্ডা হবে! রোজ রোজ বাড়ির এই অশান্তি আর ভালো লাগে না! পাড়ার লোকের কাছে মুখ দেখানো যায় না।
আরতি শেষ হতেই পাপ্পু দৌড়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে দালানে এল। পেঁচাটা আছে, না সন্ধ্যে নামতেই উড়ে গেল!
লছ্মীও ছেলের পেছনে পেছনে বকতে বকতে এল,
— ক্যয়া রে তেরা ইতনা জলদিবাজি কিঁউ! পরসাদ তক নহী লিয়া!
— মাম্মী দেখো না, ঐ ওখানে একটা পেঁচা সকাল থেকে এসে চুপটি করে বসে আছে। তুমি জানো আজকের দিনে বাড়িতে উল্লু আসা শুভ না অশুভ!
মা আর ভাইয়ের সঙ্গে মন্টুও ছুটে এল,
— কোথায়, কোথায় উল্লু?”
— ওহি তো উঁহা, দেখো থাম্বে কি উপর।
বিনীতও এল, “ব্যাপারটা কি!” পাপ্পুর দাদিও পা টেনে টেনে দালানে এসে চোখ কুঁচকে ছোট্ট প্রাণীটিকে দেখতে চেষ্টা করল। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ।
কে জানে দিপাবলীর দিনে বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া এই ছোটো প্রাণীটা কিসের ইঙ্গিত নিয়ে এল! শগুন ইয়া অপশগুন!!!
পেঁচাটাও গোল গোল চোখে সবার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
বাহ দারুন।
আপনার ছত্রিশগড় ভাষার দখল দেখে অবাক হয়ে যাই।
আপনি ওখানকার ভাষা যথেষ্ঠ মনোযোগ সহকারে শিখেছেন বুঝতে পারা যায়।
আপনার দেখে পড়ে যথেষ্ঠ আনন্দ পাই।
ভালো যাবেন।