ভূমিকা
প্রায় এক মাস আগে (মে, ২০১৯,-এর শেষ সপ্তাহে) শ্রী সুভাষ চন্দ্র বসুর আই-সি-এস থেকে অব্যাহতি চেয়ে লেখা একটা ফটোশপ করা পদত্যাগ-পত্র ভাইরাল হয়েছিল সোসিয়েল মিডিয়ায়। ভাইরেল হওয়া ইস্তফা-পত্রটা ২২.৪.’২১ তারিখে লেখা কোন কল্পিত রাইট অনারেবল E.S. Nconlique-কে সম্বোধন করা “স্বাক্ষর-বিহীন টানা-হাতের-লেখা-ফন্টে টাইপ এবং ফটোশপ করা চিঠি। কিন্তু আমরা জানি যে সে সময় (অগাস্ট ১৯১৭ – মার্চ ১৯২২) লন্ডনে ‘সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া’ ছিলেন মিঃ ই.এস. মন্টেগু (E.S. Montagu)। সেই মূল পদত্যাগপত্রটা লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউস লাইব্রেরীতে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারত সরকারের ফাইল নাম্বার L/J&P/6238/20 তে রাখা আছে বলে জানিয়েছেন একজন ঐতিহাসিক। (Brothers Against the Raj – Leonard A. Gordon.)
আমার এই লেখাটা অবশ্য কিছুটা অন্য কারণে। ভারতবাসী, বিশেষত বাঙালিদের মধ্যে সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের অনেক ঘটনা সম্বন্ধে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে, লক্ষাধিক সদস্যের ফেসবুকের একটা জনপ্রিয় গ্রুপে এক বয়স্কা বাঙালি ভদ্রমহিলা লিখেছিলেন যে তিনি নাকি কোথায় পড়েছেন যে নেতাজী ঘোড়ায় চড়তে জানতেন না বলে তাঁকে আই-সি-এস হবার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে মাঝপথে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। এরকম আগেও হতে দেখেছি। কোন এক ফেসবুক গ্রুপে একটা ছবি দেখেছিলাম নেতাজী চেয়ারে বসে আছেন আর তাঁর ন’দাদা (চতুর্থ দাদা) শ্রী সুধীরচন্দ্র বসু আর ন’বৌদিদি শ্রীমতী শান্তিলতা দেবী পেছনে দাড়িয়ে। ছবিটার শিরোনাম (ক্যাপশন) ছিল নেতাজী তাঁর বাবা মার সাথে! ভুল Caption সহ সেই ছবিটা এখনো ইন্টারনেটে বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং ফলস্বরূপ একটা বইতে ন’দাদা-বউদির সেই ছবি ফটোশপের সাহায্যে আলাদা করে নেতাজীর মা-বাবার ছবি বলে ছাপাও হয়েছে ইদানীং (Pictoral Biography : Subhas Chandra Bose, Jainco Publishers, Delhi-110095)। বইটা অবশ্য অগুন্তি ভুলে ভরা।
আমি জানি যে বেশির ভাগ নেতাজী-ভক্তই নেতাজী বিশেষজ্ঞ এবং তাঁদের এই জীবন সংঘর্ষে নানা ব্যস্ততার জন্য নেতাজী-বিষয়ক বই পড়ার তেমন সময় বা অবসর হয়ে উঠেনা। নেতাজী বিষয়ে তাঁদের এই ‘ফলিত’ জ্ঞানের বেশীটাই বোধহয় এরকম অশ্বারোহণে অসামর্থ্যতার কাল্পনিক গল্প শুনে অর্জন করা।
এই লেখাটার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নেতাজীর আই-সি-এস পাস করা থেকে পদত্যাগ করার বিষয়ে কিছু তথ্য কয়েকটা প্রামাণিক গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করে এক জায়গায় লিপিবদ্ধ করে রাখা আর একাজ করতে গিয়ে যেসব ভুল-ভ্রান্তি চোখে পড়েছে তার কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া। কেউ কেউ নেতাজী বিষয়ে লেখা কিছুটা রম্য রচনার মত বা অনেকটা ধারাবিবরণীর মত লেখেন। যেহেতু আমার জন্ম ১৯৫০-এর দশকে এবং আমি ব্যাসদেব জাতীয় কোন মুনি-ঋষি-দেবতার দিব্যদৃষ্টির বর-প্রাপ্ত নই, আমার বেশীর ভাগ লেখাই এরকম পুরানো বইয়ের তথ্য-নির্ভর। এখানে একটা কথা আগেই বলে রাখা ভাল যে আমি যে বইকে প্রামাণিক গ্রন্থ বলে মনে করি, অন্য কেউ তাকে তা মনে নাও করতে পারেন। সাধারণত আমি একাধিক বই থেকে বিতর্কিত তথ্য যতটা সম্ভব তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সত্যটা অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করি, এবং প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই তথ্যের সাথে বইয়ের নাম ইত্যাদি উল্লেখ করে থাকি। এ লেখাটায় আমি অনেক ক্ষেত্রে একাধিক উদাহরণ দিতে চেষ্টা করব, তবে তথ্য-সূচী সহ। তাছাড়া, আবারও বলছি, কিছু বিতর্কিত তথ্যও, উৎস সহ, উল্লেখ করে দেখাতে চেষ্টা করব যে প্রামাণিক বইতেও কত ভুল লেখার সম্মুখীন হ’তে হয়। এবার নেতাজীর আই-সি-এস এর কথায় ফিরে আসি।
নেতাজী কবে স্থির করেছিলেন যে আই-সি-এস থেকে ইস্তফা দেবেন?
যদি বলা হয় যে স্কুলের ফার্স্ট ক্লাসে (এখনকার ক্লাস টেন-এ) পড়ার সময় ১৯১২ খৃষ্টাব্দের ১৭ থেকে ২০ অক্টোবর (দুর্গা-পূজার সপ্তমী থেকে দশমী) — এই চার দিনের কোন একদিন — সুভাষ চন্দ্র বসু আই-সি-এস পাশ করবেন এবং সেই চাকুরিতে যোগ দিয়ে তারপর পদত্যাগ করবেন বলে মনস্থির করেছিলেন, তবে কি (খুব অল্পসংখ্যক প্রকৃত অধ্যবসায়ী পাঠক ছাড়া) তা বিশ্বাস করবেন? কিন্তু এটাই সত্য। ‘সুভাষের সঙ্গে বারো বছর (১৯১২-১৯২৪)’ বইতে শ্রীহেমন্তকুমার সরকার আমাদের জানাচ্ছেন, “সুভাষের সঙ্গে আমার যখন প্রথম দেখা হয়, তখন থেকেই আমরা স্থির করেছিলাম, পাশ করে আমরা চাকরি করবো না এবং পরে ঠিক করি সুভাষ আই-সি-এস ও আমি আই-ই-এস-এ ঢুকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাকরি মোহগ্রস্ত বাঙালীর সামনে একটা আদর্শ প্রতিষ্ঠা ক’রে দেশের সেবা করবো।” এর আরও প্রমাণ আছে যা পরে দেওয়া যাবে।
সুভাষ চন্দ্র বসুর বিদেশে পড়াশুনা করার আগ্রহ
পুরানো নিয়ম (Old regulations) অনুযায়ী আই-সি-এস পরীক্ষা আগস্ট মাসে হ’ত এবং শুধু লন্ডনেই দেওয়া যেতো। তার মানে বাইরে পড়তে যাবার কথা সুভাষচন্দ্র ১৯১২ খৃষ্টাব্দেই ভেবেছিলেন। সুভাষ চন্দ্র বসু যখন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১৬ খৃষ্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কৃত হয়ে মার্চ মাসের শেষে কটক চলে যান, তখন এসব পরিকল্পনা অনিশ্চিত হয়ে পরে। সেসময়ও কিন্তু তিনি বিদেশে পড়তে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বুঝতে পারলেন যে বাবা শ্রীজানকীনাথ বসুর এতে তীব্র আপত্তি রয়েছে। তাঁর পিতৃদেবের দৃঢ় অভিমত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হওয়ার কলঙ্ক মাথায় নিয়ে বিদেশগমন অসম্ভব। অর্থাৎ প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিতে হ’বে, তারপর অন্য কিছু। [An Indian Pilgrim : An Unfinished Autobiography by Subhas Chandra Bose]
এখানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও একটা কথা জানিয়ে রাখি। নেতাজীর ভ্রাতুষ্পুত্র ড: অশোক নাথ বসু জানিয়েছেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রাষ্টিকেট হয়ে এসে কটক-এ থাকার সময় তিনি রাঙাকাকাবাবু বা সুভাষচন্দ্র বসু-কে অশ্বারোহণ অভ্যাস করতে আর বাগান পরিচর্যা করতে দেখেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন যে তাঁর পিতামহ অর্থাৎ শ্রীজানকীনাথ বসু ছেলেদের অশ্বারোহণ অভ্যাস করার জন্য কটকের বাড়ীতে একটা আলাদা ঘোড়া রেখেছিলেন এবং তাঁর পিতৃদেব (শ্রী শরৎচন্দ্র বসু) এবং রাঙাকাকাবাবু অন্য খেলায় আগ্রহ না দেখালেও উভয়েই ঘোড়সওয়ারীতে বা অশ্বারোহণে পারদর্শী ছিলেন। অশোকনাথ বসুর (জন্ম ডিসেম্বর ১৩, ১৯১১) বয়স তখন অবশ্য শুধু সাড়ে-চার বছর। কিন্তু রাঙাকাকাবাবু সম্পর্কে এটা তাঁর প্রথম স্মৃতিগুলোর মধ্যে একটা। [My Uncle Netaji by Dr. Asoke Nath Bose, Bharatiya Vidya Bhavan, 1977, Second Edition 1989, Page 2] [ক্রমশ]