ডে নাং-এর স্মৃতি আমার সাথে আছে। রাতে স্বপ্ন দেখছি সেই অন্ধকার কালো সমুদ্র, অবিরাম অবিশ্রাম জলকল্লোল এর ধ্বনি। কালো আঁধারের ভেতর জেগে আছে তার সাদা কল্লোলের চঞ্চলতা। সুদূর রেখায় লেডি বুদ্ধের স্বর্ণাভ আলো। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। আমি যেন এক অসামান্য জেলে, যাকে জীবন বাজি রেখে যেতে হয় মাঝ সমুদ্রে, যাকে লড়তে টাইফুনের সাথে, হাঙরের সাথে। হ্যারিকেন-এর সাথে।
হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল। ছুটে গেলাম জানালার কাছে। কোথায় সমুদ্র? মাথা উঁচু সার সার হোটেল।
অহো আমরা ডে নাং যে ছেড়ে এসে এসেছি। এভাবেই কত ভাল লাগা ছেড়ে দিয়ে ফেলে দিয়ে চলতে হয়। আর দেখাও হয় না, ফেরাও হয় না। ভালো থেকো ডে নাং, আরও সুন্দর হয়ে ওঠো। আপাতত হ্যানয়। হ্যাঁ এই গাইড মেয়েটা খুব আকর্ষক। উঁহু, আর একটুও দেরি নয়। আজ প্রাচীন প্যাগোডা, নিহ বিন প্রভিন্স। আগামীকাল হ্যালঙ বে। আগামীকাল ক্রুজ। তাড়াতাড়ি তাড়িতাড়া প্রাতঃকৃত্য, প্রাতরাশ। উফ কিম, তোমাকে ভুলব না। অতঃপর, যাত্রা শুরু।
উপাদেয় প্রাতরাশ সেরে অতঃপর রওনা দিলাম। আজ ল্যাম বলছে — বারবার তাদের দেশে পরদেশ দখলকারীরা এসেছে। ফরাসি রাজত্বে ভিয়েতনামের মানুষদের লেখাপড়ার কোনও অধিকার ছিল না। তারপর একটি হাসপাতাল দেখাল, বলল — এই দেশে বড় বেশি ক্যান্সার হয়। কেন হয় জানো? আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র রাসায়নিক তরল বর্জ্য এই দেশের দিকেই ছেড়ে দেয়। যেহেতু আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, তাই আমরা কিছু বলতে পারি না। নিজেদের ভাষা নিয়ে বলল আমাদের ভাষা শেখা খুব কঠিন। কোনও বিদেশি লোকের কাছে এটা শেখা প্রায় দুঃসাধ্য কারণ এতে টোনের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেটা কিম বলেছিল। একই শব্দ শুধু টোনের ব্যবহারে ভিন্ন ভিন্ন বস্তুকে বোঝায়।
নিহ বিন (Ninh bin province) প্রভিন্স এ চলে এলাম। এখানে মার্বেল পাথর এবং চুনাপাথরের পাহাড় রয়েছে। প্রথমেই নৌকোবিহার। লেক-এর মাঝে মাঝে চুনাপাথরের পাহাড়। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এই পাহাড়গুলো তৈরি করেছে গুহার। এবড়োখেবড়ো হয়ে এমনভাবে পাহাড় এক আশ্চর্য গুহার নির্মাণ করেছে যা না দেখলে ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না।
নৌকো যায় এর গুহার ভেতর দিয়ে। এগুলো এতটাই নীচে নেমে এসেছে যে নৌকোয় সোজা হয়ে বসলে মাথায় আঘাত লাগতে পারে।
নৌকোচালক এক মহিলা। পা দিয়ে বৈঠা ঠেলছে। বয়স্ক মহিলা। দেখে তো স্তম্ভিত হলাম। মুখে হাসি লেগে আছে। ভাষার বিনিময় নেই। হাই হুই সংকেতে কাজ চলছে। মাথার সামনে তার ফোকাস আলো লাগিয়ে রেখেছে। ভিডিও করতে করতে যাচ্ছি। মাথায় জোর ঠোক্কর লাগতো। সে কী একটা শব্দ আগে থেকেই বারবার করে বলছিল। মনে হয় সাবধান করে দিচ্ছিল। এবারে সে প্রায় চিৎকার করে উঠল। তারপর মাথা নোয়ালাম। একেবারে নিকষ অন্ধকার। ওর ফোকাস আলোয় গতিপথ এবং পাথুরে পাহাড়ের বিচিত্র আকৃতি দেখা যাচ্ছিল।
এভাবে বেশ কয়েকটি গুহা পেরিয়ে এলাম। নিহ বিন প্রভিন্স প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডারের জন্যে বিখ্যাত। যদিও আমাদের এই নৌকোবিহার ও প্যাগোডা ছাড়া বিশেষ কিছু দেখা হয়নি। প্যাগোডাটি শতাব্দীপ্রাচীন। পেছনে পাহাড়, প্রাচীন কালো পাথরের সারি উঠে গেছে ওপরে।
কিছু সিঁড়ি ভেঙে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উপরে আর ওঠার সাহস হলো না। পাহাড়ের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি একেবারে হালকা পলকা দেহের এক শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধ দিব্যি চটপট উঠে যাচ্ছে একা একাই।
ততক্ষণে ছবি তোলার হিড়িক পড়েছে যারা উপরে যায়নি তাদের মধ্যে। গাইড-এর সঙ্গে ছবি তুলল সমীর। আমিই ক্লিক করলাম নাতিদীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
সবাই ফিরে এলে নীচে নেমে প্যাগোডার ভেতর দেখতে গেলাম। উজ্জ্বল বুদ্ধমূর্তি। গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম — তুমিও কি বৌদ্ধ? বলল — হ্যাঁ, এখানে বেশিরভাগই বৌদ্ধ।
নিহ বিন প্রভিন্সে রয়েছে এই প্যাগোডা। এইসব প্যাগোডা বহু পুরনো শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। এই প্যাগোডাটির নাম bich dong প্যাগোডা। (ক্রমশ)