রাতের সমুদ্র। কালো, প্রেক্ষিতে সাদা ঢেউ আছড়ে পড়ছে। একটা পশ্চিমী যুবক হাতে জুতো নিয়ে তটরেখা ঘেঁষে হেঁটে চলেছে। বেশ খানিকটা পেছনে একটি ভিয়েতনামিজ যুবতী একইভাবে একা চলেছে হেঁটে। জলকল্লোল বারবার আছড়ে পড়ে তাদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাঁদিকে অনেকটা দূরত্বে সোনালি রঙের উজ্জ্বল এক মূর্তি। ইনি লেডি বুদ্ধ, ইনিই যেন চমৎকার সুন্দর এই বন্দর শহরটাকে আগলে রেখেছেন। জেলেরা যখন দূর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়, বিশ্বাস করে ইনিই তাদের রক্ষা করেন।
এটি চিন সাগর, তার সাথে মিশেছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশ। এই ব্যাপারটি এক অভাবনীয় অনুভূতি, বিরাটকে, অনন্তকে কাছে পাবার, ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি। “জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার ” তবু কেন সমুদ্রের সাথে মিশে গিয়ে বলি – “আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার”
কিন্তু সমুদ্র কি কোথাও যায়? সে যে নিরন্তর! কিন্তু এই শূন্য ছাড়া যে সব সংখ্যাই অকেজো। সুতরাং শূন্য করে চলে যাওয়ার ব্যঞ্জনায় এই মহাশূন্যে মিশে যাওয়া….কিম্বা বিরাটত্বে মিশে যাওয়া।
পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। আজ প্রথমে কোকোনাট ভিলেজ। তারপর লাঞ্চ। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতে ডিনার সেরে এয়ারপোর্ট। আজ হ্যানয়যাত্রা। চললাম নারকেলবীথি দেখতে। আসলে চলেছি ডা নাঙ কাম থান (Cam Thanh water coconut village)। Cam Thanh অর্থ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার।
এখানে রয়েছে নৌকোবিহার। রয়েছে বাস্কেট বোট। মনে হলো গোল বেতের টুকরি। দুজন করে বসা যাবে। দুপাশে নারকেল গাছের সারি। এখানে নারকেলগাছ অনেকটা বেঁটে আর ডাঙায় এবং জলেও নারকেল গাছ হয়। নারকেলগুলো দেখতেও একটু আলাদারকমের।
হৈ হৈ করতে করতে চলেছি। নৌকোচালক গান ধরেছে। ভাষা তো বোধগম্য নয়। তবে শেষে বারবার ফিরে ফিরে আসছে ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম। সুতরাং আমরাও সুর মিলিয়ে ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম করছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার অফুরন্ত। কিছুদূর এগোনোর পর দেখলাম হাতে বৈঠা নিয়ে নৌকোচালক যুবক গান গেয়ে গেয়ে ঐ গোল নৌকোটাকে অপূর্ব দক্ষতায় ঘোরাচ্ছে। তাকিয়ে দেখবার মতই। সব নৌকো ভিড়ল ওকে ঘিরে। অত:পর কিছু দক্ষিণাগ্রহণ টুরিস্টদের কাছ থেকে, ভিএনডি হোক, ডলার হোক, রুপি হোক সব চলবে। জলবিহার শেষ হলো অত:পর। মাটিতে পা দিয়েই দেখি এক ভিয়েতনামী যুবক নাচতে শুরু করেছে সাথে গান। ব্যস, শুরু করে দিলাম নাচ। সহযাত্রীরা একে একে এসে যোগ দিলেন।
দিব্যি হিন্দি গান বাজছে। এরপর নেমে আসছেন একে একে সহযাত্রীরা। মাটিতে পা ছুঁইয়েই শুরু হয়ে গেল নাচ।
ভিয়েতনামে যা কিছু উৎপাদন হয় সবকিছুই তারা ব্যবহার করে। হস্তশিল্পের নানাবিধ ব্যবহারযোগ্য সুন্দর সব পণ্যদ্রব্য তৈরি করে সারা বছর। অসম্ভব পরিশ্রমী। এই পর্যটন ঋতুতে এগুলো বিক্রি করার জন্যে এদের উদ্যম ও চেষ্টা সত্যি দেখার মতো। সারা বছরের পরিশ্রমের বিনিময়ে এই পর্যটন ঋতুর জন্যে তারা হয়তো অপেক্ষায় থাকে।
বাস এনে আমাদের হোটেলের উল্টোদিকে সী বিচে ছেড়ে দিল। আজ হ্যানয় যাত্রা রাতে। অদূরে ড্রাগন ব্রিজ ঝকমক করছে রোদের আলোয়। কিন্তু শহর ঘুরে দেখা যেত যদি একটু খানি। কিন্তু কী আর করা। কিছু ছবি তোলা হলো।
বেশ আগেই আমরা ডে নাং এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম।
ফেরার পথেও ভিয়েতজেট। একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। যাবার সময় ফ্লাইট এর নম্বর বদলে গেল, গেট নং ও বদলালো, ফেরার পথে তিনঘন্টা দেরিতে ছাড়ল।
যখন হ্যানয় পৌঁছোলাম, অসম্ভব শ্রান্ত ক্লান্ত। এবারে নতুন গাইড, একটি মেয়ে। সে এগিয়ে এলো। অত্যন্ত সপ্রতিভ, প্রথম দেখায় একটি ভালো লাগা ছুঁয়ে গেল। মেয়েটির অমনি একটি লম্বা নাম। বলল— আমাকে ল্যাম বলে ডেকো। জিজ্ঞেস করা হলো ল্যাম অর্থ কি? বলল — ফুল।
মেয়েটি সত্যিই অসাধারণ। জানার পরিধি বেশ ব্যাপক। এরমধ্যেই সে ভিয়েতনাম এর বর্তমান ও ইতিহাস নিয়ে কিছু কিছু বলে ফেলেছে। মন লাগিয়ে শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম হোটেলের সামনে। অনেক রাত। দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ। আলো আঁধারিতে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নজরে পড়ল না। মেয়েটি বলে চলেছে — তোমাদের তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, আমাদের কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। আমরা সরকারের সমালোচনা করতে পারি না। সরকারের নির্দেশনাই শেষ কথা। বর্তমানে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র কাম্বোডিয়া, লাওস, চিন। তোমাদের দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মোটামুটি। আমাদের সরকারের গঠনপ্রণালী এইরকম — একজন জেনারেল সেক্রেটারি, একজন প্রধানমন্ত্রী। এরাই মুখ্য। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্র চালনা করেন, আর জেনারেল সেক্রেটারি অর্থনৈতিক বিষয় দেখেন। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হয়। তাতে পরিবারের সবাই গিয়ে ভোট দিতে পারেন, আবার পরিবারের পক্ষ থেকে একজন গিয়েও সবার ভোট দিয়ে আসতে পারেন।
মেয়েটির ইংরেজি উচ্চারণ স্পষ্ট। হ্যানয় ক্যাপিটাল সিটি, সুতরাং গাইড উন্নতমানের হবে নিশ্চয়ই। অতঃপর একটি নদী পেরিয়ে গেলাম। ব্রিজটা বেশ সুন্দর। ল্যাম বলল — এইটাই বিখ্যাত রেড সী। এই নদী তিনবার বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের সময় যাতে পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। পরবর্তীতে আমাদের রাষ্ট্রনেতা হো চি মিনের আত্মত্যাগে আমরা এক হলাম, এক হতে পারলাম।
কথা শুনতে শুনতে কখন যেন হোটেল এসে গেল। কিন্তু জানালা দিয়ে দেখলাম হোটেলের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। একটু পর ল্যাম ফিরে এসে বাসের দরজা বন্ধ করে চলে গেল। একটু আগেই সে বলছিল তোমাদের ফ্লাইট তিনঘণ্টা দেরি করেছে। জানালা দিয়ে দেখছি হোটেলের দরজা খুলল। ল্যাম এবং আমাদের ট্যুর অপারেটর ভেতরে গেলেন। বেশ খানিকটা সময়। বাসের দরজা বন্ধ করায় আমার কেমন জানি ভয় করছিল। আজ কি সারারাত বাসে কাটাতে হবে? রাস্তার ওপাশে জানালার বাইরে একটি বাড়ি থেকে একটি ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে এসেছে, চওড়া ফুটপাতে ছোটাছুটি করে আবার বাড়ির ভেতর গেল। আবার বেরিয়ে এলো। জনবিহীন রাজপথ। এর চাইতে সাইগন বা হো চি মিন সিটি অনেক গমগমে। কিন্তু এটা ভিয়েতনামের রাজধানী।
এইসময় শিখা চ্যাটার্জি রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে উঠলো। কোন গানগুলো গেয়েছিল এখন লিখতে বসে ঠিক মনে পড়ছে না, “চিরবন্ধু, চিরনির্ভর, চিরশান্তি, তুমি হে প্রভু” এরকম কিছু। আশ্চর্য কী অদ্ভুত প্রশান্তি এলো পুরো আবহে।
হে কবি, তোমার গানে এতো প্রশান্তির সুর কী করে আনলে তুমি? হে ক্ষণজন্মা পুরুষ, তোমায় প্রণাম। সাথে সাথে শিখার কথাও ভাবছি। এমন না হলে শিল্পী!
সেই সময় বাসের দরজা খুলে ল্যাম ঢুকে বলল — আমি খুব দুঃখিত এই অসুবিধের জন্যে। আপনারা ক্লান্ত, এত কষ্ট দিলাম, খুব খারাপ লাগছে। তবে আমরা এখন অন্য হোটেলে যাচ্ছি। এটা বন্ধ হয়ে গেছে। জানালায় তাকিয়ে দেখলাম ধেড়ে ইঁদুরটা এখনও ফুটপাতে ছোটাছুটি করছে। ছুটুক।
আমরা রাতের হ্যানয়ের ছবি দেখতে দেখতে এক ঝলমলে হোটেলের সামনে এসে গেলাম।
ল্যামের মুখে এখন হাসি। আগামীকাল প্রথম ভিউ পয়েন্ট প্রাচীন প্যাগোডা, তারপর নিন বিন প্রভিন্স।
(ক্রমশ)
তোমার লেখা আর কারো কিছু (আমার কথাই বলছি) সামান্যতম বহিঃপ্রকাশ দেখলেই তুমি তা তোমার কলম বন্দী করে তোল, বন্ধু তোমার এই মহৎ মানসিকতা আমাকে ধন্য করেছে গো।
আর তোমার লেখা, যত পড়ছি তত আকৃষ্ট হচ্ছি পরবর্তী লেখা পড়ার জন্য, সব কিছু মূর্ত হয়ে উঠছে , হারিয়ে যাচ্ছে বর্তমান, ভিয়েতনামের প্রতিটি মুহূর্ত ছবির মতো ভেসে উঠছে চোখের সামনে। অনেক অনেক ভালোবাসা বন্ধু।