ডে নাং সিটি
বাতাসে এখনও যুদ্ধ যুদ্ধ ডাক, কোথাও না কোথাও যুদ্ধ হয়েই চলেছে। সভ্যতা এগোয়, যুদ্ধের ডাক থামে না। লিও টলস্টয় কবে লিখে গিয়েছিলেন “War and Peace”। তাই আজকাল ভাবি শিল্প সাহিত্যের কোনও প্রভাব সভ্যতার গায়ে আঁচড় কাটতেও পারল না? টলস্টয় মানবজীবনের ইতিহাস সম্পর্কেও বলেছিলেন মানবজীবনের ইতিহাসেরও কোনও দিকনির্দেশনা নেই। মনে হয় তা যেন মূলত কিছু আতঙ্কেরই ফসল।
ফিরে আসি যাত্রাপথে। ভিয়েত জেট বিমানে আমরা যাচ্ছি ডে নাং সিটি। একঘন্টা পাঁচ /দশ মিনিটের বিমানযাত্রা। বিমানবন্দরে কড়াকড়ি বেশ। সিকিউরিটি চেকিং এ একেবারে জুতো অব্দি খুলে এপার থেকে ওপারে যেতে হলো। এখানে নারীপুরুষের ভেদাভেদ বিলকুল নেই। সিকিউরিটি চেকিং এ পুরুষ নারীদের কিম্বা নারী পুরুষের দেহ চেকিং করতে পারে। মেয়েদের জন্যে আলাদা করে সিকিউরিটি চেকিং এর জন্যে ঘেরাটোপ চোখে পড়ল না।
জানালার পাশে বসে নীচে তাকিয়ে দেখছি বেঘোরে অন্ধকার। আমরা কি সমুদ্র পেরিয়ে যাচ্ছি? হো চি মিন সিটি হচ্ছে ভিয়েতনামের একেবারে দক্ষিণে, ডে নাঙ সিটি মধ্য ভিয়েতনামে। দুটো শহরের মধ্যে দূরত্ব ৯২৪ কি মি। প্রায় সময়মতো আমরা ডে নাঙ সিটিতে পৌঁছে গেলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একইভাবে ডে নাঙের গাইড এসে অভিবাদন জানালো। একটি যুবক। কিন্তু বোঝা গেল একটু সমস্যা হবে আলাপচারিতায়। কারণ তার উচ্চারিত ইংরেজি অনেকটাই ভিয়েতনামী উচ্চারণ ঘেঁষা। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। যুবকটি তার নাম ও ফোন নং দিল সবাইকে। নাম হো ফি ভু (Ho Phi Vu)। বলল কেউ কোনও অসুবিধেয় পড়লে কিম্বা দলছুট হয়ে পথ হারিয়ে ফেললে ওকে ফোন করলেই চলবে।
তবে এই গাইড একটু গম্ভীর প্রকৃতির। হাসি আছে মুখে, তবে কিছুটা কি কষ্টার্জিত? এসব আমার নিজেকে নিজে প্রশ্ন, নিজের সাথে নিজে কথা। হ্যাঁ, ভাষা একটা সমস্যা হচ্ছে হয়তো, কিম্বা আমাদের হুল্লোড়ে হয়তো বা…. আসলে গাইডদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা স্বভাবজাত অভ্যাস এই কলমচির, আর কিছু নয়। গাইডদের যেমন জানতে হয় তেমনই পরিবেশন ক্ষমতা ভালো থাকা খুব জরুরি। সে ক্ষেত্রে হো ফি ভু- কে নিয়ে একটু চিন্তা তো থেকেই যায়। যাক গে, এত ক্লান্ত হয়ে হো ফি ভু -কে চিন্তা করার আর দরকার নেই, ওকে ওর কাছেই ছেড়ে দেওয়া ভালো।
এইবার হো ফি ভু বলল- আজ শহরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। আগামীকাল প্রথম ভিউ পয়েন্ট বা না হিলস। আমাদের হয় ছাতা নয় রেনকোট নিয়ে যেতে হবে। বৃষ্টি ও কুয়াশায় ঢেকে থাকবে চারপাশ।
মনে মনে প্রার্থনা করছি আগামীকাল যেন একটা রোদেলা দিন হয়। এখন জানালায় চোখ। শহরটা ঝা চকচকে মনে হচ্ছে। একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, পর্যটক হিসাবে একটা দেশের আদৌ কি বিশেষ কিছু জানা হয়? ব্যাপারটা অনেকটা অন্ধের হস্তীদর্শনের মতোই ব্যাপার। তবে যতটুকু চোখে পড়ছে তা হলো চকচকে পথঘাট, চওড়া ফুটপাত, গোছানো গাছপালা। পরিচ্ছন্ন।আপাতত ডিনার। তারপর হোটেল।
ডিনার সেরে যখন হোটেলে ফিরছি তখন সোনালি আলোয় আলোকিত এক ব্রিজ। পুরোটা তখন দেখতে পারিনি। গাইড বলল- হান নদীর ওপর এই ব্রিজের নাম ড্রাগন ব্রিজ। পর্যটন ক্ষেত্রটিতেও এই ব্রিজটি সংযুক্ত হয়ে আছে। প্রতিটি সপ্তাহান্তে এই ড্রাগনের মুখ দিয়ে আগুন বেরোয় এবং নীল আলোর ঝলকানিতে এক অদ্ভুত আবহের সৃষ্টি করে। আমরা ঐ সময়ে যাই নি সুতরাং দেখা হয় নি।
এই ড্রাগনের আরও মুখ দেখেছি ভিয়েতনামের বিভিন্ন জায়গায়। ড্রাগন নিয়ে অনেক মিথ আছে ভিয়েতনামে। ড্রাগন তাদের কাছে রাজকীয়তার প্রতীক এবং রক্ষাকারীর প্রতীক। ড্রাগন ও পরী নিয়ে ওদের মিথ রয়েছে। ড্রাগন জন্ম দিয়েছে তাদের পূর্বপুরুষদের, আর পরী জন্ম দিয়েছে তাদের সন্তানদের ইত্যাদি। ভিয়েতনামকে সমুদ্র ঘিরে আছে বলে ভিয়েতনামের আরেক নাম “নীল ড্রাগনের দেশ”।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাস থেকে যখন নামলাম গা জুড়ানো হাওয়া এসে সারাদিনের ক্লান্তিকে যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল। বুঝলাম কাছাকাছি সমুদ্র আছে। এই হাওয়া সামুদ্রিক হাওয়া। কিন্তু তখন দেহ চাইছে বিছানা। কিন্তু তার জন্যে এখনও অনেকটা অপেক্ষা।
সকালে ঘুম যখন ভাঙল জানালায় তাকিয়ে দেখি বন্ধ কাচের জানালায় দৃশ্যমান নিঃশব্দ সমুদ্রের ঢেউ অবিরত বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে। ঝা চকচকে রাস্তায় যানবাহন চলাচল করছে। আমাদের হোটেল সমুদ্রতটের উল্টোদিকে তা গতকাল রাতে বুঝতে পারি নি। মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করলাম প্রগাঢ় নৈ:শব্দে বিশালত্বের হাতছানি। কিছু সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম চিত্রার্পিতের মতো। হঠাৎ মনে হলো আজ বা না হিলস, হো ফি ভু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে বলে দিয়েছে। সময়মতো ব্রেকফাস্ট সেরে সবাই জড়ো হয়েছে লাউঞ্জে।
আবার যাত্রা হলো শুরু বা না হিলসের উদ্দেশ্যে। বা না হিলস একসময় ফরাসিদের অবসর বিনোদনের কেন্দ্র ছিল। সেই হিসেবে তাদের তৈরি করা ভিলা, বাংলো গল্ফ ক্লাব ইত্যাদি ছিল। কিন্তু সেগুলো আর সংরক্ষিত হয়নি, তার পরিবর্তে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে একে তৈরি করা হয়েছে।
আমরা কেবল কারে উপরে উঠছি। অনেকটা সময় ধরেই মনে হচ্ছিল উঠছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১৪৮৭ মিটার। বর্তমানে ভিয়েতনাম পর্যটন কেন্দ্রে এইটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। কেবল কারগুলোও বিশেষ দ্রষ্টব্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু বৃষ্টি মেঘ কুয়াশায় আমরা এতটাই আচ্ছন্ন ছিলাম অনেককিছুই ভালো করে দেখা হয়নি।
৫০০ ফুট লম্বা এই ব্রিজটি দুটি হাতের ওপর ধরা। এইটি খুব সম্ভব ছবি তোলার দারুণ স্পট। এই মেঘ কুয়াশার ভেতর অজস্র মানুষের ভিড়ে কার্যত দিশেহারা লাগছিল।
(ক্রমশ)